(ষষ্ঠ অধ্যায়ের পর)

সাত

আবার গোড়া থেকে আরম্ভ

দেখলাম আবার আমায় গোড়া থেকে যাত্রা আরম্ভ করতে হবে। গান্ধীবাদে আমার যে আস্থা ছিল তা শেষমেশ হার মেনেছিল মার্ক্সবাদের কাছে। কিন্তু এখন তো আমি আর মার্ক্সবাদীও রইলাম না। এখন যে প্রশ্নটা বারবার আমার মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগল সেটা হচ্ছে : এবার আমার গতি কী হবে?

ব্যবহারিক জীবন মতাদর্শের শরণাপন্ন হবার অপেক্ষা রাখে না, মতাদর্শ ছাড়াই তা ভালোই চলতে পারে। লোকে খায়-দায়, সন্তান উৎপাদন করে, ঘুমোয়, জীবিকা নির্বাহ করে। লোকে বইপত্র কিংবা খবরের কাগজ পড়ে, আড্ডা মারে, সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর উপর দায়সারা ভাবে টীকাটিপ্পনী কাটে আর তারপর সেসব ঘটনা বেমালুম ভুলেও যায়। লোকে ঘর-সংসার, চাকরিবাকরি, বন্ধুবান্ধব নিয়ে থাকে; অবসর সময় কাটানোর জন্য দু-একখানা শখও রাখে। তারপর ক্রমে বার্ধক্য গ্রাস করে, স্বাভাবিক নিয়মেই লোকে রোগব্যাধিতে জর্জরিত হয়ে পড়ে; আর তখন তারা নিজেদের যৌবনের কথা ভেবে, যখন শরীরে উদ্দীপনা এবং বল ছিল সেই সময়কার কথা ভেবে হা-হুতাশ করে। আমাদের মতো সামান্য, নশ্বর জীবেদের অধিকাংশের কাছে এই তো হচ্ছে মনুষ্যজন্মের সামগ্রিক চিত্র। কী ঘটছে, কেন ঘটছে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা না ক’রেই আমরা আমাদের সাফল্য-ব্যর্থতা, পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদিকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে ফেলি।

আমি চিরকালই একজন সামান্য ব্যক্তির মতো জীবন কাটিয়ে এসেছি, আমার আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলিও নিতান্ত মামুলি। যদি নিজের মতো ক’রে চলতে পারতাম, তাহলে আমিও আর পাঁচজন সামান্য মানুষের মতোই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতাম। ততদিনে আমি একজন সফল বিজ্‌নেস এগজিকিউটিভ; রপ্তানির ব্যবসায় ভালোই হাত পাকিয়ে ফেলেছি। ঐ রাস্তায় আমি আরো সাফল্য পেতে পারতাম। হয়তো কলকাতার কোনো লাখপতি ব্যবসায়ী আমাকে তার ব্যবসার অংশীদারিত্ব গ্রহণ করতে আহ্বান জানাত, হয়তো আমিও কিছুকাল পরে লাখ লাখ টাকা অর্জন ক’রে ফেলতে পারতাম। আমাকে নিয়ে আমার বাবা এরকমই একটা স্বপ্ন দেখতেন। তিনি এমন বেশ কিছু মানুষকে চিনতেন যাঁদের শুরুটা হয়েছিল দারিদ্র্যের মধ্যে, কিন্তু নিজস্ব প্রতিভাবলে যাঁরা কালক্রমে অত্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের সহযোগী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন। অথবা এর উল্টোটাও আমার জীবনে ঘটতে পারত। হয়তো ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে আমার যা প্রকৃত মূল্যায়ন হওয়া উচিত, আমি তার অতিরিক্ত হিসেব ক’রে বসতাম; তারপর চূড়ান্ত রকমের ব্যর্থ হতাম, আর বাকি জীবনটা হয়তো তাদেরকে শাপশাপান্ত ক’রেই কাটিয়ে দিতাম যাদের ষড়যন্ত্রের ফলে আমার ওইরকম দুর্ভাগ্য ঘটেছে। কলকাতায় আমি এই ধরণের বেশ কিছু হতভাগ্য চরিত্রের দেখা পেয়েছিলাম।

কিন্তু তেমনটা হবার ছিল না, কারণ আমি ইতিমধ্যেই এমন একজন মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলাম যে আমার ভাগ্য কিছুতেই ঐ পথে চালিত হ’তে দিত না। সেই মানুষটি হচ্ছে রাম স্বরূপ। মিথ্যা আত্মগরিমা এবং অবক্ষয়ী আত্মকরুণা – এই দুই চোরাবালিতে তলিয়ে যাবার হাত থেকে সে আমায় উদ্ধার করবার সবরকম চেষ্টা করেছিল। অনাসক্ত হয়ে মহত্তর আদর্শ এবং বৃহত্তর উদ্দেশ্যে কাজ করবার জন্য সে আমায় সময়মতো সঠিক উপদেশ এবং উৎসাহ দিত। তার চিন্তা-আদর্শ, ধ্যানধারণা, এবং সমাজকল্যাণের লক্ষ্যে তার ভাবনাচিন্তা – এসমস্তই আমার নিজস্ব চিন্তাভাবনার সঙ্গে খাপ খেয়ে যেত ব’লে তার নির্দেশমতো কাজ করতে আমার মনে কোথাও এতটুকু দ্বিধা জাগত না।

সে এবার আমায় একটি গোষ্ঠীতে যোগ দিতে আহ্বান জানালে, যেখানে আমরা সকলে তার ঐ মূল্যবোধগুলির সঙ্গে একমত ছিলাম। সেই সময়ে কালক্রমে ভারতের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডল কমিউনিস্ট ধ্যানধারণায় ছেয়ে গিয়েছিল। সোভিয়েত রাশিয়া, কমিউনিস্ট চীন এবং সোভিয়েত সৈন্যদের দ্বারা অধিকৃত ও সোভিয়েতের ক্রীড়নক স্বৈরাচারী শাসকদের দ্বারা শাসিত পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে স্বর্গরাজ্য নেমে এসেছে এই দাবী ক’রে নানান সব আজগুবি গল্প এবং মিথ ছড়ানো হয়েছিল। এইসব অলীক কাহিনী ব্যবহার ক’রে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদেরকে ভারতে একটি সুস্থ সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন করবার অগ্রদূত হিসেবে জাহির করত। কমিউনিস্ট ধ্যানধারণার প্রচলন হওয়াতে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সুবিধে হচ্ছিল। তাদের চরম লক্ষ্য ছিল ভারতীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটিকে উৎখাত ক’রে ভারত রাষ্ট্রকে সোভিয়েতের হাতের পুতুলে পরিণত করা।

আমরা প্রধানতঃ যে কাজটির দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম তা হচ্ছে কমিউনিস্ট ধ্যানধারণা কীভাবে মানুষের স্বাধীনতা, জাতীয় ঐক্য, সমাজের স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক উন্নতি, এবং আমাদের জাতির চরিত্রগত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবিধতার পরিপন্থী সেইটে তুলে ধরা। সেইসঙ্গে কমিউনিস্ট দেশগুলির অবস্থা সম্পর্কে যেসব অলীক কাহিনী ছড়ানো হচ্ছিল সেগুলির অসারতা তুলে ধরা, যাতে আমাদের দেশের জাতীয়তাবাদী এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলি এই দেশগুলির প্রকৃত রূপটি চিনতে পারে; যে রূপটি হচ্ছে সর্বগ্রাসী স্বৈরাচারী নিপীড়কের, যেখানে জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত খারাপ এবং যেখানকার সমাজ ও সংস্কৃতি কঠোর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ঘেরাটোপে আবদ্ধ। কমিউনিস্টদের নিজেদেরই প্রকাশিত তথ্য ও পরিসংখ্যান উদ্ধৃত ক’রে আমরা কমিউনিস্ট শাসনের আওতায় থাকা দেশগুলির প্রকৃত সত্যটি তুলে ধরবার কাজ করতাম।

আমাদের আশা ছিল যে আমাদের তুলে ধরা তথ্যগুলি হাতে পেয়ে এদেশের জাতীয়তাবাদী এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলি কমিউনিজ্‌মের অশুভ চরিত্রটি উপলব্ধি করতে পারবে এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ষড়যন্ত্রমূলক উদ্দেশ্যটি ধরতে সক্ষম হবে। আখেরে এই রাজনৈতিক দলগুলিকেই তো রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দানে এই অশুভ শক্তি এবং বিদেশী স্বার্থ কায়েম করবার হাতিয়ারগুলিকে পরাস্ত করতে হবে। আমাদের কাজকর্ম খানিকটা হলেও উপযোগী হয়েছিল। কয়েকজন সাংসদ, ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ এবং রাজনৈতিক পরিসরে সক্রিয় কিছু কর্মী আমাদের তুলে ধরা তথ্যাবলী হাতিয়ার করেই কমিউনিস্টদের দলবলকে কড়া আক্রমণের মুখে ফেলে দিয়েছিল। কয়েকজন সাংবাদিক এবং চিন্তাবিদ আমাদের কাজকর্মকে স্বাগত জানালেন এবং আমাদের লড়াইটি চালিয়ে যেতে সাহায্য করলেন। এঁদের মধ্যে একজন আমাদের প্রশংসা ক’রে বলেছিলেন যে কমিউনিজম-বিরোধিতাকে আমরা ভারতীয় রাজনীতির পরিসরে একটি দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি।

কিন্তু ক্রমে আমরা বুঝতে পারলাম যে নিজেদের জন্য যে সীমিত ভূমিকা আমরা নির্ধারণ ক’রে রেখেছিলাম, আমাদের সহমর্মীরা আমাদের কাছ থেকে তার চাইতে অনেক বেশি প্রত্যাশা রাখেন। সমাজবাদীরা, যারা কমিউনিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের সবচাইতে বড় সহযোদ্ধা ছিল, তারা চাইত আমরা যেন আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের সংগ্রামে অবতীর্ণ হই। মতাদর্শগত প্রশ্নে অধিকাংশ কংগ্রেসি নেতার হয় কোনো সুস্পষ্ট অবস্থান ছিল না, নয়তো তারা চাইত যে আমরা যেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করি। ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বলতে তারা বোঝাত আরএসএস এবং ভারতীয় জনসঙ্ঘ (বিজেএস)-কে, যাঁরা কিন্তু বরাবর আমাদের কাজকর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল, বন্ধুভাবাপন্ন এবং সহযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ ক’রে এসেছেন। এঁরা চাইতেন আমরা যেন সর্বদা ভারতের জাতীয় স্বার্থকে সমস্তকিছুর ঊর্ধে রেখে চলি। ওঁদের কথা আমরা ধৈর্য ধ’রে শুনতাম, আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলির কথা ওঁদেরকে জানাতাম, জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে পরস্পর বৈরিভাব থাকলে তা হ্রাস করবার চেষ্টা করতাম, এবং কমিউনিস্টদের ষড়যন্ত্রটির আন্তর্জাতিক চরিত্রটির দিকে ওঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতাম।

কমিউনিজ্‌মের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই যতই এগোতে লাগল, আমি ততই স্পষ্ট ক’রে উপলব্ধি করতে শুরু করলাম যে কমিউনিজ্‌মকে ঠেকাতে হ’লে একটি ইতিবাচক মতাদর্শের অবলম্বন অত্যন্ত প্রয়োজন। কিন্তু কী হবে সেই মতাদর্শ? গণতন্ত্র? গণতন্ত্র তো আমাদের সমাজে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট রয়েছে। কিন্তু একমাত্র কমিউনিস্টরাই গণতন্ত্রের সদ্ব্যবহার ক’রে শেষমেশ এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটিকেই উৎখাত করবার চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে। তাহলে কী সমাজবাদকে অবলম্বন করা উচিত? আমরা অবশ্য ইতিমধ্যেই সমাজবাদকে আমাদের রাষ্ট্রনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছি। কিন্তু কমিউনিস্টরা সমাজবাদের পরিভাষাকে গুলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে, যার ফলে সমাজবাদ একটি সতত প্রসারণশীল সরকারী ক্ষেত্রের সঙ্গে সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে; উপরন্তু এই ক্ষেত্রটি হচ্ছে চূড়ান্ত অকর্মণ্য এবং ভয়ঙ্কর রকমের দুর্নীতিগ্রস্ত। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ হ’তে মুক্ত বেসরকারি উদ্যোগ? কিন্তু সে তো অনেকের কাছেই স্রেফ পুঁজিবাদের নামান্তর, যে ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মুনাফার খাতিরে জনসাধারণকে লুটবার খোলা ছুট দেওয়া হয়ে থাকে। তদুপরি, বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ভারত না ছিল আমেরিকা, না ব্রিটেন কি জার্মানি অথবা ফ্রান্স, এমনকী জাপানও নয়, যে সে ঊনবিংশ শতকে উদ্ভূত একটি ব্যবস্থা প্রণয়ন ক’রে নিজের উপর পরীক্ষানিরীক্ষা চালাবে। ভারতের সমস্যা এবং সম্পদ দুইই ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের।

আমি একপ্রকার নিশ্চিত ছিলাম যে জাতীয়তাবাদই হচ্ছে কমিউনিজমের একমাত্র কড়া দাওয়াই। আমার স্বদেশ – তা সে ঠিক হোক, ভুল হোক – আমার প্রাণ, এটাই ক্রমে আমার মূলমন্ত্রে পরিণত হচ্ছিল। কিন্তু একদিন রাম স্বরূপের সঙ্গে আরএসএস-বিজেএস গোষ্ঠীর এক বন্ধুর আলোচনা শোনবার সময় আমার এই ধারণার বুদ্বুদটি গেল ভেঙে। যা কিছু বিদেশী, সে সমস্তই পরিহার করবার সপক্ষে ঐ বন্ধুটি খুব জোর সওয়াল করছিল। তখন রাম স্বরূপ তাকে বললে : “কিন্তু কোনটা বিদেশী, বিজাতীয় তা স্রেফ ভৌগোলিক সীমারেখার মাপকাঠিতে বিচার করলে চলবে না। কারণ তেমনটা করা হ’লে প্রাদেশিকতা কিংবা গোষ্ঠীস্বার্থ-সর্বস্বতা ছাড়া এর আর কোনো সারবত্তা থাকবে না। আমার কাছে একমাত্র সেইগুলিই বিজাতীয় যা সত্য হ’তে বিচ্যুত, যা আত্মার সঙ্গে সম্পর্করহিত।” এই কথাটা আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। মনে হ’ল যেন একটা বাঁধন খুলে গেল। কিন্তু এরপর কোন্‌ পন্থা অবলম্বন করব ভেবে কূলকিনারা পেলাম না।

সেসময় তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে রাম স্বরূপের পর্যবেক্ষণগুলি ক্রমশঃ অন্তর্মুখী এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে উঠছিল। সে প্রায়ই বলত যে দেশে একটি সাংস্কৃতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, যেটি কমিউনিজম নিজের সুবিধার্থে ভীষণভাবে কাজে লাগাচ্ছে। সে আরও বলত যে কমিউনিজ্‌ম একটি গভীরতর কারণে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। সেই কারণটি হ’ল : আমাদের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা আবার নতুন ক’রে আত্মবিস্মৃতির শিকার হচ্ছেন। একইসঙ্গে, ওপর ওপর দেখলে যাদের কমিউনিজম-বিরোধী জোট ব’লে মনে হয়, সেইসব শক্তির কাছ থেকেও সহযোগিতা পেয়ে কমিউনিজম অগ্রসর হচ্ছে। আর আমাদের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাটি একাই যে কমিউনিজ্‌মের হাতে আক্রান্ত হয়েছে শুধু তাই নয়। কমিউনিজম-সহ আরো বেশ কয়েকটি শক্তি একজোট হয়ে ভারতের অন্তর্নিহিত শক্তির গভীরতর উৎসগুলিকে ধামাচাপা দেবার এবং ধ্বংস করবার চেষ্টা করছে।

একইসঙ্গে আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম যে ভারতের রাজনীতি ক্রমশঃ অধঃপতিত হচ্ছে। দেখলাম যে এদেশের রাজনীতি তার জাতীয় চরিত্রটি হারিয়েছে। তার বদলে এদেশের রাজনীতি ক্রমে জাতপাত, ভাষা এবং প্রাদেশিকতার মতো অসংখ্য বিভেদমূলক উপাদানের কবলে প’ড়ে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। দেশ ও জাতির পুনর্গঠন আর এই রাজনীতির লক্ষ্য নয়। যেন তেন প্রকারেণ নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা দখল ও সুযোগসুবিধা ভোগ করাই এর এক এবং একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, অথচ ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে যে গুরুদায়িত্ব এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা ক্ষমতাশালীর স্কন্ধে ন্যস্ত হয়, সেসব পালন করা নিয়ে কারো বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। যে রাজনীতি মহত্তর এবং গভীরতর সংস্কৃতির দ্বারা মার্জিত হবার পথ বন্ধ করেছে, সে রাজনীতি যে শীঘ্রই বিষাক্ত হয়ে পড়বে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও একই ধরণের অবক্ষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি সম্মুখসমরের জন্য প্রস্তুত ছিল যা হয়তো আদৌ কোনোদিন ঘটবে না। কিন্তু শেষ বিচারে যে লড়াইয়ের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল নির্ধারিত হবে, সেই মতাদর্শগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য সে দেশটি একেবারেই তৈরি ছিল না। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিভিন্ন উপায়ে অসংখ্য বই, পত্রপত্রিকা এবং প্রচারপুস্তিকার মাধ্যমে গোটা বিশ্বকে নিজেদের নানান ধ্যানধারণা, মতাদর্শ, ও চিন্তাভাবনার ছক অনবরত জুগিয়ে যাচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে সোভিয়েত প্রচারযন্ত্রের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র হাতিয়ার ছিল আর্থিক সাহায্য। মার্কিন চিন্তাবিদগণ এবং শাসকশ্রেণীর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে একজন মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটলে স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের প্রতি তার আকৃষ্ট হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এ ব্যাপারে একদিন রাম স্বরূপ যে মন্তব্যটি করেছিল তা হচ্ছে : “সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রচার করে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। অথচ কার্যক্ষেত্রে তারা ভাববাদকেই উপজীব্য করে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুখে ভাববাদের কথা বললেও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকেই কাজে প্রয়োগ করে। এই দুই শক্তিধর দেশের মধ্যে দুটি ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা নিখুঁতভাবে ভাগ করা আছে। সোভিয়েতের লক্ষ্য আমাদের মস্তিষ্ক। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজর আমাদের ঘর-গেরস্থালীর দিকে।”

রাজনীতির গুণগত মানের অধোগামিতার এহেন বাতাবরণে আমরা গোড়ায় যেভাবে ভেবেছিলাম সেই কায়দায় আমাদের কমিউনিস্ট-বিরোধী প্রচার চালিয়ে যাবার পরিকল্পনাটি ত্যাগ করলাম। আমাদের মনে দৃঢ় ধারণা হ’ল যে আত্মিক অবক্ষয়ের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে হলে আরও বড় এক লড়াই লড়তে হবে, যে লড়াই গভীরতর সাংস্কৃতিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।

এই সময়ই আমি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ি। একেই কোনোকালে আমার ওজন খুব বেশি ছিল না। উপরন্তু এই অসুখের কারণে আমার ওজন এক ধাক্কায় অনেকখানি কমে যায়। কমিউনিস্ট-বিরোধী প্রচারকার্যের সূত্রে একজন ক্যাথলিক মিশনারী পাদ্রীর সঙ্গে ইতিমধ্যে আমার পরিচয় ঘটেছিল। তিনি আমার এই অসুখের সময় প্রায়ই আমায় দেখতে আসতেন। তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত ভদ্র এবং দয়াপরবশ প্রকৃতির মানুষ। তাঁর চরিত্রবলও ছিল অসাধারণ। বিভিন্ন মেলা এবং প্রদর্শনীগুলিতে আমাদের কমিউনিস্ট-বিরোধী সাহিত্য বিক্রি করবার জন্য তিনি নিজের ধর্মীয় অধিকারের দোহাই পেড়ে নিজের ক্যাথলিক মিশনের পরামর্শ উপেক্ষা করেছিলেন। তাঁর মিশন তাঁকে এ কাজ না করবারই পরামর্শ দিয়েছিল; কারণ একে তো মিশন তাঁর উপর যে দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিল ওটি তার মধ্যে পড়ে না, তার উপর আবার ভারত সরকার ও কাজটিকে ভালো চোখে দেখেন না।

তাঁকে আমি ‘ফাদার’ ব’লে ডাকতাম। তিনি এসে দেখলেন যে আর্থিক ও শারীরিক দুদিক থেকেই আমি বেজায় অনটনের মধ্যে রয়েছি। তিনি নিশ্চিত ক’রে বললেন যে এইরকম দুঃসময়েই যীশু খ্রিষ্ট মানুষের কাছে এসে থাকেন। তিনি আমাকে শুধালেন যে আমি যীশুকে আপন ক’রে নিতে প্রস্তুত কিনা। সেসময় আমি ধরতে পারিনি যে তিনি আসলে আমায় ক্যাথলিক মত ও পথ গ্রহণ ক’রে ধর্মান্তরিত হ’তে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন। আমি ভেবেছিলাম যে তিনি হয়তো আমার কল্যাণ কামনায় কোনো খ্রিষ্টীয় ধর্মানুষ্ঠানের আয়োজন করতে চান। তাছাড়া আমি তো বরাবরই যীশুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কাজেই তাঁকে গ্রহণ করতে আমার কুণ্ঠা থাকবে কেন? আমার মনে একমাত্র যে সন্দেহটি ছিল তা হচ্ছে : আমার সঙ্গে যীশুর সাক্ষাৎকার করিয়ে দেবে এমন লোক কোথায়? কিন্তু একবার ফাদারের সঙ্গে বহুদূরে অবস্থিত একটি খ্রিষ্টীয় মঠে গিয়ে আমি তাঁর আসল উদ্দেশ্যটি বুঝতে পেরেছিলাম। পথে যেতে যেতে অন্যান্য যেসব মিশনারীদের সঙ্গে তাঁর দেখা হ’ল তাঁদের প্রত্যেককে তিনি নিজের সাফল্য কামনায় প্রার্থনা করতে অনুরোধ জানাচ্ছিলেন।

মঠটি ছিল বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে প্রতিষ্ঠিত, এবং তার আশেপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী ছিল অনুপম সুন্দর। ওখানে পৌঁছেই ফাদার আমায় কিছুদিন একান্তে বাস করতে নির্দেশ দিলেন। একটি নির্জন ঘরে একাকী আমার ঠাঁই হ’ল। বেশিরভাগ সময়ই ঐ ঘরে প্রায় বন্দীদশায় দিন কাটাতাম। এমনকি স্নানঘরে যাবার সময় কিংবা সকাল-বিকেল ওখানকার বিস্তীর্ণ লনগুলোতে হাঁটবার সময়েও কারো দিকে তাকাবার অথবা কারো সঙ্গে কথা বলবার অনুমতি ছিল না। ঐ কন্‌কনে শীতের সময়েও প্রায় সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে তাঁর লেকচার শুরু হ’ত, চলত সারাদিন। দিনে তিনি চার-পাঁচটা লম্বা লম্বা বক্তৃতা দিতেন। ঐসব বক্তৃতায় খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কিত বেশ কিছু বিষয়ের অবতারণা ক’রে তিনি সেগুলি আমার ধ্যানের বিষয়বস্তু হিসেবে নির্ধারিত ক’রে দিতেন। এ ধরণের জীবনযাত্রায় আমি একেবারেই অভ্যস্ত ছিলাম না। এমন গভীর একাকীত্বের মধ্যে আমি স্বেচ্ছায় কখনো বাস করিনি। ঐসময় আমার একমাত্র সান্ত্বনা ছিল ধূমপান করবার অনুমতি এবং খ্রিষ্টীয় মত ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে প্রচুর বই পড়তে পাওয়া।

ঐ বইগুলির কয়েকটি আমি পড়বার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু একটি বইও সম্পূর্ণ প’ড়ে উঠতে পারিনি। বইগুলি জুড়ে ছিল বাইবেলের নানান প্রসঙ্গ এবং খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্বের বিভিন্ন পারিভাষিক শব্দ, যেগুলির সঙ্গে আমি একেবারেই পরিচিত ছিলাম না। ঐগুলি পড়তে পড়তে আমার রাম স্বরূপের ‘কেবল বুদ্ধির কচকচি’ সংক্রান্ত মন্তব্যটি মনে পড়ে যেত। এছাড়া ঐ বইগুলিতে যা থাকত তা হচ্ছে খ্রিষ্টের প্রতি প্রেম এবং ক্যাথলিক চার্চে যোগ দেবার সোজাসুজি আহ্বান জানিয়ে লম্বাচওড়া সব ভাষণ। এগুলির সঙ্গে খুব মিল খুঁজে পেতাম কমিউনিস্ট প্রচারপুস্তিকাগুলির, যা আমি প্রচুর সংখ্যায় পড়েছিলাম। খ্রিষ্টকে আবাহন ক’রে তাঁর ধ্যান করবার জন্য ফাদার আমাকে বারবার বলতে লাগলেন। কিন্তু কীভাবে ধ্যান করতে হয় তা ব’লে দিলেন না। ধ্যান করবার ব্যাপারে আমার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতাও ছিল না। খ্রিষ্ট কেন, কোনো ঠাকুর-দেবতাকেই আবাহন করবার কায়দা আমার জানা ছিল না। যেটুকু আমার পক্ষে করা সম্ভব হ’ল তা হচ্ছে পর্বতের উপর খ্রিষ্ট উপদেশ দিচ্ছেন কিংবা একজন পতিতাকে পাথর ছুঁড়ে মারার হাত থেকে রক্ষা করছেন – এই দৃশ্যগুলোর কথা বারংবার ভাবা। কিন্তু কিছুক্ষণ পরপরই আমার চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে যেত।

প্রত্যেকবার উপদেশ দিতে এসে নিজের বক্তব্য পেশ করবার আগে ফাদার আমায় জিজ্ঞেস করতেন যে আমি খ্রিষ্টের প্রতি অন্তরের টান অনুভব করতে শুরু করেছি কিনা। একথা বারবার শুনতে শুনতে দ্বিতীয় দিন বিকেলেই আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। আমি ওঁকে ব’লে বসলাম : একমাত্র যে দেবতার প্রতি আমি অন্তরের টান অনুভব করছি তিনি হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। কথাটা সত্যি ছিল না, এবং এই মিথ্যে কথাটি বলবার পরপরই আমার তীব্র অনুশোচনা হয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণ তো দূরে থাকুন, কোনোকিছুর প্রতিই আমি আমার অন্তরে কোনোরকম টান অনুভব করছিলাম না। অধিকাংশ সময়েই আমার মন ফ্রয়েডীয় পরিভাষায় যাকে ‘অবাধ ভাবানুষঙ্গ’[1] বলে, তাইতে মেতে থাকত। মিথ্যে কথাটা যে বলেছিলাম তার কারণ হ’ল ফাদারের লেকচার শুনতে শুনতে আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। যেসমস্ত সমস্যা আমায় জর্জরিত ক’রে রেখেছিল তাদের সঙ্গে ওঁর লেকচারগুলির কোনোরকম সম্পর্ক ছিল না। আমি চাইছিলাম যে শ্রীকৃষ্ণের নাম শুনে খেপে উঠে ফাদার শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে একটা কোনো বিরূপ মন্তব্য করুন যাতে আমি ওঁর সঙ্গে একটা তর্ক বাধাতে পারি; কেননা তার ফলে আমার উপর যে নিয়মানুবর্তিতার শৃঙ্খল উনি চাপিয়েছেন সেটা কেটে বেরোবার একটা সুযোগ আমি পাবো, আর এইভাবেই ওঁর খপ্পর থেকে আমার রেহাই মিলবে।

কিন্তু ফাদার খেপে তো গেলেনই না, এমনকী শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে কোনোরকম বিরূপ মন্তব্যও করলেন না। উল্টে তিনি গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। তাঁকে একরকম বিষণ্ণই দেখাচ্ছিল। অবশেষে অনেকক্ষণ বাদে তিনি আমায় জানালেন যে তাঁর এতবছরের ধর্মান্তরণের অভিজ্ঞতায় কখনো তিনি যীশুকে এত দেরি করতে দেখেননি। তিনি আমায় সেই রাতে আরেকবার চেষ্টা ক’রে দেখতে বললেন। আমি চেষ্টা করব ব’লে তাঁকে কথা দিলাম। কিন্তু তিনি চ’লে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। আমি অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু তখনো অব্দি আমার কোনো ধারণাই ছিল না যে পরদিন সকালেই আমার ঐ বন্দিদশা ঘুচবে। সকালে এসে ফাদার জগতের সৃষ্টি সম্পর্কে একটি বক্তৃতা জুড়ে দিলেন। বক্তৃতার মাঝখানে তিনি বললেন যে ঈশ্বর নিজ প্রজ্ঞা ও দয়ার বলে মানুষের ভোগের জন্যই এই সমস্ত পশুপাখি, মাছ ইত্যাদির সৃষ্টি করেছেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ ক’রে উঠলাম। খুব জোর দিয়েই তাঁকে জানালাম যে আমি একজন নিরামিষাশী বৈষ্ণব; এবং এমন ঈশ্বরে আমার কোনো প্রয়োজন নেই যিনি কিনা মনুষ্যেতর জীবদের বধ ক’রে ভক্ষণ করবার অধিকার মানুষকে দিয়েছেন শুধুমাত্র এই কারণে যে মানুষ ঐসব জীবের তুলনায় অধিক শক্তিশালী এবং বুদ্ধিমান। আমি আরো বললাম যে আমার মতে যারা অধিক বলশালী এবং বুদ্ধিমান তাদের কর্তব্য হচ্ছে যারা দুর্বল ও সহজ-সরল তাদের রক্ষা করা।

ফাদারটিও মেজাজ হারিয়ে ফেললেন। প্রায় চেঁচিয়ে উঠে তিনি বললেন : “তোমরা হিন্দুরা যে কী ক’রে তোমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করতে থাকা প্রত্যেকটি উকুন, ছারপোকা, আরশোলার মধ্যে আত্মা খুঁজে পাও তা আমার মাথায় ঢোকে না বাপু! বাইবেলে স্পষ্ট বলা আছে যে মানুষ ঈশ্বরের সৃষ্ট সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। যারা শ্রেষ্ঠতর তারা যদি নিকৃষ্টের উপর অধিকার ফলায় তাতে ক্ষতিটা কথায়?”

আমি চুপ ক’রে রইলাম। ফাদারের চোখেমুখে বেদনার ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। ওঁর মনোকষ্ট আর বাড়াবো না ব’লে মনস্থির করলাম। উনি কিন্তু খুব শিগগিরই নিজেকে সামলে নিলেন, স্মিত হাসলেনও। তখন আমি ওঁর সামনে নতজানু হয়ে ব’সে এই নির্জন সাধনা চালিয়ে যাবার ব্যাপারে নিজের অক্ষমতার কথা জানিয়ে ওঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করলাম। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি আমায় ফিরে যাবার অনুমতি দিলেন। তাঁর মুখেচোখে ব্যর্থতার ভাবটি স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল। ওঁর জন্য আমার খারাপই লাগছিল। আমার মনে হতে লাগল যে খ্রিষ্ট আমার কাছে এলেই বোধহয় সেটা আমাদের দুজনেরই জন্য ভালো হ’ত।

ফাদারের মিশনের অফিসটি ছিল শহরে। সেখানে ফেরবার পথে ফের তিনি পুরনো স্বাভাবিক মেজাজে ফিরে এলেন। আমরা ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে করতে, নানান রকম গুরুগম্ভীর এবং হাল্‌কা বিষয়ে আলোচনা করতে করতেই ফিরলাম। তাঁর চেহারায় কিংবা গলার স্বরে কোথাও এতটুকু তিক্ততা টের পেলাম না। আমার মনে যে প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছিল, এইবারে সুযোগ দেখে আমি সাহস ক’রে তাঁকে সেটা জিজ্ঞেস করেই বসলাম। বললাম : “ফাদার, আমি সাধারণতঃ মিথ্যে কথা বলি না, চুরি করি না, মিথ্যা সাক্ষ্য দিই না, প্রতিবেশির স্ত্রী অথবা ধনের প্রতি দৃষ্টিপাত করি না; তাহলে আমি কি খ্রিষ্টের অনুবর্তী হলাম না? ঈশ্বরের কৃপা এবং খ্রিষ্টের সান্নিধ্য লাভ করবার জন্য একজন মানুষ এর বেশি আর কী-ই বা করতে পারে? এর পরেও কেন আপনি আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে ধর্মান্তরিত করতে চাইবেন, যার দ্বারা আমি এখন যে অবস্থায় রয়েছি তার চাইতে উন্নত কিছু হ’তে পারবো না?” এই প্রশ্নের জবাবে ফাদার যে উত্তরটি দিয়েছিলেন তা ছিল একদম সোজাসাপ্টা, ওতে কোনোরকম ঘোরপ্যাঁচ ছিল না। তাঁর ঐ উত্তরটি শুনে আমি চিরতরে খ্রিষ্টধর্ম থেকে শতহস্ত দূরে থাকবার সিদ্ধান্ত নিই। তিনি বলেছিলেন : “শুধু খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধগুলির পালন করলেই যে তুমি খ্রিষ্টান হয়ে যাবে এ ধারণা একেবারে ভুল। খ্রিষ্টের ধর্মমত যেখানে রক্ষিত হয় সেই চার্চের দ্বারা যদি তোমাকে রীতি মেনে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত না করা হয় তাহলে তুমি নিজেকে ধর্মনিষ্ঠ খ্রিষ্টান বলতে পারো না। তিনিই একমাত্র উদ্ধারকর্তা। তাঁর সম্প্রদায়-বহির্ভূত কেউই মুক্তিলাভের অধিকারী নয়। হিদেনদের[2] ভাগ্যে একমাত্র অনন্ত নরকভোগই লেখা আছে।”

সেদিন সন্ধ্যায় আমি মিশনের গ্রন্থাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিকের সঙ্গে আমার কথা হয়। লোকটার বয়স ছিল কম, কিন্তু তাকে ভারি বিষণ্ণ এবং উদাস দেখাত। তার পদবী শুনে তাকে হিন্দু ব’লে ধ’রে নিয়েছিলাম। কিন্তু সে আমায় জানালে যে সে খ্রিষ্টান হয়েছে বেশ কয়েকবছর হ’ল। সে আরো বললে : “আমি একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ি। বাড়িতে টাকাকড়ি ছিল না। আমার সামান্য মাইনে দিয়েই স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে নিয়ে সংসার চলত। আমার আত্মীয়স্বজনও আমারই মত দরিদ্র ছিলেন, কাজেই আমাদের তাঁরা বিশেষ কোনো আর্থিক সাহায্য করতে পারতেন না। এদিকে ওষুধ এবং পথ্যের খরচ প্রচুর। এই সময় ফাদার আমার কাছে আসেন। আমাদের গলিতে লোকজনকে ধর্মান্তরিত করবার জন্য তিনি প্রায়ই প্রচারে আসতেন ব’লে তাঁকে আমার আগে থেকেই চেনা ছিল। তিনি আমার জন্য ওষুধপত্র এবং ফল নিয়ে এলেন। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভ’রে উঠল। একদিন আমার মানসিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একটি দুর্বল মুহূর্তে তিনি আমাকে বাপ্তিস্ম দীক্ষা দিয়ে দেন। আমার স্ত্রী খ্রিষ্টান হ’তে রাজি হয়নি। সে ছিল গোঁড়া হিন্দু। কিন্তু সে আমায় তখন ছেড়েও যায়নি। আমার স্বাস্থ্য উদ্ধারের পর থেকেই ফাদার জোর দিয়ে বলতে লাগলেন যে গোমাংস না খাওয়া অবধি আমার দীক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কায়স্থ হবার কারণে আমি এমনিতেই আমিষাশী ছিলাম। কাজেই আরো এক প্রকারের মাংস খেলে ক্ষতি কী? এই ভেবে খেয়ে নিলাম। কিন্তু ব্যাপারটা আমার স্ত্রীর কানে পৌঁছতে না পৌঁছতেই সে আমাদের সন্তানদুটিকে সঙ্গে ক’রে অন্য শহরে নিজের বাপের বাড়িতে চ’লে গেল। আমি তাকে ফিরিয়ে আনতে গেলাম। কিন্তু তার বাড়ি থেকে আমায় ফিরিয়ে দেওয়া হ’ল। সেই থেকে আমার সমাজ আমায় একঘরে ক’রে দিয়েছে। আমার সমাজ ও পরিবারের কেউ আমার ঘরে এক গ্লাস জল অব্দি মুখে তুলবে না। সেই থেকে এই মিশন ছাড়া আমার আর কোনো গত্যন্তর নেই। যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন এই মিশনই আমার একমাত্র আশা-ভরসা ও আশ্রয়স্থল।”

তার কথাগুলো শুনতে শুনতে স্বামী বিবেকানন্দের একটি উক্তি আমার মনে প’ড়ে গেল। তিনি খ্রিষ্টধর্মকে ‘চার্চধর্ম’ ব’লে বর্ণনা করেছিলেন। সেইসঙ্গে নিজেকে এই সমাজের অংশ ব’লে ভাবতে আমার লজ্জা করলো। বহুযুগ ধ’রে এই সমাজ নিজ দেহের অংশগুলি একের পর এক খুইয়ে চলেছে। ব্যাপারটা এখন একেবারে শিল্পকলার পর্যায়ে চ’লে গেছে। কিন্তু ঐ তরুণ লোকটির জন্যে আমি কীই বা করতে পারতাম? আমি যে নিজেই একটা আশ্রয়স্থলের সন্ধানে তখন রত ছিলাম; মূর্ত আশ্রয়স্থল এবং মতাদর্শগত আশ্রয়স্থল – দুই অর্থেই।

পাদটীকা

[1] Free association: সিগমুণ্ড ফ্রয়েড কর্তৃক উদ্ভাবিত মনোবিশ্লেষণের প্রক্রিয়াবিশেষ, যেখানে নানান ছবি দেখিয়ে পরীক্ষাধীন ব্যক্তির মনে ভেসে ওঠা চিন্তাকে অকপটভাবে প্রকাশ করতে বলা হয়।

[2] যাঁরা আব্রাহামীয় (অর্থাৎ খ্রিষ্টান, ইহুদী ও মুসলিম) সম্প্রদায়গুলির অন্তর্ভুক্ত নন তাঁদের বোঝাতে ‘হিদেন’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়।

মূল গ্রন্থের রচয়িতা: সীতারাম গোয়েল
বঙ্গানুবাদ : শ্রীবিজয়াদিত্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.