শিয়ালদহে পাঁচটি প্ল্যাটফর্ম সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়েছে। সেই কারণে ১ থেকে ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্ম বন্ধ রাখা হয়েছে বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে। কাজ চলবে অন্তত রবিবার দুপুর পর্যন্ত। এই সংক্রান্ত কাজের জন্য ট্রেন পরিষেবাতেও বেশ কিছুটা বদল আনতে হয়েছে রেল কর্তৃপক্ষকে। শুক্রবার সন্ধ্যায় রেল কর্তৃপক্ষ বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, শিয়ালদহ স্টেশনে পাঁচটি প্ল্যাটফর্ম সম্প্রসারণের কাজ পুরোদমে চলছে। রবিবারের মধ্যে সেই কাজ শেষ হবে বলেও দাবি করেছে রেল। ওই পাঁচটি প্ল্যাটফর্ম থেকে যাতে ১২ কামরার ট্রেন ছাড়তে পারে, সেই উদ্দ্যেশেই এই কাজ করা হচ্ছে বলে আগেই জানিয়েছিল রেল। তবে এই কাজের কারণে পরিষেবা ব্যাহত হওয়ায় ক্ষুব্ধ যাত্রীরা।
শিয়ালদহ স্টেশন থেকে মেন, উত্তর এবং দক্ষিণ শাখায় লোকাল ট্রেন চলে। এর মধ্যে মেন ও উত্তর শাখার ট্রেন ছাড়ে ১ থেকে ১৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে। ১৫ থেকে ২১ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়ে দক্ষিণ শাখার ট্রেন। প্ল্যাটফর্ম সম্প্রসারণের কাজের প্রভাব দক্ষিণ শাখায় পড়েনি। সেখানে ট্রেন পরিষেবা স্বাভাবিক আছে। কিন্তু পরিষেবায় বদল আনা হয়েছে মেন ও উত্তর শাখায়। গত বুধবার এই কাজের কথা সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়েছিলেন শিয়ালদহের ডিআরএম দীপক নিগম। কিন্তু পরিষেবায় বদল আনার কথা জানানো হলেই, কোন কোন ট্রেন বাতিল বা কোন কোন ট্রেনের যাত্রাপথ নিয়ন্ত্রণ করা হবে সে সংক্রান্ত কোনও নির্দেশিকা বৃহস্পতিবার মধ্যরাত পর্যন্ত প্রকাশ্যে আনা হয়নি রেলের তরফে। এর ফলে যাত্রীরা বিভ্রান্তির সম্মুখীন হন। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে কাজ শুরু হওয়ার কথা বলা হলেও কোন কোন ট্রেন বাতিল বা নিয়ন্ত্রিত যাত্রাপথে যাতায়াত করবে তা সংয় মতো না জানানোয় যাত্রীদের একাংশ রেলের বিরুদ্ধে সরব হন। পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক কৌশিক মিত্র যদিও জানিয়েছেন, সংবাদপত্রে রেলের তরফে বিজ্ঞাপন দিয়ে পরিষেবা সংক্রান্ত সকল তথ্য জানানো হয়েছে। সমাজমাধ্যমেও পোস্ট করা হয়েছে এই সংক্রান্ত তথ্য। তবে যাত্রীদের অভিযোগ, বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে কাজ শুরু হয়েছে। শুক্রবার সকাল থেকেই অনেক ট্রেন বাতিল ও বহু ট্রেনের যাত্রাপথ দমদম জংশন, দমদম ক্যান্টমেন্ট, বারাসত জংশনের মতো স্টেশনে শুরু এবং শেষ হওয়ার কথা। শনি এবং রবিবারও তা-ই হবে। অথচ রেলের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে শুক্রবার সকালের সংবাদপত্রে। তত ক্ষণ বহু যাত্রী বাড়ি থেকে গন্তব্যের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছেন। স্টেশনে এসে জানতে পেরেছেন তিনি যে ট্রেন ধরবেন, সেটি হয় বাতিল হয়েছে অথবা প্রান্তিক স্টেশন পর্যন্ত যাবে না। এর ফলে যাত্রীদের ভোগান্তি হয়েছে। শুধু তাই নয়, পরিষেবা বদলের ফলে বহু ট্রেনে মাত্রাতিরিক্ত ভিড় হয়েছে।
এমনই একটি ভিড়ে ঠাসা ট্রেন থেকে পড়ে যান মহম্মদ আলি হাসান আনসারি নামের এক যুবক। তিনি টিটাগড়ের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের পুরানিবাজার এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। স্থানীয় সূত্রে খবর, শুক্রবার সকালে শিয়ালদহ মেন শাখার টিটাগড় ও খড়দহ স্টেশনের মাঝের একটি জায়গায় ভিড় ট্রেন থেকে পড়ে যান তিনি। গুরুতর জখম অবস্থায় তাঁকে বিএন বসু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই আনসারিকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘‘ছেলেটা টিটাগড় থেকে উঠেছিল ট্রেনে। ভিতরেও ঢুকতে পারেনি, এত ভিড়! বাইরে ঝুলছিল। হঠাৎ টিটাগড় আর খড়দহ স্টেশনের মাঝে কুষ্ঠ হাসপাতালের সামনে পড়ে যায় ও।’’ পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক জানিয়েছেন, ওই যাত্রীর ট্রেন থেকে পড়ে যাওয়া এবং তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে শিয়ালদহ স্টেশনে কাজের কী সম্পর্ক, তা রেল কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারছেন না। যদিও যাত্রীদের বক্তব্য, রেল পরিষেবা অনিয়মিত হওয়ার কারণেই ট্রেনে অন্য দিনের তুলনায় বেশি ভিড় হয়। আর ভিড়ের কারণেই ওই যুবক ট্রেনের ভিতরে ঢুকতে পারেননি। বাইরে ঝুলছিলেন। একটা সময়ে তিনি ভিড়ের চাপে পড়েও যান। ব্যারাকপুরের বাসিন্দা, নিত্যযাত্রী সদানন্দ দত্তের কথায়, ‘‘রেল যদি সময় মতো যাত্রীদের জানাতে পারত, কোন কোন ট্রেন কোন কোন সময়ে বাতিল তা হলে এমন ভিড় হত না। আমরা তো সকলেই প্ল্যাটফর্মে গিয়ে জানতে পেরেছি, একের পর এক ট্রেন লেট। অনেক ট্রেন বাতিল। অনেক ট্রেন দমদম জংশন থেকে ছাড়বে। ট্রেন স্বাভাবিক ভাবে চললে ভিড় কম হত। আর তেমনটা হলে ছেলেটার অকালমৃত্যু হত না হয়তো।’’ রেল যদিও দাবি করেছে, এমন ঘটনা অন্য সময়েও ঘটে। তার কারণ হিসাবে রেলের ব্যাখ্যা, অনেক সময়ে অনেকেই ট্রেনের দরজায় ঝুলে যাতায়াত করেন। যদিও ও ভাবে ট্রেন-সফর করা যে ‘নিষিদ্ধ’ তা-ও রেল জানিয়েছে।
শিয়ালদহে যেমন পাঁচটি প্ল্যাটফর্ম বন্ধ থাকায় ভিড় উপচে পড়েছে বাকিগুলিতে। একই রকম ভাবে দমদম জংশন এবং দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনেও প্রবল ভিড় ছিল সারা দিন ধরে। রাতেও সেই ভিড় এক ফোঁটাও হালকা হয়নি। অনেক ট্রেনের মতো মেন লাইনের শেষ আপ ট্রেনও এই তিন দিন দমদম জংশন থেকে ছাড়বে। কিন্তু রাত ১২টা নাগাদ শেষ ট্রেন ধরতে কী ভাবে ধর্মতলা থেকে দমদম জংশনে পৌঁছবেন তা ভেবেই পাচ্ছেন না শ্যামনগরের বাসিন্দা অমিত মণ্ডল। ধর্মতলার একটি হোটেলে কাজ করেন তিনি। প্রতি দিন শিয়ালদহ থেকে আপের শেষ ট্রেন ধরেন। সপ্তাহান্তে হোটেলে এমনিতেই ভিড় হয়। ফলে আগে বেরিয়ে আগের ট্রেন ধরবেন তা-ও সম্ভব নয়। তাঁর কথায়, ‘‘শেষ ট্রেনটা অন্তত শিয়ালদহ থেকেই ছাড়তে পারত। তাতে তো আমার মতো হাজারো মানুষের সুবিধা হত। রেলের এই ভাবনাটা ঠিক নয়। ওদের কাজটা যেমন জরুরি, আমাদেরটাও তো!’’
সারা দিন ধরে ভোগান্তির মুখে পড়া যাত্রীদের একাংশ প্রশ্ন তুলেছিলেন, কোভিড কালে শিয়ালদহ স্টেশন ঢেলে সাজানো হয়েছিল যখন, তখন কেন এই প্ল্যাটফর্ম সম্প্রসারণের কাজ করা হয়নি? এমনকি, কয়েক মাস আগে দমদমে জরুরি কিছু কাজের জন্য প্রায় দু’দিন ট্রেন চলাচল নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছিল। সেই সময়েও এই কাজ কেন করা হল না, সে প্রশ্নও তুলেছেন যাত্রীদের একাংশ। রেল যদিও এ সব প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছে, লকডাউনের সময়ে পূর্ব রেল বহু এমন কাজ করেছে। শিয়ালদহ বিভাগের পুরনো সমস্ত রেলব্রিজ পাল্টানোর কাজ করা হয়েছে লকডাউনের সময়ে। করোনাবিধি মেনে কম সংখ্যক কর্মী নিয়ে সেই সময়ে রেলকে কাজ করতে হয়েছে। যাত্রী নিরাপত্তা সংক্রান্ত কাজের পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের কাজও করোনাকালে নিরলস পরিশ্রম করে পূর্ব রেলের কর্মীরা করেছেন বলে দাবি করেন পূর্ব রেলের মুখ্য জন সংযোগ আধিকারিক। তাঁর কথায়, ‘‘দীর্ঘ দিন ধরে আটকে থাকা কাজ ওই সময়ে করা হয়েছে। তবে যাত্রী নিরাপত্তার বিষয় আগে। প্ল্যাটফর্ম সম্প্রসারণের কাজ তো আর নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত নয়। যাত্রী স্বাচ্ছন্দের সঙ্গে জড়িত। তা-ই ওই কাজ সেই সময়ে করা হয়নি।’’ তাঁর দাবি, ভবিষ্যতে যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য দিতে শিয়ালদহের এই কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।