শ্রীলা প্রভুপাদ যখন ধর্ম-প্রচারের উদ্দেশ্যে বিদেশ যাত্রা করেন, তাঁর অনুপ্রেরণা ছিল শ্রী চৈতন্যদেবের বলা দুটো মাত্র লাইন। “দিকে দিকে আছে যত নগর-বন্দর-গ্রাম; সর্বত্র প্রচারিত হইবে মোর নাম।” এটাকেই ঐশ্বরিক আদেশ ধরে নিয়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা বেরিয়ে পড়েছিলেন অজানার উদ্দেশ্যে। এই আদেশ মাথায় নিয়েই শ্রী শান্তিদেব গোঁসাই মণিপুরে ধর্মবিজয় সম্পন্ন করেন। হিন্দু প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে গৌড়ীয় বৈষ্ণব মঠ-ই যে সবার প্রথমে ইউরোপে স্থাপিত হয়, তারও পিছনে রয়েছে সেই সুস্পষ্ট ধর্মীয় নির্দেশ। বেরিয়ে পড়ো, নাম-প্রচার করো। শ্রী চৈতন্যদেব বলে গিয়েছেন, আর ভক্তরা করে দেখিয়েছেন।
১৭ এবং ১৮ শতকের যে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ, তার পিছনেও রয়েছে সেই ঐশ্বরিক আদেশ। ইউরোপের খ্রিস্টানদের মধ্যে এই ধর্মীয় বিশ্বাস তো ছিলই যে যীশু খ্রিস্ট বলে গিয়েছেন সকলের মধ্যে খ্রীষ্টে বিশ্বাস আনার কথা। কিন্তু এই ঐশ্বরিক বিশ্বাসকে একেবারে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান জন ক্যালভিন। ক্যালভিন এই মতবাদ প্রচার করেন যে, ঈশ্বরকে খুশি করতে হলে শুধু নামপ্রচারই যথেষ্ট নয়। ঈশ্বরের জন্য দানধ্যানও করতে হবে। বেশি বেশি করে টাকাপয়সা, ধন-সম্পদ, জমি-বাড়ি ইত্যাদি দান করতে হবে। যে খ্রিস্টান গির্জার জন্য যত বেশি দান করতে পারবে, তার উপর ঈশ্বর তত বেশি খুশি হবেন। তাই ঈশ্বরকে খুশি করার জন্য সম্পদ লুটতে দিকে দিকে বেরিয়ে পড়েছিল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের দল। কেউ গেল এশিয়াতে, কেউ আফ্রিকায়, কেউ ল্যাটিন আমেরিকার। লুন্ঠিত সম্পদের এক ভাগ ঈশ্বরের, বাকি ভাগ নিজেদের। যে যত বেশি লুঠ করতে পারবে, সে তত বেশি গির্জায় দান করতে পারবে। আর যে সব থেকে বেশি দান করবে, সে সবার চাইতে বেশি ঈশ্বরের করুণা লাভ করবে।
ইংরেজরা যে ভারতে এসে পুরোপুরি জাঁকিয়ে বসল, এর মুলেও রয়েছে সেই ক্যালভিনবাদের জনপ্রিয় হওয়া। আজকে যে বাঙালি বাচ্চাদের দুলে দুলে “এ ফর আপেল, বি ফর বড় আপেল” মুখস্থ করতে হয়, তার মূলেও রয়েছে সেই ক্যালভিন লিখিত ঐশ্বরিক আদেশ। সেই আদেশের বলেই ইউরোপীয়দের মধ্যে ভিনদেশ দখলের উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। সেই উন্মাদনা থেকেই বিশ্ব জুড়ে ইংরেজ এবং ইংরেজির আধিপত্য।
আরব্য-দের জগৎ-জোড়া সাম্রাজ্যের ভিত্তিও দৃঢ়ভাবে গাঁথা রয়েছে তাদের ধর্মীয় নির্দেশনায়। পরিষ্কার বলা রয়েছে কোথায়, কিভাবে অন্য ধর্মীদের উপর বিজয় প্রাপ্ত করতে হবে। পরিস্থিতির বিচার করে যুদ্ধের পদ্ধতি পাল্টাতে পারে, লক্ষ্য পাল্টাবে না। লক্ষ্য একটাই, এই পৃথিবীর দিকে দিকে আরবের পতাকা তুলে ধরা।
সাধারণ বাঙালিরা বেশিরভাগই এই ঐশ্বরিক নির্দেশ সম্পর্কে অচেতন। তারা জানেই না, বিশ্বের বড় বড় ধর্মগুলোতে পরিষ্কার ঐশ্বরিক আদেশ রয়েছে অন্য ধর্মের অনুসারীদের নিজের ধর্মে আনার। যে গুটি কয় বাঙালি এই বিষয়টা জানেন যে অন্যান্য ধর্মের ঈশ্বরের আদেশ রয়েছে বিধর্মীদের ধর্মান্তর করার, তারাও বিষয়টাকে ঘৃণার চোখে দেখেন। মোদ্দা কথা, বাঙালিরা ধর্মপ্রচারের ঐশ্বরিক আদেশ-এর গুরুত্ব বুঝতে পারেননি। এই কারণেই শাক্তরা পারেনি কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা পেরেছেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা ধর্মপ্রচারের ঐশ্বরিক আদেশকে মাথায় তুলে রেখেছেন এবং সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছেন। শাক্তরা এরকম আদেশ খুঁজে পাওয়া তো দূরের কথা, খোঁজার চেষ্টাও কখনো করেননি।
এজন্যই স্বামী বিবেকানন্দের পর, শাক্ত মত সম্পুর্ন বিফল হয়েছে। ঐশ্বরিক আদেশ বিহীন শাক্ত ক্রমাগত দুর্বল হয়েছে। নিজস্ব মতের স্বকীয়তা হারিয়ে শাক্ত ক্রমেই বৈষ্ণবের রূপ নিচ্ছে। মাছ-মাংস খাওয়া উদগ্র চন্ডীর ভক্তরা “তরুবৎ সহিষ্ণু, তৃণবৎ কোমল” নিরামিষভোজী বোষ্টুম-দের কাছে বলে বলে হারছে। কারণ, ঐশ্বরিক আদেশ কেবলমাত্র ধর্মীয় নির্দেশ নয়; এটা প্রত্যেকটা ধার্মিকের চিরকালীন অনুপ্রেরণা এবং অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। কোন ধর্মে কতটা সারবত্তা আছে, সেটা গুরুত্বপূর্ন নয়। গুরুত্বপূর্ণ হল, সেই ধর্মে ঐশ্বরিক আদেশ আছে না নেই? থাকলে সেটা ভক্তদের জীবনে কতটা ভূমিকা পালন করছে?
শাক্ত বাঙালি যদি নিজেকে ভারত-শ্রেষ্ঠ কিংবা বিশ্ব-গুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়; তবে প্রথমেই তাকে নিজস্ব শাস্ত্রের মধ্যে এরকম ঐশ্বরিক আদেশ খুঁজে বের করতে হবে। যেটা তাকে নির্দেশ দিচ্ছে- “বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ো, আমার নাম প্রচার করো।” শ্রী শ্রী চন্ডী, মঙ্গল কাব্য, খনার বচন জুড়ে খুঁজুন। তারপর তাতে গভীর বিশ্বাস আনুন। বিশ্বাস একটা বিরাট বড় চালিকা শক্তি। ঐশ্বরিক আদেশ ঠিক করে দেবে তার অভিমুখ। বাঙালি হিন্দুর জীবন-মরণ বাঁধা পড়ে আছে ওই বিশ্বাসের কাছে। ধর্ম শুধু দিব্যজ্ঞানের কথা বলে না, কাণ্ডজ্ঞানের কথাও বলে। ধর্মীয় কাণ্ডজ্ঞান-এর মূর্ত প্রমাণ হল ঐশ্বরিক নির্দেশ। ঐশ্বরিক আদেশ বিহীন ধর্মমত হল গোলা ছাড়া কামানের মত। আধ্যাত্মিকতা, পবিত্রতা, বিশুদ্ধতা দিয়ে ধর্ম বাঁচে না। ধর্মের আসল জিয়ন কাঠি হচ্ছে ঐশ্বরিক আদেশ।
ঐশ্বরিকআদেশএবংহিন্দুধর্ম #Religion_And_Divine_Justification