গত ২৩ অক্টোবর ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটানোর জন্য শেখ হাসিনা সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা অসমে এসে যেভাবে ভারতের বিরুদ্ধে বিষোগার করেছেন আর নিজেদের পাপ ঢেকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন তা হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। যেখানে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সির দাবি, ‘বাংলাদেশে হিন্দুরা পুরোপুরি সুরক্ষিত রয়েছেন। কিন্তু সর্বত্র না হলেও ভারতের কিছু কিছু স্থানে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চলছে। তিনি আরও বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ আমাদের দেশ। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি রয়েছে। হাজার হাজার দুর্গাপুজো হচ্ছে প্রতিবছর। আমাদের লোকসভা কেন্দ্র রংপুরে এবার ১৫৬টি দুর্গাপূজা হয়েছে, আমি মণ্ডপে গিয়ে আনন্দ করেছি। গভীর রাত অবধি নাড়ু খেয়ে ঘুরছেন সকলে।
হাসিনার আর্থিক বিষয়ক উপদেষ্টা মশিউর রহমান দাবি করেন, ‘বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি উল্লেখযোগ্য। তবে সমাজে দু-একজন বদ মানুষ সব খানেই থাকে, তার জন্য গোটা দেশ বা জাতিকে বদনাম করা যায় না। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ভারতের মুসলমানরা নিরাপদ নন। সর্বত্র না হলেও কিছু কিছু স্থানে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। উত্তর ভারতের নানা স্থানে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। গোমাংস খাওয়া নিয়ে নির্যাতন করা হয় মুসলমানদের, ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করানো হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে খালেদা জিয়ার শাসনকালে যে নারকীয় অত্যাচার হিন্দুদের ওপর হয়েছে সেকথা বাদ রেখেও শুধু শেখ হাসিনা সরকারের আমলে হিন্দুদের ওপর যেরকম অত্যাচার চলছে সেগুলি আলোচনায় আনলে টিপু মুন্সি, মশিউর রহমানদের দাবি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতোই ব্যর্থ প্রয়াসে পরিণত হয়। মশিউর রহমানের দাবি মতো—“সমাজে দু-একজন বদ মানুষ সবস্থানেই থাকে, তারজন্য গোটা দেশ বা জাতিকে বদনাম করা যায় না তাহলে তার কথামতো ভারতে কি দু-একজন বদ মানুষ নেই? যদি থেকে থাকে তার জন্যে কি সমগ্র ভারত এবং হিন্দুসমাজকে দোষ দেওয়া যায় ? তবে বাংলাদেশ এবং ভারতেরমধ্যে একটা তফাত আছে। তা হলো ভারতে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ হলে দুষ্কৃতীদের শাস্তি হয়। কিন্তু বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হলে গুন্ডাদের শাস্তি হয় না। আর বাংলাদেশে হাজার হাজার দুর্গাপূজো হলেও প্রতিমা গড়ার শুরু থেকে পূজো শেষ হওয়া অবধি বহুস্থানে মূর্তি ভেঙ্গে দিয়ে পূজো বন্ধ করে দেয় গুন্ডারা। সেকথা কিন্তু তাদের বক্তব্যেই উঠে আসেনি। ভারতের মুসলমানরা নিরাপদ নন এই কথার প্রেক্ষিতে বলা যায়—ভারতে মুসলমানরা যতটা নিরাপদ ততটা নিরাপদ বিশ্বে আর কোনো দেশে তারা নন এমনকী কতকগুলি মুসলমান দেশেও নয়। চীনের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন সেখানে মুসলমানরা কী অবস্থায় আছেন।
যাই হোক, ২০০৮ থেকে হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশে হিন্দু। জনগোষ্ঠীর ওপর (তবে সব জায়গায় নয়, অনেক জায়গায়) যেরূপ সরকারি সন্ত্রাস নেমে এসেছে এবং গুন্ডাদের অত্যাচার বেড়ে গেছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো। অসম থেকে ১৬ জন বিএসএফ কর্মীকে টেনে নিয়ে। গিয়ে গণহত্যা, লিগ নেতা মন্ত্রী কর্তৃক টাঙ্গাইলে দেড় কোটি টাকার হিন্দু সম্পত্তি দখল, নাবালিকা রাধারানি কিংবা বিবাহের পূর্বেই দূবৃত্তদের মৌলি গাঙ্গুলির অপহরণ,ইসকন মন্দিরে ওসি হামালা, ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সম্পত্তি আত্মসাৎ, রমনা কালীবাড়ি জবরদখল, প্রকাশ্যে মন্দিরের পূজারি হত্যা, শ্মশান দখল, রামকৃষ্ণ মিশন আক্রমণ, বিশ্বজিৎ হত্যা, সুরজিৎ সেনগুপ্ত অবমাননা, খুন, গণহত্যা, ধর্মান্তরকরণ-সহ দীর্ঘ কালো তালিকার কোনও বিচার হয়নি হাসিনা সরকারের আমলে।
২০১৬ সালে ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী ধ্রুবেশ্বরানন্দ মহারাজ মুসলমান মৌলবাদীদের হুমকিতে খুন হওয়ার ভয়ে ঢাকা থেকে কলকাতায় পালিয়ে এলেন। বাংলাদেশে হিন্দুরা কত সুখে আছে তার একটা নজির তুলে দেওয়া হোলো। মাত্র কয়েকমাস আগে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট নেতা আইনজীবী পলাশ রায়কে থানার ভেতরে পড়িয়ে হত্যা করা হয়। গত ৩০ মার্চ দুপুর ১২.৪০ মিনিটে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে সুব্রত দাস-সহ আরও পাঁচটি হিন্দুর দোকান দখল করে প্রভাবশালী মুসলমানরা তাদের দেশছাড়ার নির্দেশ দেয়, অন্যথায় খুনের হুমকি দিয়ে যায়। সিলেটের গোপালগঞ্জে জমি সংক্রান্ত বিবাদের জেরে মসজিদের মাইকে ঘোষণা করে সেখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং ভাঙচুর চালায়। চলতি বছরে চট্টগ্রামে তিথি ও তার মাকে স্থানীয় মেম্বারের ছেলে ও তার দলবল মিলে গভীর রাতে ঘরে ঢুকে টানা চারবার গণধর্ষণ করে। নাটোর জেলার লালপুর থানার গোপালপুর গ্রামে দুপুর আড়াইটা নাগাদ এক পুরোহিতকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
গত ১৬ জুলাই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সামনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়া সাহা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থার বর্ণনা করে বলেছেন—“Sir I am from Bangladesh…. 37 million Hindus, Buddhist and Christians are disappeared. Please help us….. for the Bangladeshi minority people. We wnat to stay in our country. My request is please help us, we don’t want to leave our country, just help us to stay. I have lost my home, they have ‘burnt my house, occupied my land, but no judgement yet taken, Please help…….” অর্থাৎ—মহাশয়, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি….. ৩৭০ লক্ষ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। দয়া করে আমাদেরকে সাহায্য করন… বাংলাদেশি সংখ্যালঘু জনগণকে। আমরা আমাদের দেশে বসবাস করতে চাই। আমার অনুরোধ, দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন, আমরা আমাদের দেশ ত্যাগ করতে চাই না, কেবলমাত্র থাকার জন্য সাহায্য করুন। আমি আমার বাড়ি হারিয়েছি, তারা আমার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, সম্পত্তি দখল করেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনও সুবিচার পাইনি, দয়া করে সাহায্য করুন……।
প্রিয়া সাহার বক্তব্যের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশের সাহিত্যিক, পরিচালক এবং Weekly Bliting পত্রিকার সম্পাদক। সালাউদ্দিন শোয়েব চৌধুরীর কথা থেকে। তিনি ১২ জানুয়ারি ২০১১তে ওয়াশিংটনে বাংলা রেডিয়োতে এক খোলামেলা সাক্ষাৎকারে 76071, A Secular Govt. come to power in the year 2008, but things didn’t change much in Bangladesh. Every year almost sixteen thousand Hindu women in Bangladesh are kidnapped and converted to Islam forcefully. The numbers have not changed in the year 2011. অর্থাৎ ২০০৮ সালে বাংলাদেশে সেকুলার সরকার ক্ষমতায় এলেও বাংলাদেশের অধিকাংশ অবস্থার বাস্তবিক কোনো পরিবর্তন আসেনি। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১৬ হাজার হিন্দু মহিলা অপহৃত হয় এবং বাধ্য হয়ে তারা ইসলাম গ্রহণ করেন। ২০১১তে এসেও এই সংখ্যা কমেনি মোটেও।
প্রিয়া সাহা এবং সালাউদ্দিন সাহেবের কথার সমর্থন মেলে সেখানকার এক অধ্যাপকের কথায়। সাম্প্রতিক অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আবুল বরকত সাহেব তার চাঞ্চল্যকর গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। যে, হিন্দুদের প্রায় ২৬ লক্ষ একর জমি জবরদখল করা হয়েছে, আর যেভাবে হিন্দুরা নির্যাতনের শিকার হয়ে গড়ে প্রত্যহ প্রায় ৬৩০ জন হিন্দু দেশত্যাগ করছে তাতে আগামী কুড়ি বছরে হিন্দু শব্দটি বাংলাদেশ থেকে চিরতরে মুছে যাবে।
প্রিয়া সাহার অভিযোগের আগে বাংলাদেশের শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার একটি মামলার রায় সরকারের বিপক্ষে যাওয়ায় তাকে নিজ দেশেই সরকারি নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়ে অন্য দেশে শরণার্থীর আশ্রয় ভিক্ষা করতে হচ্ছে। একজন শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতির যদি এই হাল হয়, তাহলে সাধারণ হিন্দুদের কোনো বিচার পাওয়ার আশা করা যায় কি?
এবারে দেখা যাক বাংলাদেশের প্রথম সারির সংবাদপত্রগুলি কী লিখছে। ১। প্রথম আলো’—১৩ জানুয়ারি ২০১৭তে লিখেছে—“বাংলাদেশ সংখ্যালঘু পরিস্থিতি ২০১৬’ শীর্ষক প্রকাশ করে জানায়—২০১৬ সালে ২০১৫ এর তুলনায় সাড়ে পাঁচগুণেরও বেশি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বাংলাদেশে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। ২০১৬ তে ৭১ জন সংখ্যালঘুকে হত্যা করা হয়েছে, ১২৪ জনকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়, ৭৭টি হিন্দু মন্দিরে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হন ৩২ জন।
২। অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুসারে। ২০১৮তে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ৮০৬টি, হত্যা ১০ জন, প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন ১৭ জন, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৮ জন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ি লুঠ ও উচ্ছেদের সংখ্যা ১৯৩টি, দেশত্যাগের হুমকি ১৭ জনকে, ধর্মান্তরকরণ ১০৪ জনকে, মঠ-মন্দিরে হামলা ৭২টি। এছাড়া খবরের বাইরে থাকা ঘটনা যে কত ঘটছে তার হিসাব পাওয়া মুশকিল।
কোদালকে কোদাল বলাই ভালো। দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ৩০ শতাংশ। তা কমতে কমতে বাংলাদেশ। স্বাধীন হওয়ার সময় ১৯ শতাংশে নেমে আসে। সেই সংখ্যা কমে এখন হয়েছে ৮ শতাংশ। তাহলে বাংলাদেশ যদি সত্যিকার অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ হয় এবং হিন্দুরা নিরাপদে থাকে তবে ১১শতাংশ হিন্দু কোথায় গেল—টিপুমুন্সি, মশিউর রহমান সাহেবরা সে উত্তর দেবেন কি? এই সংখ্যাতাত্ত্বিক পাটিগণিত থেকে সহজেই বোঝা যায় বাংলাদেশে চলছে হিন্দু বিতাড়নের ধারাবাহিকতা—শত্রু সম্পত্তি আইন পরবর্তীকালে ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ বলে ভূমি লুণ্ঠনের প্রক্রিয়া সে দেশে এখনও বলবৎ। অনেকদিন আগে একবার ভারত-বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলা হয়েছিল। সেই খেলায় জিতেছিল ভারত। ক্যাপ্টেন ছিলেন আজাহারউদ্দিন। আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হাসিনা। তিনি টিভির সাক্ষাৎকারে ক্রিকেটের ফলাফল বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সবই ভালো লাগছে কিন্তু একটা হিন্দুর হাতে পুরস্কার তুলে দিতে হচ্ছে। এটাই খুব খারাপ লাগছে। একটা দেশের প্রধানের কি মধুর বচন তাই না? এই হাসিনার আমলে ডব্লুবিসিএস পাশ একটা হিন্দু ছেলেকে একটা অফিস থেকে বলা হয়েছিল, “চাকরি? ভারতে পালা, এখানে তোর কী?” এক জনপ্রিয় সংবাদপত্রের খবর।
অধুনা বাংলাদেশে আর সোনার বাংলার ছাপ নেই, ছায়া নেই। সোনার বাংলা মরে গেছে। সেই মাটি রয়েছে ঠিকই, সেই নীল আকাশে। চিলও উড়ছে, সবুজ বনানীতে চারিদিক ছায়া ঢাকা, শ্যামল শস্যক্ষেতের উপর সবুজের ঢেউ খেলছে আগের মতোই। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার জলেও ছলছলাৎ ঢেউ উঠছে, যেমন উঠত সেই সুদূর অতীতে। কিন্তু বাংলাদেশিদের ভাটিয়ালি মন ও ভাওয়াইয়া বিবেকে পচন ধরেছে। লোভলালসা ও কামকামনার কুপ্রবত্তি মনের। সুকুমার বৃত্তিগুলিকে নােংরা করে দিয়েছে। তার মাঝে গুটিকয় লোকের রবীন্দ্র সংগীত ও নৃত্যনাট্য সে পচন রোধে ব্যর্থ। বাংলাদেশের এই পরিণতি অবধারিত ছিল। কাজেই নিশ্চিত বলা যায় বাংলাদেশে হিন্দুরা সুরক্ষিত নন, বরং ভারতেমুসলমানরা সুরক্ষিত। তাই ভারত ছেড়ে মুসলমানদের অন্যদেশে আশ্রয় নিতে হয় না। বাংলাদেশে হিন্দুরা সুরক্ষিত—এটা বলা সত্যের অপলাপ মাত্র।
মণীন্দ্রনাথ সাহা
2019-11-08