প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগে চীনসহ বিভিন্ন দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা ভারতের : এবার দ্যুতক্রীড়া নয়, অর্জুন তার দেবদত্ত শঙ্খ বাজিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত

বিরাট পর্বের শেষ দিন l ত্রিগর্তের রাজা সুশর্মাকে তাড়া করলেন বিরাট রাজা l কিচকের অবর্তমানে তাকে সঙ্গ দিলেন ছদ্মবেশী যুধিষ্টির, ভীম, নকুল, সহদেব l রাজ্যে একমাত্র ক্ষত্রিয় কিশোর রাজপুত্র উত্তর ও বৃহন্নলা l বিরাট রাজ্য আক্রমণ করলেন হস্তিনাপুর সৈন্য l বৃহন্নলারুপী অর্জুন নিজের পরিচয় লুকোলেন না l অশ্বথ বৃক্ষ থেকে অস্ত্র নামিয়ে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ন, দুর্যোধনদের পরাজিত করে তাঁদের নিদ্রিত করে, দুর্যোধন, কর্ণের বস্ত্র নিয়ে গেলেন উত্তরার জন্য l পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দুর্যোধন দাবী করলেন, সে শেষ দিন পাণ্ডবদের চিনতে পেরেছেন l অর্থাৎ আরও বারো বছর বনবাস lঅর্জুনরা বললেন, চিনলে হবে না l শেষ দিন ধরতে পারেনি কেন? অর্জুন সদর্পে দাবী করলেন,আমরা চুক্তি ভঙ্গ করেছি, ভালো করেছি l কিন্তু আর বনবাস নয়, আর দ্যুতক্রীড়া নয় l এবার যুদ্ধ l বৃহন্নলা রূপ ছেড়ে এবার অর্জুন রূপে যুদ্ধl 
 
মোদী সরকারের আর্থিক সিদ্ধান্ত তথা প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগে চীনসহ বিভিন্ন দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা চীনের কাছে একটা দুঃস্বপ্ন l  চীন এই সিদ্ধান্তকে পক্ষপাতমূলক বলে প্রতিবাদ জানিয়েছে l দুঃখে কাঁদছে NDTV l গ্রামের মহাজন নিজের মেয়ের বিয়েতে গ্রামের সবাইকে নিমন্ত্রণ করে বিষাক্ত খাবার খাইয়ে সবাইকে পঙ্গু বানিয়ে, কম দামে তাঁদের স্থাবর সম্পত্তি কিনতে গেলে, বাধা পেয়ে বলছেন, ইহা পক্ষাপাতমূলক I
 
কিন্তু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চীন WTO গঠনের প্রথম দিন থেকেই অসম যুদ্ধকরে পৃথিবীর উপর কব্জা করে আসছে l মার্ক্সবাদের আশীর্বাদে চীন কিছু এমন কিছু সুবিধা ভোগ করে এসেছে, যা আর কারও ছিল না l যদিও এই অনৈতিক,অসম যুদ্ধজয়কে উদার বাঙালি মার্ক্সবাদের জয় হিসেবে চিহ্নিত করে গেছে চায়ের দোকান থেকেJNUযাদবপুরের ইউনিয়ন রুমে WTO চুক্তির প্রতিটি নিয়ম চীন ভাঙলেও, কিছু মূল জায়গা নিয়ে আলোচনা করা যাক l 
 
1. চীনে কোন শ্রমিক আইন নেই l সরকার যেকোন নাগরিককে কোন কাজ ঘাড় ধরে ন্যূনতম বেতনে, এমনকি বিনা বেতনেও করাতে পারে l এই সুবিধে আর কোন দেশের নেইl 
 
2. এদেশে কোন নিরপেক্ষ বিচার ব্যাবস্থা নেই যেখানে শ্রমিকরা বিচার চাইতে পারে l পাশ্চাত্য দুনিয়া ও পূর্ব এশিয়ার উৎপাদক দেশগুলো এর সুবিধা নিয়েছে তিন দশকl সেই সুযোগে চীন উৎপাদনে অপ্রতিদ্বন্দী হয়ে ওঠে l বিচার ব্যবস্থা তুলে আলিমুদ্দিনকেই যদি বিচারের পীঠস্থান করে দি, সরকারের তো ঘাটতিশুন্য বাজেট তৈরিতে আর বাধা থাকলো কোথায় lবিনিয়োগকারীর আরবিট্রেশন সহ অন্যান্য আইনের খরচ বেচে গেল l 
 
3. মানবাধিকার মার্ক্সবাদের শব্দকোষে নেইl বিনিয়োগকারীকে জমি অধিগ্রহনের জন্য সারা বিশ্বকে একটা পুনর্বাসনে (Rehabilitation & Resettlement) বিনিয়োগ করতে হয় l এই খরচ আজকের দিনে ভারতের মত গণতান্ত্রিক দেশে মোটামুটি প্রকল্পের 40% l চীনে এই বিনিয়োগ শুন্য l ঘাড়ধরে বাড়ি থেকে বের করে রাস্তায় ভিখারী বানিয়ে দিলেও কোন বিচার নেই lপ্রতিবাদ করলেও রাজদ্রোহের দন্ড মৃত্যু lপৃথিবীতে মৃত্যুদন্ডে এখনো এরা প্রথম lবিনিয়োগের খরচ 40% কমে গেল প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের তুলনায় l 
 
4. দেশে কোন নিরপেক্ষ মিডিয়া নেই l বছরের পর বছর অনৈতিকভাবে শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণ,মুদ্রার অবমূল্যায়ন, WTO র চুক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখিয়ে বিভিন্ন দ্রব্যে ভর্তুকি দেয়া, পেটেন্ট আইন ভেঙে প্রযুক্তিচুরি সহ সকলরকম কাজ যে দেশের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চলে, তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে কে? 

  1. এবং সর্বশেষে, চীনের পুরো অর্থব্যাবস্থা মিথ্যে ও অসত্যের উপর দাড়িয়ে l জিডিপির চেয়ে বেশী টাকা ছাপানো, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, শেয়ার বাজার অনৈতিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ, অর্থ পাচার ( Money laundering ) সহ বিভিন্ন ভাবে আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজারে কব্জা এবং অসৎ উপায় অবলম্বন করে বিভিন্ন তৃতীয় বিশ্বের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিকাঠামোতে কব্জা করা এদের মূল লক্ষ্য l
     
     
    WTO যুগের শেষ প্রান্তে এসে, ভারতবর্ষ তার অর্জুন রূপ ধরল, অজ্ঞাতবাসের শেষ দিনে l বুকফুলিয়ে WTO র চুক্তি ভেঙে, চীনের উপর একতরফা প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগে শর্ত আরোপ করে নিজের শক্তি প্রদর্শন করলো lকুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বে দুপক্ষের মধ্যে চুক্তি হয়,একপক্ষ নিয়ম ভাঙলে, অপরপক্ষেরও সেই অধিকার জন্মাবে l কিন্তু WTO চুক্তি থেকে US HUMAN RIGHTS CODE কে বাইরে রেখে প্রথমেই চীনকে সবরকম নীতিহীনতার ছাড়পত্র দিয়ে দেন তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন l এতদিন সারাবিশ্ব নীরব ছিল l ভারতওl 
     
     কিন্তু এবার যুদ্ধে মোদী l অভিমন্যু বধের বদলা হিসেবে প্রথমে জয়দ্রথ বধ l দ্রোণাচার্য, কর্ন, দুর্যোধন এর পর আসবে  l নিয়ম ভাঙার অধিকার তোমরাই দিয়েছো অভিমন্যু বধ করে l মাইকেল মধুসূদনের দৌলতে বাঙালি মেঘনাদের প্রতি বরাবর সহানুভূতি দেখিয়েছে l কিন্তু মেঘনাদ কেন প্রথমে নিয়ম ভেঙে মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করেছেন সে ব্যাপারে নির্বাক l কমরেড সুনীল গাঙ্গুলির দৌলতে বাঙালির কর্ণের প্রতি সহানুভূতি প্রশ্নাতীত  l কিন্তু কর্ন কেন নিয়ম ভেঙে অভিমন্যু বধ করলো, সে প্রশ্ন মাথায় আসে না l সেই বাঙ্গালী আজ চীনের অগ্রগতিকে পুরুষকার আর ভারতের প্রত্যাঘাতেকে মেঘনাদবধের তুল্য ভাবছে l ( শুধু লোকডাউন এ চায়ের দোকান পেল না )
     
    কোভিড উত্তর পৃথিবীতে নতুন স্বচ্ছ বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে l এবার দ্যুতক্রীড়া নয় l ধর্মযুদ্ধ শুরু l যেখানে একজন নিয়ম ভাঙলে,অপরজনেরও সেই অধিকার থাকবে l
     

সুদীপ্ত গুহ (Sudipta Guha)

( লেখক বহুজাতিক পরামর্শদাতা সংস্থা URS Consulting India র ভূতপূর্ব চিফ জেনারেল ম্যানেজার)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.