রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশই বহাল রাখল সুপ্রিম কোর্ট। সব জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন। মঙ্গলবার সেই মামলার শুনানিতে অবাধ ও স্বচ্ছ ভোটের জন্য হাই কোর্টের নির্দেশই বহাল রাখল সুপ্রিম কোর্ট। অর্থাৎ, সব জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করেই ভোট করতে হবে। খারিজ হয়ে গেল রাজ্য এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আর্জি।
শুনানিতে কী হল
সুপ্রিম কোর্টে মঙ্গলবার এই মামলার শুনানি হয় বিচারপতি বিভি নাগরত্ন এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চে। বিচারপতি নাগরত্ন বলেন, ‘‘আপনারা পাঁচ রাজ্য থেকে পুলিশ চেয়েছেন। আর হাই কোর্ট কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে বলেছে। খরচ তো কেন্দ্র দেবে। আপনাদের অসুবিধা কোথায়? তা ছাড়া ভোটে আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে কেন্দ্রীয় বাহিনী হলে সমস্যা কোথায়?’’ রাজ্যের আইনজীবী বলেন, ‘‘রাজ্যের পুলিশ যথেষ্ট সমর্থ। পুলিশকর্মী কম থাকায় অন্য রাজ্য থেকে পুলিশ চাওয়া হয়েছে। সব রকম প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে হলে পরিকল্পনা বদল করতে হবে। নির্বাচনের মুখে যা সমস্যার।’’
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী বলেন, ‘‘নির্বাচন ঘোষণার পরের দিনই মামলা করা হয়ে গেল। তখন মনোনয়ন পর্ব চলছে। মনোনয়ন পর্বে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মনোনয়ন কেন্দ্রের ১ কিমি পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। রাজ্যের পুলিশ সহযোগিতা করেছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘হাই কোর্ট কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের কথা বলেছে। আমাদের স্পর্শকাতর বুথ চিহ্নিত হয়নি। আমাদের সেই কাজ চলছিল। তা ছাড়া নিরাপত্তার বিষয়টি রাজ্য দেখে। এখানে কমিশনকে সরাসরি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।’’
এ কথা শোনার পর বিচারপতি নাগরত্ন বলেন, ‘‘নিরাপত্তা ব্যবস্থা আপনাদের উপর নয় তা হলে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে চিন্তিত কেন? আপনারা আপনাদের কাজ করুন। যেখান থেকেই বাহিনী আসুক, আপনাদের অসুবিধা কোথায়?’’ এর পর কমিশনের আইনজীবী বলেন, ‘‘শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য আমরাও উপযুক্ত নিরাপত্তার দাবি করি। কিন্তু এখানে হাই কোর্ট আমাদের উপর নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী চাইতে। সেটা আমরা কী ভাবে করব? এটা আমাদের কাজ নয়।’’
বিচারপতি নাগরত্ন বলেন, ‘‘ভোটে কোনও রকম অশান্তি হবে সেটা আশা করা যায় না। অতীতে রাজ্যে হিংসার ঘটনার উদাহরণ রয়েছে। এই অবস্থায় হাই কোর্ট পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েছে। সেখানে অসুবিধার কিছু দেখছি না।’’
রাজ্যের আইনজীবী বলেন, ‘‘কোনও বুথ, এলাকা নয়। সারা রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। রাজ্যকে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়েছে।’’ বিচারপতি নাগরত্ন বলেন, ‘‘এটা তো অন্য কোনও পরিস্থিতির জন্য নয়। নির্বাচনের জন্য। এখানে অন্য ভাবে দেখবেন কেন?’’ বিজেপির আইনজীবী হরিশ সালভে বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের নীরবতার কারণেই হাই কোর্ট কেন্দ্রীয় বাহিনীর নির্দেশ দিয়েছে। ওই রাজ্যে কমিশন সম্পূর্ণ রাজ্যের উপর নির্ভরশীল। কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে তাদের আপত্তি রয়েছে। ভোটকে কেন্দ্র করে সেখানে একাধিক ঘটনা ঘটেছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘নির্বাচনের নির্ঘণ্ট দেখলে হাই কোর্টের নির্দেশ পরিষ্কার হবে। নির্বাচন ঘোষণা হয়েছে ৮ জুন। হাই কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে ১৫ জুন। অর্থাৎ, তার আগে পর্যন্ত তাদের কোনও পরিকল্পনায় চোখে পড়েনি। তারা স্পর্শকাতর বুথ চিহ্নিতই করতে পারে। আর কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরোধিতা করে তারা বলছে সব পরিকল্পনা পূর্বের করা ছিল। কোথায় পরিকল্পনা?’’
ভোটকর্মীদের নিরাপত্তার স্বার্থে কেন্দ্রীয় বাহিনীর আবেদন জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চও। তাদের আইনজীবী বলেন, ‘‘গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসার নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। এই অবস্থায় আমরা কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েই ভোট চাই।’’
আগে যা ঘটেছে
আগামী ৮ জুলাই পঞ্চায়েত নির্বাচন। কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করানোর দাবিতে প্রথম থেকেই সরব বিরোধীরা। পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন-পর্ব ঘিরে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় রক্তপাত, বোমাবাজি, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এই আবহে রাজ্যের সব জেলাতেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। গত বৃহস্পতিবার ওই নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে বলা হয়েছিল, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে আবেদন করতে হবে তাদের। প্রথমে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহ জানিয়েছিলেন, আদালতের নির্দেশ মতোই পদক্ষেপ করা হবে। কিন্তু তার পরই অবস্থান বদল করে কমিশন। এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শনিবার শীর্ষ আদালতে আবেদন করে কমিশন। ওই দিনই শেষ হয় ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা।
সোমবার সুপ্রিম কোর্টে কমিশন জানায়, হাই কোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছে, তা কার্যকর করা সম্ভব নয়। কারণ, ভোটে নিরাপত্তার বিষয়টি দেখে রাজ্য। এ ব্যাপারে অনুরোধ করা তাদের কাজ নয়। ফলে রাজ্যের নিঃস্পৃহতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আবার হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয় বিরোধীরা। তারা অভিযোগ করে, হাই কোর্ট নির্দেশ দিয়ে সময় বেঁধে দেওয়ার পরও কমিশন পদক্ষেপ করেনি। এতে আদালতের অবমাননা করা হয়েছে। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং কংগ্রেস সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরী ওরফে ডালুর আবেদন গ্রহণ করে হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম সেই মামলা দায়েরের অনুমতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে, প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, কমিশন যে হাই কোর্টের নির্দেশ কার্যকর করেনি, তা সংবাদপত্র মারফৎ জানতে পেরেছেন তিনিও।
এর আগে, পঞ্চায়েত মামলা নিয়ে হাই কোর্টের বৃস্পতিবারের রায়ের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টে ‘ক্যাভিয়েট’ দাখিল করেন শুভেন্দু এবং দক্ষিণ মালদহের কংগ্রেস সাংসদ ডালু। তাঁদের নোটিস না-পাঠিয়ে এক তরফা শুনানির মাধ্যমে রাজ্য সরকার বা রাজ্য নির্বাচন কমিশন যাতে হাই কোর্টের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ পাওয়ার চেষ্টা করতে না পারে, সেই উদ্দেশ্যেই এই ‘ক্যাভিয়েট’ করা হয়েছিল।