এখনও পর্যন্ত ৩১৫ জন মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। ভারতবর্ষ এখন করোনা সংক্রমণের তৃতীয় স্তরের দিকে। সংক্রমণের প্রথম সপ্তাহে একজন বা দু’জনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সংস্পর্শে রোগ ছড়ায়। দুই থেকে তিন সপ্তাহে পরিবারের সদস্য আর প্রতিবেশীদের মাধ্যমে ছড়ায় সংক্রমণ। তৃতীয়-চতুর্থ সপ্তাহে ব্যপক ভাবে সারা সমাজে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তৃতীয় সপ্তাহটা সংক্রমণের শৃঙ্খল ভেঙে দেওয়ার জন্য আদর্শ।
এই ‘ব্রেক দ্য চেন’ পদক্ষেপে যদি ভারত জিতে যায়, তবে আর আমাদের চতুর্থ স্তরে যাওয়ার দুর্ভোগ সইতে হবে না। প্রধানমন্ত্রীর বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে। সোশাল ডিস্টেন্স বাড়ানো তথা সামাজিক মেলামেশা কমানো আর জনতা কার্ফু ওই বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কমিটিরই নিদান। তাই আজ ২২ মার্চ সংক্রমণের তৃতীয় সপ্তাহের শেষ দিন ধরে সকাল ৭ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত ঘরের ভিতরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
আজকের ভারতবর্ষ এই বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত সহজভাবে নেবে এটাই ছিল আশা। মানুষের সামনে আজ বড় দুঃসময়। এই দুঃসময়ে সংযম প্রয়োজন। আত্মপ্রতিষ্ঠার লোভ সম্বরণ করা দরকার। প্রতিহিংসা বা প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসা একান্ত কাম্য। বিষয়টি একটি সংবেদনশীল চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাপার। চিকিৎসা বিজ্ঞানে দীর্ঘ সময় প্রশিক্ষণের পরে একজন চিকিৎসক তৈরি হন। আজকের এই ভীষণ পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে সব ডাক্তারবাবু, নার্স, হাসপাতাল কর্মী কাজ করছেন তাঁরা প্রশংসার যোগ্য। বেলেঘাটার আইডি হাসপাতাল, এসএসকেএম হাসপাতালের মতো সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারবাবু ও অন্য স্বাস্থ্য কর্মীরা দিন রাত এক করে কাজ করছেন। কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে একজন কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী ভর্তি হয়েছেন। সেই হাসপাতালের এক পরিচিত দিদির সঙ্গে কথা বলে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গেল। কর্তব্য এড়িয়ে যাওয়া নয়, অভিযোগ করা নয়, দায়িত্ব এর ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া নয়, অক্লান্ত ভাবে কাজ করছেন ডাক্তারবাবু থেকে হাউজ কিপিং দিদি সকলে।
নিজে ডাক্তার না হয়ে করোনারোগের উপশমের দাওয়াই বাতলানো এই চিকিৎসা-পরিবারের সব সদস্যকে অপমান করা। রাজনীতি যাঁরা করেন সমাজে তাঁদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু কেউ তাঁদের কাছে ডাক্তারি নিদান আশা করেন না। প্রত্যেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বড় সমর্থক দল রয়েছে, এর মধ্যে বিজ্ঞানমনস্ক ও বাস্তববুদ্ধি মানুষ রয়েছেন। এই সংকটের মুহূর্তে চিকিৎসার ব্যাপারে তাঁদের প্রিয় নেতা বা নেত্রীর বক্তব্য তাঁদের লজ্জিত করে। রাজনৈতিক ভাবে সবথেকে অবৈজ্ঞানিক আচরণ হয়েছে, স্কুল পড়ুয়াদের মিড ডে মিল বিতরণের বিষয়টি। শনিবার রাজ্য সরকারের পক্ষে জেলা বিদ্যালয়ের পর্যবেক্ষক সবকটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে এক নির্দেশ পাঠিয়েছেন। নির্দেশে বলা হয়েছে যে শনিবার রাত ১০ টা পর্যন্ত ও রবিবার ২২ মার্চ মিড ডে মিলের চাল ও আলু সরবরাহ করা হোক। এবং বিতরণের রিপোর্ট ওই দুই দিন বিকেল তিনটের মধ্যে জেলায় পাঠানো হোক। অর্থাৎ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, অভিভাবকরা এ দিন জনতা কার্ফু ভঙ্গ করে ছোটাছুটি করবেন। মিড ডে মিল পরিষেবায় বাংলায় অসাধু চক্র জড়িত বলে মাঝে মধ্যে অভিযোগ ওঠে। অর্থাৎ সে রকম সত্যিই থাকলে সেই সব লোকজনও জনতা কার্ফুর মধ্যেই ছোটাছুটি করবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮০ সালে পৃথিবী থেকে স্মল পক্স বিলুপ্তির কথা ঘোষণা করেছিল। মূলত মানুষের অসচেতনতা আর রাজনৈতিক অসহযোগিতার জন্যই হু-র এ কাজে ১৩ বছর সময় লেগেছিল,– ১৯৬৭ থেকে শুরু করে তা শেষ হয়েছিল ১৯৮০ সালে।
জনতা কার্ফু প্রয়োজন ছিল ব্রেক দ্য চেন অর্থাৎ সংক্রমণের ধারাকে ভেঙে ফেলার জন্য। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য আমাদের রাজ্যে এই প্রয়াস সম্পূর্ণ ভাবে সফল করা গেল না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হয়তো এতোটুকুই পাবে। আজকের বর্তমান ভবিষ্যতে ইতিহাস হবে।
তবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুঃসময়’ কবিতা থেকে বলতে ইচ্ছা করে—‘ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনই অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা’।
মতামত লেখকের নিজস্ব
জিষ্ণু বসু :
লেখক সাহা ইনস্টিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এ কর্মরত।