পাঁচটা বলতে তিনি পাঁচটাই বুঝতেন, এক্কেবারে ফেলুদার মতো। খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাপন পুরোটাই ছিল তাঁর সাহেবিয়ানায় মোড়া। সাহেবদের মতোই তিনি ঘড়ির কাঁটায় বেঁধে ফেলেছিলেন জীবন। ছবিতে তাঁর সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের মুখে শুনেছি, তিনি আট ঘন্টার বেশি শ্যুটিং করতেন না। হাজির হতেন একেবারে ঘড়ি ধরা সময়ে, বেরিয়ে যেতেনও সেভাবেই। শ্যুটিং বাকি থাকলেও কোন অজুহাত বা অনুরোধে কাজ হতো না। হয়তো তাঁর শ্যুটিং তখনও বাকি আছে অথচ ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে আট ঘন্টার দিকে। তখন তিনি বারে বারে ঘড়ি দেখতেন আর তাঁর সেই জলদগম্ভীর স্বরে মেকআপরুম থেকেই ইউনিটের উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়তেন, ‘ওয়ান আওয়ার টু গো ! হাফ এ্যান আওয়ার টু গো!’–এরকম। হয়তো আট ঘণ্টা পুরো হতে তখন আর দশটা মিনিট বাকি আছে, তাঁকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হল ফ্লোরে। ডিরেক্টার সিনটা টেক করার আগে একটা রিহার্সাল করিয়ে পজিশন কম্পোজিশন সব ঠিক করলেন, আর ঠিক তখনই হয়তো আট ঘণ্টা শেষ! অমনি উৎপল দত্ত বলে উঠতেন, ‘নাও টাইম টু গো!’ এবং বলেই হনহন করে বেরিয়ে যেতেন সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে। সময় নিয়ে বাতেলাপ্রিয় বাঙালির ভ্যানতাড়ামো একদম পছন্দ করতেন না তিনি। আর এতটা সময়নিষ্ঠ ছিলেন বলেই থিয়েটার-সিনেমায় অভিনয়, সিনেমা পরিচালনা, নাটক লেখা, যাত্রাপালা লেখার হাজার ব্যস্ততার মাঝেও বিশ্বসাহিত্য পাঠের অবসর বের করে নিতে পারতেন। তাঁর মতো পণ্ডিতমানুষ বাংলায় তখনো কম ছিলেন, এখন আরও কম আছেন।
পাঁচের দশকে উৎপল দত্ত ছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সেন্ট্রাল স্কোয়াড-এর দায়িত্বে। এইসময় তিনি অভিনেতাদের কাছে প্রস্তাব দিলেন স্টেজে রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটক নামানোর। এই স্কোয়াডে তখন অভিনেতা হিসেবে ছিলেন কালী ব্যানার্জি, ঋত্বিক ঘটক, উমানাথ ভট্টাচার্য, শোভা সেনের মতো মানুষেরা। সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক হল ‘বিসর্জন’ নাটকই হবে এবং রিহার্সাল হবে ৪৬ নং ধর্মতলা স্ট্রিটে, দুপুর বেলা। সবাইকে চরিত্র বুঝিয়ে দিয়ে এক একটা বই ধরিয়ে পাঠ মুখস্থ করে হাজির হতে বললেন রিহার্সাল শুরুর দিন। তাঁর নির্দেশ মানে, বেদবাক্য। মানতে সবাই বাধ্য।
রিহার্সাল শুরুর দিন সবাই তাই পাঠ মুখস্থ করে হাজির। তখন উৎপল তাঁদের সামনে দাবার ছক পেতে ঘুঁটি সাজিয়ে বসলেন। সবাই অবাক, এ দিয়ে হবেটা কি! এখন রিহার্সালের সময় খেলা হবে নাকি! একটু পরই সবার ভুল ভাঙল। তাঁরা বুঝতে পারলেন, এটাই আসলে উৎপলের মঞ্চ আর ঘুঁটিগুলো এক একটি চরিত্র। সে এক দেখার মতো জিনিস, অভিনব এক পদ্ধতি! অভিনেতারা নিজের নিজের সংলাপ মুখস্থ বলে যেতে লাগলেন আর উৎপল এক একটি ঘুঁটি চেলে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন কোন চরিত্র কোন দিক দিয়ে ঢুকবেন, কোথায় এসে দাঁড়াবেন, কতটা এগোবেন–এভাবে পুরো কম্পোজিশন তৈরি হয়ে গেল। প্রতিটি অভিনেতাকে সেই ঘুঁটির চাল মাথায় রেখে মঞ্চে নামতে হয়েছিল। মনে না রেখে কারও উপায় নেই, একটু এদিক ওদিক হবার জো নেই; মেজাজী মানুষ উৎপল দত্ত ভুল একদম বরদাস্ত করতে পারতেন না। বকুনির চোটে একেবারে ভুত ভাগিয়ে ছাড়তেন। তবে এর মধ্য দিয়ে যখন তা মঞ্চস্থ হল, তখন ‘বিসর্জন’ হয়ে উঠল যেন সুপরিকল্পিত সুসংহত এক চলচ্চিত্র! সে এক অপূর্ব প্রযোজনা! যাকে বলে কালজয়ী। আর এই সুপরিকল্পিত প্রযোজনা সম্ভব হয়েছিল উৎপল দত্তের অভিনব উদ্ভাবনী ক্ষমতা, কড়া এবং খুঁতখুঁতে সাহেবি মেজাজের জন্যই।
উৎপল দত্তের আর একটি সাহেবিয়ানার পরিচয় দেব, অভিনেতা চিন্ময় রায়ের স্মৃতিকথা ‘গল্প হলেও সত্যি’ থেকে–
‘দুই ভাই’ ছবির আউটডোর শ্যুটিং চলছে ডায়মন্ডহারবারে। এই ছবির অভিনেতা চিন্ময় রায়, সন্তু মুখোপাধ্যায়, দীপঙ্কর দে, সুমিত্রা মুখার্জি আর উৎপল দত্ত একই ফ্লোরের পাশাপাশি ঘরে একটি হোটেলে রয়েছেন। একদিন সকালে হঠাৎ উৎপল দত্তের ঘর থেকে ভেসে এলো দুমদাম কাঁচের বাসন ভাঙার আওয়াজ। সেই আওয়াজে হোটেলের সবাই ছুটে গেল। অভিনেতারা ছুটে গেলেন। প্রযোজক ছুটে গেলেন। ঘরময় তখন ছড়িয়ে রয়েছে ভাঙা কাঁচের অজস্র টুকরো। প্রযোজক জানতে চাইলেন, কি হয়েছে উৎপলদা? উৎপল দত্ত শান্ত গলায় বললেন, ‘আটটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে খাবার চেয়েছি। এখন নটা দশ—দে আর লেট, সো আই থ্রো ইট।’ প্রযোজক বললেন, ‘ঠিক করেছেন। বাকিটা আমি দেখছি।’ প্রযোজকের এই সামান্য কথাতেই সেদিন ফুটে উঠেছিল ডিসিপ্লিনড একজন মানুষ এবং ডিসিপ্লিনড একজন শিল্পীর প্রতি অসীম ও অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।