ঢাকা, ২ জানুয়ারি : বাংলাদেশে গত ২০১৯ সালে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের ৬৮৩টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৩১ হাজার ৫৫৫ ওন হিন্দু নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। ৩৬০.২২ একর হিন্দু সম্পত্তি জবরদখল হয়েছে। বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট গত বছরের হিন্দু নির্যাতনের যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে এ তথ্য উঠে এসেছে।
২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জারে প্রকাশিত এবং হিন্দু মহাজোটের জেলা, থানা নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে এ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে বলে সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করা হয়েছে।
হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দচন্দ্র প্রামাণিক রিপোর্ট পেশ করে বলেন, গত বছর বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মঠ মন্দির, প্রতিমা ভাঙচুর, হিন্দু বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, খুন, নারী অপহরণ, দেশত্যাগে বাধ্য করা সহ নানা অত্যাচারের ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ক্ষমতাসীন আওয়ামি লিগের নেতাকর্মী সহ অন্য দলের নেতা কর্মীরা প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে হিন্দুদের ওপর হামলা লুটপাট করেছে।
রিপোর্টে গোবিন্দ প্রামাণিক জানান, গত বছরে ৩১,৫০৫ জন হিন্দু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং ৯৫০৭.২২ একর ভূমি দখল হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে ১০৮ জনকে, হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে ১১১ জনকে, হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে ৮৮ জনকে, আহত করা হয়েছে ৪৮৪ জনকে, নিখোঁজ হয়েছে ২৬ জন, চাঁদা দিতে হয়েছে ১৫ লক্ষ ২৮ হাজার টাকা। এসব ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ৪৩৩ কোটি ৫৪ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।
মঠ-মন্দিরে হামলা এবং হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার বিষয়ে গোবিন্দ প্রামাণিক বলেন, মন্দির ও বাড়ির লুটপাট হয়েছে ২৭৭টি, হামলা হয়েছে ৩৭৮টি, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ৯২টি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮৯টি, ঘরবাড়ি বেদখল হয়েছে ২০টি, মন্দিরের ভূমি ৩১টি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ২৭টি, দখলের তৎপরতা হয়েছে ৬৬ একর জমিতে, যা প্রায় ৫৮ শতাংশ। বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে ৪৩৪টি পরিবার, উচ্ছেদের তৎপরতার মুখোমুখি হয়েছে ৬৯০টি পরিবার, উচ্ছেদের হুমকি দেওয়া হয় ১৬০টি পরিবারকে, দেশ ত্যাগের হুমকি দেওয়া হয় ৬৪১টি পরিবারকে, দেশত্যাগে বাধ্য করা হয় ৩৯৭টি পরিবারকে, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে ২২৬১টি পরিবার, মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর অগ্নিসংযোগের ঘটনা ৪৪৯টি, সংঘবদ্ধ হামলা ১২৫টি, প্রতিমা ভাঙচুর ২৪৬টি, প্রতিমা চুরি ৩১টি, অপহরণ ৭৬ জনকে, অপহরণের চেষ্টা ৭ জনকে, ধর্ষণ ৪২ জনকে, ধর্ষণের চেষ্টা ৩৪টি, ধর্ষণের পর হত্যা ৬টি, গণধর্ষণ ১৮টি, জোর করে ধর্মান্তকরণ ও ধর্মান্তরকরণের চেষ্টা ১৪৮ জনকে, ধর্মীয় আবেগে আঘাত ৯৯টি, মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার ১০৯ জন, অবরুদ্ধ পরিবার ১০৫টি, মন্দির অপবিত্রকরণ ৫টি, মিথ্যা রাজাকার বানানো হিন্দু মুক্তিযোদ্ধা ৩৬ জনকে, পরিকল্পিতভাবে ধর্মীয় নিষিদ্ধ গোমাংস খাইয়ে ধর্মীয় আবেগে আঘাত ৫টি ঘটনায় ২২ জনকে।
রিপোর্টে বলা হয়, গত বছরের তুলনায় সর্বক্ষেত্রেই হিন্দু নির্যাতন বেড়েছে। গত বছর হত্যা হয়েছিল ৮৮ জন, এ বার তা বেড়ে হয়েছে ১০৮ জন। গত বছর আহত হয়েছেন ৩৪৭, এ বছর বেড়ে হয়েছে ৪৮৪ জন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গত বছর হামলা হয়েছিল ৩৫টি, এ বছর ৭৯টি। গত বছর বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল ২১৭টি পরিবার, এ বছর বেড়ে হয়েছে ৬৪১টি পরিবার। গত বছর দেশত্যাগের হুমকির মুখে ছিল ২২৩টি পরিবার, এ বছর সেই সংখ্যা ৬৪১। দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে ৩৭৮টি পরিবারকে। গত বছর নিরাপত্তাহীনতায় ছিল ১৫১০ পরিবার, এ বছর বেড়ে হয়েছে ২২৬১ পরিবার। গত বছর মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছিল ১৩১টি, এ বছর বেড়ে হয়েছে ১৫৩টি। বাড়িতে হামলা ভাঙচুর অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল ১০৮টি। এ বছর হয়েছে ৪৪৮টি। গত বছর ভূমি জবরদখল ছিল ২৭৩৪.৮১ একর, এ বছর ৯৫০৭.২২ একর জমি জবরদখল করা হয়েছে। এ বছর নতুন করে ৩৬ জন হিন্দু মুক্তিযোদ্ধার গায়ে রাজাকার তকমা যুক্ত হয়েছে। যদিও সরকার দুঃখ প্রকাশ করেছে, তবুও দুষ্টচক্র এই রিপোর্ট নিয়ে চিরকাল মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানিত করবে, এমনই সন্দেহ মহাজোটের।
গোবিন্দ প্রামাণিক বলেন, হাসিনা সরকার দিন দিন মৌলবাদের প্রতি ঝুঁকছে। প্রশাসনেও হিন্দু বিদ্বেষ চরম আকারে। উপরন্তু ফেসবুক হ্যাক করে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে শতাধিক হিন্দু যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। শত শত ঘরবাড়ি পুড়িয়ে, মঠ-মন্দির ধবংস করে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে প্রতিনিয়ত হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। সরকার সব শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ইসলামিকরণ করেছে। হিন্দু ছাত্রছাত্রীকে ইসলাম ধর্ম পাঠ করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন সময় হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের দিনে নির্বাচনের দিন ধার্য করে। গত বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের আপত্তি সত্ত্বেও দুর্গাপূজার দিনে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন করেছিল। আগামী ৩০ জানুয়ারি সরস্বতী পুজোর দিন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের জন্য তারিখ নির্ধারণ করেছে। আমরা সরস্বতী পূজার দিন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনের জন্য দাবি জানাচ্ছি।”
সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের সিনিয়র সহ-সভাপতি প্রদীপ কুমার পাল, প্রধান সমন্বয়কারী বিজয়কৃষ্ণ ভট্টাচার্য, যুগ্ম মহাসচিব মণিশঙ্কর মণ্ডল, আইন সম্পাদক সুব্রত হালদার, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অমিয় বাউল, মহিলা মহাজোটের সাধারণ সম্পাদক সাগরিকা মণ্ডল, উত্তরবঙ্গ সমন্বয়ক দুলাল কর্মকার, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল ঘোষ, হিন্দু যুব মহাজোটের সভাপতি কিশোর কুমার বর্মণ, ছাত্র মহাজোটের সভাপতি সাজেনকৃষ্ণ বল প্রমুখ।
যুগশঙ্খ প্রতিবেদন
2020-01-03