এ প্রশ্ন ওঠা খুব জরুরি যে সি পি আই (এম) গত ৫৫ বছরে বামপন্থার নামে যা চালিয়েছে, সেটাকে আদৌ বামপন্থা বলা যায় কি !১৯৬৪ সালে সি পি আই ভেঙ্গে সি পি আই (এম) গঠিত হয়েছিল।
সি পি আই (এম)-এর পার্টি কর্মসূচির ১১২ নং ধারায় বলা হয়েছিল,
“বর্তমান শাসকশ্রেণীগুলিকে ক্ষমতাচ্যুত করে শ্রমিক-কৃষকের দৃঢ় মৈত্রীর ওপর প্রতিষ্ঠিত জনগনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার স্থাপনের কর্তব্যকে সামনে রেখেও পার্টি যদি এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় যে, কোনো অঙ্গরাজ্যে জনগণের আশু সমস্যাবলী প্রশমনের এক বিনম্র কর্মসূচিতে অঙ্গীকারবদ্ধ এক সরকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ রয়েছে, তাহলে পার্টি নিশ্চয়ই সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে। অবশ্যই এই ধরনের সরকার জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যাবলী মুলগতভাবে সমাধান করবে না”।
ওই কর্মসূচির ১১৩ নং ধারায় বলা হয়েছিল রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষকের দৃঢ় মৈত্রীর ভিত্তিতে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করার কথা। সি পি আই ভেঙে সি পি আই (এম) গঠনের সময় তাদের কর্মসূচিতে চালু শোষণমূলক ব্যবস্থাটির আমূল পরিবর্তন, শ্রমজীবী জনগণের নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম ইত্যাদি বিপ্লবী কর্তব্যের উল্লেখ ছিল। তারসঙ্গেই তারা এনেছিল অঙ্গরাজ্যে অন্তর্বর্তীকালীন চরিত্রের সরকার গঠন করে জনগণকে রিলিফ দেওয়ার কর্মসূচি।
বোঝা প্রয়োজন কীভাবে তারা একমাত্র বিষয় করে তুলল যেকোনো মূল্যে সরকারী ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার কাজটিকে। সিপি আই(এম) পরিচালিত সরকারী বামপন্থার দৈন্য ক্রমশ প্রকাশ পায় ১৯৯১ পরবর্তী নয়া নীতির প্রয়োগের যুগে । মুখে এই আর্থিক নীতির তীব্র বিরোধিতা করলেও বাস্তবত এই নীতির কাছে আত্মসমর্পন করে সিপি আই(এম)।
২০০২ সালের ১৩ জুলাই প্রমোদ দাশগুপ্ত স্মারক বক্তৃতায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেন, “আমাদের মৌলিক লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আমাদের এই ধরনের সরকার গড়ার সুযোগ এলে আমরা তা করব। মানুষকে কিছু রিলিফ দিতে পারলে আমরা রিলিফ দেব। কিন্ত মনে রাখতে হবে, এটা কোনো মৌলিক সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। এবং নিরন্তর মূল লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়াই হবে আমাদের কাজ”(জোর আমাদের)।
এখানে দুটো কথা বলা হচ্ছে—প্রথমটা, রিলিফ দেওয়া আর দ্বিতীয়টি হল, মূল লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। আমাদের বোঝা প্রয়োজন, কীভাবে মূল লক্ষ্যকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে আর ‘রিলিফ দেওয়া’র কর্তব্যটি পরিবর্তিত হয়েছে চালু শোষণমূলক ব্যবস্থায় যে কোনও মূল্যে দীর্ঘস্থায়ীভাবে সরকার চালানোর এক ও একমাত্র ভূমিকায়। সেই লক্ষ্যে ১৯৯৪ সাল থেকে শুরু হয়েছে নয়া শিল্পনীতি-কৃষিনীতি-স্বাস্থ্যনীতি-শিক্ষানীতি প্রভৃতি নতুন নীতি বানানোর কাজ। এর মূল কথা হল, নয়া আর্থিক নীতি, নয়া উদারনীতি, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের যুগে নিজেদের ‘যুগোপযোগী’ করে তোলা। নিজেদের ‘সীমিত ক্ষমতা’কে দেশি-বিদেশি বৃহত পুঁজিপতিদের মুনাফার স্বার্থে পুর্নাঙ্গ করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করল সিপি আই(এম)।
২০০০ সালে অনুষ্ঠিত তিরুবন্তপুরম বিশেষ পার্টি সম্মেলনে সর্বসম্মতভাবে ১১২ নং ধারাকে সংশোধন করা হল। নতুন ধারার নাম হল ৭.১৭। তাতে বলা হল, “জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার গঠনের কর্তব্যকে সামনে অবিচল রেখেও যদি পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে, জনগণের সমস্যাবলী প্রশমনের এক কর্মসূচিতে অঙ্গীকারবদ্ধ কোনও সরকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ আসে, তাহলে পার্টি তেমন সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে ও বর্তমান সীমাবদ্ধতার মধ্যে বিকল্প নীতিগুলোকে তুলে ধরার ও প্রয়োগ করার চেষ্টা করবে”। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, কর্মসূচির ১১৩ নং ধারাটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হল।
সিপি আই (এম) নেতা নিরূপম সেনের কলমে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাদের চলার পথ,
“সপ্তম কংগ্রেসে গৃহীত কর্মসূচিতে যেখানে আশু রিলিফের কথা বলা হয়েছিল তার পরিবর্তন ঘটিয়ে বর্তমান কর্মসূচিতে সমস্যাবলী প্রশমনের লক্ষ্যে সীমাবদ্ধতার মধ্যেও একটি বিকল্প নীতি তুলে ধরা ও প্রয়োগ করার কথা বলা হয়েছে”।
এই পরিবর্তনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উপলব্ধি করা দরকার। এর অর্থ দাঁড়ালো, এখন থেকে আর অঙ্গরাজ্যে ‘রিলিফ’ দেওয়ার সরকা্র গড়া নয়, ‘সমস্যাবলী প্রশমনে’র লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকারে যাওয়ার চেষ্টা করা হবে। অবশ্য নয়া কর্মসূচিতেও এই অলঙ্কার কারাত সাহেবরা জুড়েছেন যে ‘জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার স্থাপনের কর্তব্যকে সামনে অবিচল রেখেও’!কীভাবে যে অবিচল রইলেন সেটা ৫০ বছরেও বোঝা গেল না!সিপি আই(এম) বিপ্লবী বামপন্থাকে পরিত্যাগ করে সরকারী বামপন্থায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার যে বৃত্তটি ১৯৬৭ সালে রচনা করা শুরু করেছিল, তা ২০০০ সালের এই ঘোষণার মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ হল।
ফলতঃ শেষ ১০ বছরে সিপিআই(এম) – এর চলার মধ্যে কোনও সংশয় ছিল না। বর্তমান শোষণমূলক (??) ব্যবস্থায় তাদের পরিচালিত সরকারের বিকল্প কর্মসূচি যে কোনোভাবেই সমাজতান্ত্রিক হতে পারে না, বরং তা যে ধনতন্ত্রের নিয়ম মেনেই চলবে–একথা সিপি আই(এম)-এর তাত্ত্বিক নেতারাই বারংবার বলেছেন। মনে রাখা প্রয়োজন, ১৯৯১ সালে মনমোহন সিং-দের উদ্যোগে এদেশে নয়া অর্থনৈতিক নীতি চালু হয়। ১৯৯২ সালেই সিপিআই(এম)-এ আলোচনা শুরু হয়ে যাচ্ছে বর্তমান শোষণমূলক ব্যবস্থায় শুধু রাজ্য সরকার নয়, কেন্দ্রেও সরকার গঠন করতে হবে। ১৯৯৪ সালে পশ্চিমবঙ্গে ‘বিকল্প শিল্পনীতি’র নামে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে বেসরকারী বৃহৎ পুঁজিকে স্বাগত জানান হচ্ছে এরাজ্যে। ১৯৯৭ সালে এরাজ্যের শিল্প পুনর্গঠন সম্পর্কে মতামতের জন্য মার্কিন বহুজাতিক সংস্থা ম্যাকিনসেকে তারা দায়িত্ব দিয়েছে। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী শিল্পে শ্রমিকসংখ্যা কমানোর জন্য কারখায় কারখানায় জোর করে ভি আর এস করাতে সিটু-পার্টি সবাই মিলে নেমেছে। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সরকারী সংস্থা ডি এফ আই ডি থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে। রাজ্য সরকার পরিচালিত কারখানাগুলোকে কার্যতঃ তুলে দেবার জন্য সেই টাকায় শ্রমিক-কর্মচারীদের ভি আর এস করানো হয়েছে। ২০০২ সালে আবারো ম্যাকিনসেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটানোর প্রস্তাব দেওয়ার জন্য। তাদের পরামর্শে দেশি-বিদেশি বৃহত পুঁজির মুনাফার স্বার্থে প্রচলিত খাদ্যশস্যের বদলে অর্থকরী ফসলের চাষ, চুক্তি চাষ , কর্পোরেট চাষ ইত্যাদি সহ নয়া কৃষিনীতি চালু করে সিপি আই(এম) বুঝিয়ে দিয়েছে নিজেদের স্বরূপ। দীর্ঘস্থায়ীভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রয়োজনে কীভাবে মালিকশ্রেণীর পক্ষে দাঁড়াতে হয় সি পি আই (এম) তা দেখিয়ে দিয়েছে।
তারা ২০০৩ সালে রাজ্য বিধানসভায় প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে পাশ করিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ আর্থিক অঞ্চল বিল(এসইজেড বিল)২০০৩। এই বিলে বিশেষ আর্থিক অঞ্চলগুলি সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ‘যেন এটি একটি বিদেশি ভূখন্ড’(২এ ধারা)। এই বিলে আরও বলা হয়েছিল, ‘এস ই জেডের সমস্ত নির্মাতা ও সংস্থার ওপর তদারকির ক্ষেত্রে কেবলমাত্র বানিজ্যিক স্বার্থই বিবেচিত হবে’। এই বিলে রাজ্যের সমস্ত এস ই জেডের ক্রয়-বিক্রয়কে কর, শুল্ক ও সেসমুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। সিপি আই (এম)-এর বানানো এই মডেল অনুসরণ করে ২০০৫ সালে তাদের সমর্থিত কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার গোটা দেশের জন্য প্রণয়ন করল এস ই জেড আইন, ২০০৫। তাই ২০০৬ সালে সিঙ্গুরে টাটাদের জন্য জোর করে জমি কেড়ে নেওয়া, ২০০৭ সালে সালিমদের জন্য নন্দীগ্রামে জমি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা, ২০০৮ সালে জিন্দালদের জন্য শালবনীতে এস ই জেডের জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সিপি আই(এম)-এর উদ্যোগগুলোকে আমাদের বিচ্ছিন্নভাবে দেখা উচিত নয়। এই ভূমিকাগুলো একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অবস্থানেরই পরিনতি।
২০০৪ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন বলেন, “আমাদের সংস্কারবিরোধী তকমা দেওয়া অনুচিত। আমি এটা পরিস্কার বলে দিতে চাই যে আমরা সংস্কারের পক্ষে। আমরা এটা বুঝি যে অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাওয়ার পরে আর পেছনে ফেরা যায় না। যেটা আমরা চাই তা হল সংস্কারের যেন একটা মানবিক মুখ থাকে”।
২০০৫ সালে সি আই আই সামিটে বুদ্ধবাবু বলেন, “যান এবং দুনিয়াকে জানান আমরা পাল্টাচ্ছি। আমরা মার্ক্সবাদীরা মূর্খ নই যে পুরনো সেকেলে ধারনাগুলোকে আঁকড়ে থাকব। পশ্চিমবাংলায় বাম হল ডান।”
সৌভিক বসু