রবীন্দ্রনাথের “দুই বিঘা জমি” এবং বাস্তবের “বাবু” ও “উপেন”

“শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভু়ঁই আর সবই গেছে ঋণে
বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে।’…
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুচর্চিত উপরোক্ত “দুই বিঘা জমি” কবিতার প্রেক্ষাপট খুঁজতেই আজকের এই আলোচনা। রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath) অনেক রচনারই বাস্তব প্রেক্ষাপট আছে এবং তিনি তাঁর “ছিন্নপত্র”-এ সে সবের কিছুটা তুলে ধরেছেন।
“দুই বিঘা জমি”-র বাস্তব পটভূমি হলো বতর্মান বাংলাদেশের শিলাইদহ। এই শিলাইদহেই ছিল রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক জমিদারি এবং বহু লেখাই তিনি এখানে বসে লিখেছেন। এই শিলাইদহ পল্লীতেই থাকতেন “দুই বিঘা জমি”-র “বাবু” ও “উপেন।”
কিন্তু তার আগে আসুন, আমরা গ্রামটার সঙ্গে পরিচিত হই। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,
“রাখি হাটখোলা, নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে,
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে ।”

সেকালে শিলাইদহ গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে ভেতরে আসতে গেলে “হাটখোলা, নন্দীর গোলা, মন্দির” এসবগুলি পেরিয়েই আসতে হতো। হাটখোলা হলো শিলাইদহের কুঠির হাট। বতর্মানে এ স্থানটি আর নেই, পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
আর “নন্দীর গোলা” হলো শিলাইদহের বিখ্যাত লালনচন্দ্র নন্দীর গোলা, যার অবস্থান ছিল গ্রামমুখো রাস্তার ধারেই এবং এরপরেই ছিল মন্দির। এই মন্দির হলো রাজা সীতারাম রায়ের আমলে তৈরি গোপীনাথ মন্দির। তখনও গোপীনাথদেবের মন্দির বাড়ির সিংহদরজা তৈরি হয়নি। তাই তখনও পর্যন্ত এই মন্দির গ্রামের কেন্দ্রস্থলের নিশানা ছিল।
অন্যদিকে, “দুই বিঘা জমি”-র দুই প্রধান চরিত্র “বাবু” ও “উপেন” আসলে শিলাইদহেরই রক্তমাংসের মানুষ। শিলাইদহের “বড়ো বাড়ি” বলে খ‍্যাত অধিকারী বাড়ির মেজকর্তা গুরুচরণ অধিকারী হলেন “দুই বিঘা জমি”-র “বাবু‌।” শিলাইদহের এই অধিকারী বাড়ি তখন ছিল গ্রামের মধ্যে ধনে-দাপটে অগ্রগণ‍্য। এই বংশের বড়কর্তা ছিলেন হরচন্দ্র অধিকারী আর মেজকর্তা গুরুচরণ। তুলনায় গুরুচরণ ছিলেন অতীব বুদ্ধিমান, বৈষয়িক ও প্রতিপত্তিশালী ব‍্যক্তি। গোটা গাঁয়েই প্রভুত্ব করতেন তিনি।
শিলাইদহের এই অধিকারী পরিবার ছিল রবীন্দ্রনাথের কাছে খুবই পরিচিত। এর কারণ, প্রথমত, তাঁর শিলাইদহের কুঠি-বাড়ি তৈরি হয়েছিল এই অধিকারীসহ গ্রামের আরও কয়েকজন গ্রামবাসীদের কাছ থেকে কেনা জমিতে।
দ্বিতীয়ত, এই অধিকারী বংশের অনেকেই ঠাকুর পরিবারের শিলাইদহ, সাজাদপুর ও কালীগ্রাম কাছারিতে চাকরি করেছেন ।

তৃতীয়ত, এই অধিকারী পরিবারের সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের মামলা-মোকদ্দমাও হয়েছিল এবং রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং একবার তাদের গাছ কাটা মোকদ্দমা আপীল হবার সময় আপোষে নিষ্পত্তি করে দিয়েছিলেন।
সুতরাং, রবীন্দ্রনাথ এই পরিবারের লোকজনদের খুব কাছ থেকেই দেখেছিলেন।
অন্যদিকে, “উপেন”-এর সঙ্গেও কবির দেখা হওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কারণ, রবীন্দ্রনাথ সে সময় তরুণ জমিদার হয়েও বিভিন্ন বাউল, বৈষ্ণব ও গৃহহীন ফকিরদের কাছে ডেকে তাদের গান এবং জীবন কাহিনী শুনতেন।
ফের অধিকারীদের কথায় আসি। জানা যায়, অধিকারীরা তাদের বাগানের আয়তন বাড়াতে আশেপাশের কয়েকজন গরীব গৃহস্থের বসতবাড়িকে সামিল করেছিলেন। অধিকারী পরিবারের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী মেজকর্তা গুরুচরণ অধিকারী তাদের ভদ্রাসন, পাকাবাড়ি, চণ্ডীমণ্ডপ, বৈঠকখানা, ভিন্ন ভিন্ন শরিকের বাড়ি ও বাগানের জন্য যে দু’তিনজন গরীব মালিককে উচ্ছেদ করেন, তাদের অন‍্যতম ছিল “দুই বিঘা জমি”-র মালিক যদু দত্ত। জমিদারি সেরেস্তার অতি পুরোনো জরিপী কাগজ ও চিঠিপত্রাদিতে এই যদু দত্ত’-র নাম পাওয়া গেছে। এই যদু দত্ত হচ্ছে “দুই বিঘা জমি”-র ছদ্মবেশী “উপেন।”
গুরুচরণ অধিকারী ছিলেন একটু বেশি বিলাসী। দেখতে সুপুরুষ এই মানুষটির পরণে থাকতো সাদা ধবধবে ধুতি, পায়ে চটিজুতো।
ধনী গুরুচরণকে প্রায়শই ঘিরে থাকতো তাঁর পাশা খেলার পারিষদবর্গ।
এছাড়া তাঁর বাড়ির নতুন পুকুরে ছিপ নিয়ে তিনি মাছ ধরতেও যেতেন শখ করে ।

এই গুরুচরণ অধিকারীর দালান বাড়ির পাশে বাগানের ধারে একটি খড়ের কুটিরে সস্ত্রীক বাস করতো যদু দত্ত। তার স্ত্রীর নাম ছিল—সখি বৈষ্ণবী এবং সে ছিল যদু্র কণ্ঠী বদল করা বৌ। যদু তার স্ত্রীকে আদ‍র করে “সখি সুন্দরী ” বলে ডাকতো।
গুরুচরণের কাছে যদুর সামান্য কিছু ঋণ ছিল। এরপর গুরুচরণ যদুকে আরও কিছু টাকা নিয়ে তাঁর বাগানের আয়তন বাড়াতে তার “দুই বিঘা জমি” ছেড়ে দিতে বলেন।
কিন্তু যদু রাজি হয়নি। সে বলেছিল,
“সজল চক্ষে করুণ রক্ষে গরীবের ভিটাখানি।”
কিন্তু গুরুচরণ তখন বৈষয়িক প‍্যাঁচে
“করিল ডিক্রী সকলি বিক্রী মিথ্যা দেনার খতে।”
এরপর যদু “সপ্ত পুরুষ যেথায় মানুষ” সেই “দুই বিঘা জমি” ছেড়ে সস্ত্রীক দেশে দেশে ঘুরতে লাগলো—
“সন্ন্যাসী বেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ‍্য।”
রবীন্দ্রনাথ যদুকে সমবেদনা জানিয়ে তাই দরদের সঙ্গে লিখলেন,
(বিধাতা )”তাই লিখি দিল বিশ্ব নিখিল, দু’বিঘার পরিবর্তে ।”

আর একটি কথা। শিলাইদহ অবস্থিত পদ্মাতীরে। কিন্তু হিন্দুর কাছে গঙ্গার গুরুত্ব বুঝে রবীন্দ্রনাথ এখানে পদ্মার জায়গায় “গঙ্গা” করেছেন। অবশ্য পদ্মাও গঙ্গাই।
সন্ন্যাসী হয়েও যদু তার “দুই বিঘা জমি”-র মায়া কাটাতে পারেনি। তাই বছর পনেরো-ষোল পর মাটির টানে সে আবার গ্রামে ফিরে এসেছিল এবং আম কুড়োতে গিয়ে গুরুচরণের উড়িয়া মালীর হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিল। ওই জায়গাটির নাম পরবর্তীকালে হয়ে যায়,”যদু দত্তর বাগান।”
গেরুয়া বেশে সাধু সেজে সস্ত্রীক যদু দত্ত তার “দুই বিঘা জমি” হারানো গ্রামে ফিরেছিল। তারপর গুরুচরণের কাছে লাঞ্ছিত হয়ে সে শেষে এই গ্রামেরই একটি বাড়িতে থাকতো আর গোপীনাথের প্রসাদ খেয়ে জীবন ধারণ করতো।
এভাবেই শেষ জীবন কেটেছিল রবীন্দ্রনাথের “দুই বিঘা জমি”-র গরীব উপেনের ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.