সময়যন্ত্রকে বশ করা ছিল তাঁদের পারিবারিক পেশা। পাঁচ পুরুষের এই পেশায় স্বপন দত্ত হাত পাকিয়েছেন সেই ছোটোবেলাতেই। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি পাকাপাকিভাবে এই পেশাতে এসে পড়েছিলেন বাপ-ঠাকুরদার দেখাদেখি। বছর ৭৫-এ এসে তাই তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিতে অনেক গল্প। শোনা যায়, এককালে রাজারাজড়াদের আমলে তাঁর পূর্বজদের তলব করার সময় পাঠানো হত জুড়ি গাড়ি। প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী, ঐতিহাসিক ছোটো-বড়ো-মাঝারি অনেক ঘড়ির গঠন, চলন, শৈলী সবই ঘড়িওয়ালার মুখস্থ। কলকাতা ও আশেপাশের শহরতলি জুড়ে যত বড়ো বড়ো ঘড়ি বা ক্লক টাওয়ার রয়েছে, সে সব রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাঁরই। পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে কলকাতার বনেদি ঘড়িগুলি বাঁচিয়ে রেখেছেন এই ঘড়িবাবু।
আমাদের একালে পকেটে রেস্ত বাঁচাতে ব্যাটারি দেয়া শৌখিন ঘড়ি ব্যবহার করি। কিন্তু ঘড়িওয়ালাদের মতে, আভিজাত্য আসলে বজায় থাকে দম দেওয়া ঘড়িতেই। সত্যজিৎ বলেন, “শখ, শৌখিনতা বা আভিজাত্য বোঝাতে দম দেওয়া মেকানিক্যাল ঘড়িই সেরা। বড়ো বড়ো কোম্পানির দামি ঘড়ি কিন্তু ব্যাটারিচালিত হয় না। একটা মেকানিক্যাল ঘড়ি অনেক দীর্ঘমেয়াদি কাজ করে।
ঔপনিবেশিক কলকাতায় বড়ো বড়ো টাওয়ার ক্লকগুলি ছিল একদা ইংরেজ রাজত্বের স্বাক্ষর। শোনা যায়, ইংরেজরা নাকি তাঁদের পরাধীন মানুষগুলির জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে এই টাওয়ার ক্লক নির্মাণ করাতেন। সারা কলকাতা শহর ঘুরলে এমন প্রচুর টাওয়ার ক্লকের সন্ধান মিলবে আজ। হাওড়া স্টেশনের বিখ্যাত বড়ো ঘড়ি, জিপিও-র ঘড়ি, রাজ ভবনের উত্তর পশ্চিমের দৈত্যাকৃতি ঘড়ি এসবই ঔপনিবেশিক স্থাপত্য। আবার পরাধীন দেশে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ইংল্যান্ডের উইন্সর ক্যাসেলের অনুকরণে কলকাতার বুকে টেগোর ক্যাসেলে ১০০ ফুট উঁচু টাওয়ার তৈরি করেছিলেন। শোনা যায়, বাড়িটির জন্য ইংল্যান্ড থেকে বিগবেনের আদলে ঘড়ি আনিয়েছিলেন তিনি।
স্থপতিরা আজ আর এখানে নেই। তাই ঘড়ি দেখাশোনার ভার এ শহরের ঘড়িওয়ালার। পর্তুগিজদের তৈরি হুগলির ব্যান্ডেল চার্চের পেল্লাই ঘড়ি থেকে হাল আমলের কলকাতার লেকটাউনে অবস্থিত ক্ষুদ্র সংস্করণে বিগ বেন, সব্বার ঠিকুজি-কুষ্ঠি তাঁর মুখস্ত। গড়গড় করে বলে দিলেন তিনি, “লেকটাউনের ঘড়িটায় সাড়ে ১৩ ফুট ডায়াল আছে। আর মানিকতলার বড়ো ঘড়িটার সংখ্যাগুলো বাংলায় লেখা। কলকাতায় ওরকম আর দ্বিতীয়টি নেই। ঘড়ির সংখ্যাগুলো নানাভাবে লেখাও দেখেছি। সে নিয়ে নেপালে সমস্যায় পড়েছিলাম।”
এত বড়ো বড়ো ঘড়ি রক্ষণাবেক্ষণ হয় কীভাবে? ঘড়িওয়ালা বললেন, “এই সব ঘড়িগুলির এএমসি (বাৎসরিক রক্ষণাবেক্ষণ খরচ) চুক্তি করা রয়েছে। চাবি দেওয়া, সঠিক সময়ে তেল দেওয়া, নজরদারির ব্যাপার রয়েছে কিনা। ঘড়ি মানেই সূক্ষ্ম কাজ। সে সবের জন্য আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া লোকজন আছেন। তাঁরাই সপ্তাহে অন্তত দুবার গিয়ে সে সব দেখাশোনা করেন।”
বৌবাজারের মদনগোপাল লেনে তাঁর এক চিলতে দোকানে এসব নিয়ে কথা বলতে বলতে আমি নিজেও অনেকটা নস্টালজিক হয়ে পড়েছিলাম। মামার বাড়িতে একটা পেণ্ডুলাম ঘড়ি ছিল। দাদু যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন সে ঘড়ির দম দিতে ভুল হয়নি। ঘড়ির সময় ছিল কাঁটায় কাঁটায় আকাশবাণী কলকাতার সঙ্গে মেলানো। সকাল সাতটায় সাতটি ঢং ঢং করে শব্দ মানেই দাদুর রেডিওতে ‘প্রাত্যহিকী’ শুরু হয়ে যেত। আজও মনে পড়ে দুপুর একটার ঘণ্টা বাজলেই দাদুর মধ্যাহ্নভোজের থালা পরিবেশিত হত। তখনও আমাদের বাঙালি সমাজে আজকের মতো থালি প্রীতি হয়নি। একটার পর একটা ভাজা, তরকারি শেষ করে দাদু দই মিষ্টির দিকে এগিয়ে যেতেন ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সঙ্গেই।
দোকানটার নাম ‘সোনো টাইম’। বৌবাজার এলাকায় হাঁটি হাঁটি পা পা করে কুড়ি-পঁচিশ বছর হয়ে গেল। স্বপনবাবুর হাতে গড়ে উঠেছে এই দোকান। দেখলাম, কত রকমের ঘড়ি নিয়ে তাঁরা কাজকর্ম করে চলেছেন – টাওয়ার ক্লক, মাস্টার ক্লক, টাইম রেকর্ডিং ক্লক, ফাদার ক্লক। এসব হরেক ঘড়ির ইতিহাস ভূগোল গল্প মনে রেখে দিয়েছেন ঘড়িবাবু স্বপন দত্ত। অভিজ্ঞ ডাক্তার যেমন রোগীর নাড়ি টিপে রোগ নির্ধারণ করেন, তেমনি পুরোনো ঘড়ি সারাই করতে যখন কেউ এখানে এসে পৌঁছান, তাঁদের ঘড়িওয়ালা ডাক্তারের মতোই ভরসা যোগান। এখন দোকানের হাল ধরেছেন তাঁর বড়োছেলে সত্যজিৎ। তিনি বলেন, “বাবাকে দেখেই কাজ শিখেছি। শুধু কাজ নয়, এটা আমাদের ভালোবাসাও।”
সারা কলকাতা শহর ঘুরলে এমন প্রচুর টাওয়ার ক্লকের সন্ধান মিলবে আজ। হাওড়া স্টেশনের বিখ্যাত বড়ো ঘড়ি, জিপিও-র ঘড়ি, রাজ ভবনের উত্তর পশ্চিমের দৈত্যাকৃতি ঘড়ি এসবই ঔপনিবেশিক স্থাপত্য। আবার পরাধীন দেশে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ইংল্যান্ডের উইন্সর ক্যাসেলের অনুকরণে কলকাতার বুকে টেগোর ক্যাসেলে ১০০ ফুট উঁচু টাওয়ার তৈরি করেছিলেন। শোনা যায়, বাড়িটির জন্য ইংল্যান্ড থেকে বিগবেনের আদলে ঘড়ি আনিয়েছিলেন তিনি।
উজ্জ্বল চোখে একসময় ঘড়িওয়ালা নেপালের সেই ঘটনার উল্লেখ করলেন। কী ছিল সেই ঘটনা? নেপালের রাজপরিবারের এক বড়ো ঘড়ি বিগড়েছে। ভারত থেকে লোক পৌঁছল। তিনি অবশ্য আর কেউ নন, ঘড়িওয়ালা স্বপন দত্তই। তিনিই সারাই করলেন সেই ঘড়ি। নেপাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ এই ঘড়ি নিয়ে সংবাদমাধ্যম উৎসাহী ছিল। তাই ঘটা করে সে খবর বেরোয়। কিন্তু সংবাদ বেরোয়, ভারতের ঘড়ির কারিগর এ কী করলেন? এমন ভুল?
ভয় পেয়েছিলেন তিনিও। রীতিমতো বিদেশের মাটিতে তাঁর কী ভুল হল? ঘড়ির রোমান চার অর্থাৎ IV লেখার বদলে তিনি বসিয়েছিলেন চারটে রোমান ওয়ান (IIII) যেটার অর্থও চার। কিন্তু তা ভুল বলে নেপালের সংবাদমাধ্যম দাবি করে। তারপর সাংবাদিকদের ডেকে ঘড়িওয়ালা প্রমাণ দেখান আরও পুরোনো ঘড়ির, যার ডায়ালে ছিল IIII, তারপর তাঁর অব্যাহতি মেলে।
সভ্যতার বিবর্তনে মোবাইল আসার পর ঘড়ি পরার চল অনেকটাই কমে গিয়েছে। মোবাইলেই ঘড়ি দেখার অভ্যেস অনেকের তৈরি হয়েছে। তবুও ঘড়ি কিন্তু টাইপ রাইটারের মতো বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। ঘড়ির কদর আছে যেমন, তেমনই ঘড়ি ব্যবহারের আলাদা ‘ক্লাস’ আছে। সেই শ্রেণিও আবার দু-ভাগে বিভক্ত। ব্যাটারি চালিত ঘড়ি আর দম দেওয়া ঘড়ি। আমার দাদুর পেণ্ডুলাম দেওয়া ঘড়িটার সময় মেনে দুপুরের খাওয়া, বিকেলের হাঁটা, রাতের শোওয়া বেশ পরিষ্কার মনে পড়ে যাচ্ছে। এটা একটা সেকেলে ‘ক্লাস’ বটে। আমাদের একালে পকেটে রেস্ত বাঁচাতে ব্যাটারি দেয়া শৌখিন ঘড়ি ব্যবহার করি। কিন্তু ঘড়িওয়ালাদের মতে, আভিজাত্য আসলে বজায় থাকে দম দেওয়া ঘড়িতেই। সত্যজিৎ বলেন, “শখ, শৌখিনতা বা আভিজাত্য বোঝাতে দম দেওয়া মেকানিক্যাল ঘড়িই সেরা। বড়ো বড়ো কোম্পানির দামি ঘড়ি কিন্তু ব্যাটারিচালিত হয় না। একটা মেকানিক্যাল ঘড়ি অনেক দীর্ঘমেয়াদি কাজ করে। ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করলে চার পাঁচ পুরুষ একটা ঘড়ি হেসে-খেলে ব্যবহার করতে পারবেন।” বৌবাজারে সত্যজিৎ দত্তের পৈতৃক ব্যবসা মেকানিক্যাল ঘড়িরই। সে কথা টেনে তিনি বললেন, “আমরা ব্যাটারি দেওয়া ঘড়ির কাজ করি না। সব পুরোনো ধাঁচের মেকানিক্যাল ঘড়ি আমাদের কাজের।”
আধুনিকতা আর সৌন্দর্যায়নের চোটে অবশ্য এই শহরটার ক্লক টাওয়ারগুলোর গঠন যেন ক্রমেই বদলে যেতে শুরু করেছে। লেকটাউনের বিগ বেন ছাড়াও আরও চারটে নতুন ক্লক টাওয়ার তৈরি হয়েছে কলকাতায়। হেরিটেজ রক্ষকরা অবশ্য মনে করেন, প্রাচীন ঔপনিবেশিক ঘড়িগুলির মতো মেকানিক্যাল ঘড়ি সেগুলো নয়। সেগুলি ইলেকট্রনিক। অতীতের ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে যাওয়ার যোগ্য নয় সেগুলি। নান্দনিকতার দিক থেকেও এখনও পুরোনো ক্লক টাওয়ারগুলো অনেক এগিয়ে। সেগুলো চালু রাখার সফল দায়িত্বই ঘড়িওয়ালার।
তবে সামগ্রিকভাবে ঘড়ির জন্য সেই উন্মাদনা আর একালে নেই, সেটা বলতেই হয়। চাপা দীর্ঘশ্বাসের সুরে স্বপনবাবু বলেন, “একসময় আমার মামাবাড়ির দাদু এই ঘড়ির পেশায় ছিলেন। এখন আর মামাবাড়ির দিকে কেউই এই পেশায় নেই। আমার দুই ছেলের মধ্যে ছোটো ছেলে এদিকে আসেনি। টিমটিম করে এই কাজ টিকে রয়েছে বড়ো ছেলের হাত ধরেই।”
“©পায়েল সামন্ত
©