শুরু এবং শেষ জানা ছিল আগেই। কিন্তু শুক্রবার দুপুরে এনডিএ-র নেতা হিসাবে নরেন্দ্র মোদীর পুনর্নির্বাচন পর্বের বাকি অংশে ‘চমক’। বক্তাদের তালিকায়, শরিকি ঐক্যের ছবি তুলে ধরায়, এমনকি ব্যক্তি মোদীর পরিবর্তে এনডিএ-র ‘মাহাত্ম্য’ প্রচারেও। যা দেখে বিরোধীদের একাংশ প্রধানমন্ত্রীর এক দশক আগেকার স্লোগানে ঈষৎ মোচড় দিয়ে বলছেন, এ হল ‘সব কা সাথ, মোদী কা বিকাশ’। অর্থাৎ, নিজেকে তুলে ধরার জন্য সকলের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে মোদীকে।
বাস্তবে হলও তা-ই। এনডিএ-র একের পর এক শরিক দলের নেতা মোদীর প্রশস্তি গাইলেন। এনডিএ তো বটেই, বিজেপির অন্দরেও যে নেতার সঙ্গে মোদীর সম্পর্ক ‘মসৃণ’ নয় বলেই শাসক শিবিরের সকলে জানেন, তাঁকেও বক্তৃতা দেওয়ানো হল। মোদীর ‘সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা’ তুলে ধরতেই পুরনো সংসদ ভবনের সেন্ট্রাল হলের ওই বৈঠকে বিজেপি এবং সহযোগী দলগুলির লোকসভা সাংসদদের পাশাপাশি ‘আমন্ত্রিত’ তালিকায় ছিলেন রাজ্যসভা সাংসদেরাও। আমন্ত্রিত ছিলেন বিজেপি এবং এনডিএ শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা। একেবারে সামনের সারিতে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।
শুক্রবারের যে বৈঠকে বার বার এনডিএ-র ঐক্যের ছবি তুলে ধরার চেষ্টা হল, ঘটনাচক্রে মোদীর দ্বিতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম চার বছরে সেই জোটের কোনও বৈঠকই হয়নি! গত বছরের ১৮ জুলাই বেঙ্গালুরুতে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র আনুষ্ঠানিক আবির্ভাবের দিনে দিল্লিতে এনডিএ-র শরিকদের নিয়ে প্রথম বৈঠক করেছিলেন মোদী, অমিত শাহ, জেপি নড্ডারা। গত পাঁচ বছরে এনডিএ-র সেটিই প্রথম এবং সেটিই শেষ বৈঠক!
তাঁর নেতৃত্বে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না-পেলেও মোদীর প্রতি ‘বিশ্বাস’ যে সকলের অটুট, তা তুলে ধরতে ওই বৈঠক সরাসরি (লাইভ) সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল খবরের চ্যানেলে। যা হয়ে থাকে সংসদের অধিবেশন চলার সময় বা সংসদ শুরুর আগে যৌথ অধিবেশনের ক্ষেত্রে। এনডিএ বা অন্য কোনও জোটের বৈঠক এ ভাবে সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা স্মরণকালের মধ্যে হয়েছে বলে তথ্যাভিজ্ঞেরা মনে করতে পারছেন না।
বৈঠকের প্রথমে বিজেপির সভাপতি জেপি নড্ডা দলের সংসদীয় নেতা হিসাবে মোদীর নির্বাচিত হওয়ার কথা ঘোষণা করেন। এর পরে রাজনাথ সিংহ এনডিএ-র সংসদীয় নেতা হিসাবে মোদীর নাম প্রস্তাব করেন। গত কয়েক বছরে বিজেপির ‘নম্বর টু’ হয়ে ওঠা অমিত শাহের বদলে রাজনাথকে এই ভূমিকায় দেখতে পাওয়া ‘চমক’ তো বটেই। কারণ, প্রতিরক্ষা দফতরের মন্ত্রী হলেও সরকার এবং বিজেপির অন্দরে রাজনাথ খানিকটা নীরবেই থাকেন।
‘চমক’ ছিল আরও। তৃতীয় বক্তা শাহের পরেই নিতিন গডকড়ীর আগমন! প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে আরএসএস ঘনিষ্ঠ নেতা গডকড়ীর সম্পর্ক ‘মসৃণ’ নয়। গত এক দশক ধরে মোদী মন্ত্রিসভায় থাকলেও দল এবং জোটের অন্দরে কখনও ‘সক্রিয়’ হতে দেখা যায়নি তাঁকে। এমনকি, কয়েক বছর আগে আমজনতার স্বপ্নপূরণের ক্ষেত্রে মোদী সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রাক্তন বিজেপি সভাপতি গডকড়ী।
১৬ জন লোকসভা সাংসদের দল টিডিপির প্রধান চন্দ্রবাবু নায়ডু এবং ১২ লোকসভা সাংসদের দল জেডিইউ-এর সভাপতি নীতীশ কুমারকে পিছনে ফেলে এনডিএ-র অ-বিজেপি নেতাদের মধ্যে প্রথম বক্তা হিসাবে শুক্রের বৈঠকে দেখা গেল জেডিএসের এইচডি কুমারস্বামীকেও। নায়ডু এবং নীতীশের পরে শিবসেনার একনাথ শিন্ডে, এনসিপির অজিত পওয়ার, এলজেপি (রামবিলাস)-এর চিরাগ পাসোয়ান, হিন্দুস্থান আওয়াম মোর্চা (হাম) সভাপতি জিতনরাম মাঝিঁ, আপনা দল (এস) নেত্রা অনুপ্রিয়া পটেল, জনসেনা পার্টির পবন কল্যাণের মতো সহযোগী নেতারাও বক্তার তালিকায় ছিলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উচ্ছ্বসিত শুনিয়েছে রামবিলাস পাসোয়ানের পুত্র চিরাগকে। মোদীর স্তুতি হয়ে যাওয়ার পরে সটান গিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন। বুকে জড়িয়েও ধরেন মোদীকে।
এনডিএ-র জয়জয়কার করেছেন মোদীও। অতীত স্মরণ করেছেন। তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘প্রকাশ সিংহ বাদল, বালাসাহেব ঠাকরে, জর্জ ফার্নান্ডেজ়, শরদ যাদবের মতো প্রয়াত নেতাদের হাত ধরে এনডিএ-র যাত্রা শুরু হয়েছিল।’’ যদিও ইতিহাস বলছে, জীবদ্দশাতেই এনডিএ ছাড়তে হয়েছিল জর্জকে। শরদকে যোগ দিতে হয়েছিল লালুপ্রসাদের আরডেজি-তে! আর প্রয়াত প্রকাশের পুত্র সুখবীর বাদল এবং বালাসাহেব-পুত্র উদ্ধব ঠাকরে এখন নিজেদের রাজ্যে ‘কট্টর বিজেপি বিরোধী’।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল এনডিএ। ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বে এই জোটের সরকার ছিল। তার পরে ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে জিতে মোদীর নেতৃত্বে ফের সরকার গঠন করেছিল এই জোট। তবে এত দিন জোট ছিল নামেই। এককালে বাংলায় যেমন বামফ্রন্টের শরিকদের হেলাফেলা করত সিপিএম, কেন্দ্রে বিজেপিও তেমনই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এসেছে জোটশরিকদের। বস্তুত, গত এক বছরে এনডিএ-র অন্যতম শরিক পঞ্জাবের শিরোমণি অকালি দল, তামিলনাড়ুর এডিএমকে, জম্মু ও কাশ্মীরে পিডিপি, হরিয়ানায় জেজেপি, রাজস্থানের রাষ্ট্রীয় লোকতান্ত্রিক পার্টি মোদীর সঙ্গ ছেড়েছে।
সহযোগী পাওয়ার জন্য উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা এবং শরদ পওয়ারের এনসিপি ভেঙে প্রতীক দখলেরও অভিযোগ উঠেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। আবার গত কয়েক মাসে নীতীশের জেডিইউ-এর পাশাপাশি এনডিএ ছাড়ার পরেও ফেরত এসেছেন টিডিপি-র চন্দ্রবাবু, তামিলনাড়ুর পিএমকে, কর্নাটকের জেডিএস, এমনকি এলজেপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রামবিলাস পাসোয়ানের পুত্র চিরাগ। উত্তরপ্রদেশের রাষ্ট্রীয় লোকদল, অন্ধ্রে জনসেনা ত্রিপুরায় তিপ্রা মথার মতো নতুন সহযোগীও পেয়েছে বিজেপি। লোকসভা ভোটে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পরে মোদীর ‘প্রভাব’ অক্ষুণ্ণ রাখতে সেই শরিকদেরও মুখাপেক্ষী বিজেপি।