বাংলার ভোটপ্রচারে ইতিমধ্যেই উত্তর ভারতের উপস্থিতি মিলেছে। মঙ্গলবারই এক সফরে তিন সভা করে গিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। তিনি আবারও আসবেন। আরও অন্তত দু’টি সফরে প্রায় হাফ ডজন সভা করতে পারেন। এমনটাই চাইছে রাজ্য বিজেপি। যদিও সবটাই নির্ভর করছে যোগীর নিজের রাজ্যের প্রচার সামলানোর পরে বাড়তি সময়ের উপরে।
যোগী ছাড়াও ইতিমধ্যেই বিজেপিশাসিত তিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বাংলায় এসে গিয়েছেন লোকসভা নির্বাচনের প্রচার এবং সাংগঠনিক বিষয় দেখার জন্য। সবার আগে এসেছিলেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা। তিনি বঙ্গ বিজেপির সভাপতি তথা বালুরঘাটের প্রার্থী সুকান্ত মজুমদারের মনোনয়ন জমার সময়ে হাজির ছিলেন। এর পরে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী ভজনলাল শর্মা এসেছিলেন শ্রীরামপুরের প্রার্থী কবীরশঙ্কর বসুর মনোনয়ন জমা দেওয়ার দিন। সদ্যই এসেছিলেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামী। তিনি হুগলির প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায়েয়র প্রচারে রোড-শো করেন। তাঁর রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে সহ-পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব সামলানো লকেটের মনোনয়নেও হাজির ছিলেন ধামী। রাজ্যে ধামী থাকার মধ্যেই মঙ্গলবার যোগী তিনটি সভা করেছেন। এর মধ্যে একটি আসানসোল, একটি বহরমপুর এবং একটি বীরভূম লোকসভা এলাকায়।
এ বার আসছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা। তিনি শুধু অসমের মুখ্যমন্ত্রী নন, গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতে বিজেপির প্রধান নেতা। বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছের নেতা হেমন্তের উপরে বাংলারও দায়িত্ব রয়েছে। রাজ্যে অন্য দল থেকে কাদের বিজেপিতে নেওয়া হবে, তা ঠিক করার দায়িত্বও তাঁর উপরে ছিল। কলকাতা উত্তরের প্রার্থী তাপস রায়কে বিজেপিতে নেওয়ার সময়ে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে আলোচনা করতে কলকাতাতেও এসেছিলেন হেমন্ত। কারণ, রাজ্যের তরফে দলবদলের যে কমিটি, তার মাথায় রয়েছেন শুভেন্দু।
এখনও পর্যন্ত যা ঠিক রয়েছে, তাতে হেমন্তের প্রথম সফর হবে তৃতীয় দফা ভোটের দিন, অর্থাৎ ৭ মে। ১৪ আসনের অসমে প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় পাঁচটি করে কেন্দ্রে ভোট হয়ে গিয়েছে। তৃতীয় দফায় ভোট হবে বাকি চারটি আসনে। নিজের রাজ্যে প্রচার শেষ হয়ে যাবে রবিবার। এর পরে মঙ্গলবারই তাঁর প্রথম সফর বাংলায়। যা ঠিক রয়েছে, তাতে ওই দিন তিনটি সভা করবেন হেমন্ত। বীরভূমের সাঁইথিয়া, কৃষ্ণনগরের ধুবুলিয়া এবং রানাঘাটের বীরনগরে সভা হবে হেমন্তের। বিজেপিতে ‘গরম’ বক্তৃতার জন্য খ্যাতি রয়েছে হেমন্তের। গত বিধানসভা নির্বাচনেও তিনি সেই ‘গরম’ বক্তৃতা শুনিয়ে গিয়েছেন বাংলাকে। এ বারও দফায় দফায় বিভিন্ন আসনে প্রচারে এসে রাজ্য বিজেপিকে মেরুকরণের উত্তাপ দিতে পারেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রথম ও দ্বিতীয় দফার সব আসনের হয়েই প্রচার করে গিয়েছেন। দ্বিতীয় দফার ভোটের দিন সভা করেছেন মালদহে। তবে নীলবাড়ির লড়াইয়ে বাংলায় যতটা সময় দিয়েছিলেন, দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে তেমনটা পারছেন না কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। মোদীর উপরে যেমন গোটা দেশের প্রচার, তেমনই শাহের কাঁধে সব রাজ্যের সাংগঠনিক কাজে নজর রাখার দায়িত্ব রয়েছে। তার মধ্যেই তিনি সুকান্তের বালুরঘাট এবং মঙ্গলবার বর্ধমান পূর্বে সভা করেছেন। সময়াভাবে শেষ বেলায় বাতিল করেন কৃষ্ণনগরের সভা। রাজ্য বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, শাহের সভার চাহিদা থাকলেও এ বার নাকি যোগীর চাহিদা বেশি দক্ষিণবঙ্গের প্রার্থীদের মধ্যে। অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সফর দেখার দায়িত্বে রয়েছেন এমন এক বিজেপি নেতা বলেন, ‘‘রামমন্দিরের জন্যই যোগীর চাহিদা বেশি। আর শাহ সময় দিতে পারবেন কি না সেটা নিয়েও সবার চিন্তা রয়েছে। সভা আয়োজনের পরেও বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এ সবের জন্যই অনেকেই যোগীকে চাইছেন।’’
উত্তরপ্রদেশে দুর্নীতি এবং দুষ্কৃতী দমনে যোগী খুবই সফল বলে দাবি করে বিজেপি। এর পরে সদ্যই বিপুল আয়োজনে নতুন রামমন্দিরে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়েছে অযোধ্যায়। মোদীর হাতে উদ্বোধন হলেও এর পিছনে যোগীর ভূমিকা সবচেয়ে বড় ছিল। তাই বাংলায় রামের হাওয়া তুলতে যোগী বাড়তি সুবিধা করে দেবেন বলেও বিজেপি শিবির মনে করে। সেই সঙ্গে বক্তৃতায় উত্তাপ ছড়ানোর ক্ষেত্রেও দক্ষ তিনি। মঙ্গলবারই মুর্শিদাবাদে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘‘উত্তরপ্রদেশে রামনবমী এবং নবরাত্রিতে কোনও অশান্তি হয় না। কিন্তু বাংলায় রামনবমীর সময় হিংসা ছড়াল কেন? পশ্চিমবঙ্গের সরকারের কাছে আমার এই প্রশ্ন রইল।’’ সেই সঙ্গে তীব্র আক্রমণ শানিয়ে যোগী বলেন, ‘‘দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে বাংলার সরকার কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এই ঘটনা উত্তরপ্রদেশে হলে দুষ্কৃতীদের উল্টো করে টাঙিয়ে ঠিক করে দিতাম। এমন হাল করতাম, যাতে এদের সাত প্রজন্ম ভুলে যেত অশান্তি কেমন করে করতে হয়।’’ বাংলাকে হিন্দুবিহীন করার ষড়যন্ত্র চলছে বলেও দাবি করেন যোগী।
এর পরেই যোগীর চাহিদা বেড়ে গিয়েছে বলে বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে। কী ভাবে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীকে কমপক্ষে একটি সভার জন্য পাওয়া যায়, সেই আর্জি নিয়ে বিভিন্ন আসনের প্রার্থীদের ফোন আসতে শুরু করেছে। এমনটাই জানাচ্ছেন এই বিষয়টা দেখছেন এমন রাজ্য নেতাদের কাছে। যদিও রাজ্য সভাপতি সুকান্ত বলেন, ‘‘আমাদের দলে ওই ভাবে কিছু হয় না। দলই ঠিক করে কোন নেতা কোথায় যাবেন।’’ বাংলার নেতাদের উপরে ভরসা না রেখেই অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের পাঠানো হচ্ছে। এমন অভিযোগ তুলেছে বিজেপি বিরোধী শিবির। এর জবাবে সুকান্ত বলেন, ‘‘সর্বভারতীয় দলে এটাই হয়। আমিও তো গুজরাতের একটি আসনের দায়িত্ব পেয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রতি বুথে যা কর্মী, বাংলায় তা একটি মণ্ডলে থাকে না। আসলে বিজেপি মানে রাজ্যে রাজ্যে ভাগ নেই। বিজেপি মানে ভারতের দল।’’