বালুচিস্তান বারুদের স্তূপে যে কোনো সময় ফেটে পড়তে পারে

প্রায় ৩৪৭১৯০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে পাকিস্তানের একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বালুচিস্তান প্রদেশ, পাকিস্তানের। চারটি প্রদেশের অন্যতম। এর জনসংখ্যা ১ কোটি ২৩ লক্ষ, পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ যদিও আয়তনে। এটা পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ, প্রায় ৪৩ শতাংশ। এর আছে অপরিমেয় প্রাকৃতিক সম্পদ আর পাকিস্তানের বিদ্যুৎ শক্তির প্রায় সবটাই এখানে। পারস্য উপসাগরের তেলকূপের এলাকায় এর অবস্থান, ঠিক যেখানে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরান। মিশেছে সেই ত্রিভুজের মুখে। সেই কারণে। ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে এটা পাকিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাকিস্তানের সমগ্র উপকূল অঞ্চলের বেশিরভাগই এর মধ্যে পড়ে— আরব সাগরের প্রায় ৪৭০ মাইল।
সামন্ততান্ত্রিক প্রভুরা স্বেচ্ছাচারীভাবে। এই জায়গাটা চালায়। ঐতিহাসিকভাবে এটা। ছিল বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠীর একটা আলগা সংগঠন। ইতিহাসের নানা সময়ে তারা কখনো পারস্য সম্রাটের অধীনে কখনো বা আফগানিস্তানের রাজার অধীনে অতিবাহিত করেছে। এর মূল জাতিসত্তা পাকিস্তানের বৃহত্তর অংশের থেকে স্বতন্ত্র। বেশিরভাগ সময়ে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তারা বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন এমনকী স্বাধীন রাষ্ট্রও দাবি করে এসেছে যেখানে। তারা পাকিস্তান, ইরান ও আফগানিস্তান জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ৫০ লক্ষ বালুচিকে একত্রিত করবে। পাকিস্তান নিজে জানে যে এর সামাজিক-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারেণ পড়শী দেশগুলোর পক্ষে এখানে ঢুকে পড়া সুবিধাজনক। তাই বালুচিস্তান পাকিস্তানের পক্ষে একটা কাটাস্বরূপ।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ রাজত্ব অবসানের সঙ্গে অবিভক্ত ভারতের ৫৩৫টা করদ রাজ্যকে তিনটে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল— নিজ নিজ এলাকা জুড়ে দিয়ে ভারতে বা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দাও অথবা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র থাক। বালুচিস্তানের বেশিরভাগ অংশ ছিল কালাতের মধ্যে। কালাত হচ্ছে। এখনকার বালুচিস্তান প্রদেশের মধ্যভাগে অবস্থিত একটা করদ রাজ্য। এর অস্তিত্ব ছিল ১৬৬৬ সাল থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত। কালাতের শাসক খান সাহেব স্বাধীন থাকতে চেয়েছিল, ভারত বা পাকিস্তান কারো সঙ্গে জুড়তে অস্বীকার করেছিল। আর বালুচিরা জন্মগতভাবে স্বাধীনচেতা; তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সত্তা আছে।
জিন্নাহ-শাসিত পাকিস্তান জোর করে বালুচিস্তানকে পাকিস্তানের অন্যতম প্রদেশ বানায়; বালুচিদের ও তাদের শাসকের এতে একেবারেই সায় ছিল না। কালাতের সংযুক্তিকরণের পর থেকে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে বালুচিস্তানের সংগ্রাম চলছে। বিশ্বের অন্য দেশসমূহ বিশেষত ভারত,ইরান ও ইউএসএ বালুচিদের সাহায্য না করলে পাকিস্তান সেখানে আবার। গণহত্যা চালবে। বালুচিস্তান ইউএস ও ভারতের কাছে দরবার করেছে কিন্তু এখনো পর্যন্ত মৌখিক আশ্বাস ছাড়া কিছু মেলেনি।
স্বাধীনতার পরে পাকিস্তানের ১৮শো সংবিধান সংশোধনীতে বালুচিস্তানে প্রাদেশিক স্বায়ত্ত শাসনের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে নেহরু রিপোর্টে কেন্দ্রীয় সরকারকে মাত্র কিছু ফেডারেল ক্ষমতার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, বলা হয়েছিল বাকি সব থাকবে প্রদেশের হাতে। কিন্তু জিন্নাহ তাতে অরাজি হয়ে ১৪ দফা যে প্রস্তাব দেন, তাতেও বালুচিস্তানকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু এর পরেও পাকিস্তানের সংবিধানে প্রতিশ্রুত এই অধিকারের বিরুদ্ধে গিয়ে পাকিস্তান। বাঁচাও’ অজুহাত তুলে অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশ জারি করে বালুচিস্তানের ক্ষেত্রে কুখ্যাত ‘হত্যা কর ও গায়েব করে দাও’নীতি চালু হয়। পাকিস্তানের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এর নিন্দা করেছে, এমনকী বালুচিস্তানের ফেডারেল সরকার বা সংসদীয় রাজনীতির সমর্থকগণও এর বিরুদ্ধে গেছে, যেমন বালুচ ন্যাশনাল পাটি (বিএনপি), বিএনপি মেঙ্গাল, আওয়ামি প্রভৃতি।
অর্থনৈতিক শোষণ : প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেল, কয়লা, তামা, সালফার, ফ্লোরাইড ও সোনার মতো প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এই অঞ্চল; অথচ এটাই পাকিস্তানের সবচেয়ে অনুন্নত প্রদেশ। এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার বালুচিস্তান প্রদেশের সঙ্গে কোনো শলাপরামর্শ করে না। তারা বালুচিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি করে প্রাদেশিক সরকারের মত না নিয়ে, খনিজ পদার্থ নিষ্কাশন করে, কোনো কিছু জানায় না। সাইন্ডাক গোল্ড অ্যান্ড কপার প্রজেক্ট (সোনা ও তামা প্রকল্প) একটা মোক্ষম উদাহরণ। বালুচিস্তানকে এর মাত্র ২ শতাংশ শেয়ার দেওয়া হয়। বালুচিস্তানের সুই গ্যাস প্রকল্পের থেকে কোনো বকেয়া রয়্যাল্টি দেওয়া হয়নি, যার পরিমাণ ৩০০০০ কোটি পাকিস্তানি রুপি। শুধু তাই নয় গ্যাসে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ওই প্রদেশের ২৯টা জেলায় কোনো গ্যাস সরবরাহ নেই।
এই প্রদেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতা নেই বললেই হয়। যে কোনোরকম বিক্ষোভকে জ্বর, কঠোর হাতে দমন করা হয়। এমনকী অধিকার আদায়ের জন্য প্রতিবাদ করায়। নাবালক ছাত্রদেরও রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো হয়েছে। প্রচুর বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের সম্পদ থাকলেও এখানে অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা অত্যন্ত কম। ‘চায়না পাকিস্তান ইকনমিক করিডর’ (সিপিইসি)-এর জন্য বাধ্য হয়ে গোয়াদর বন্দরকে ‘স্পেশাল ইকনমিক জোন’ বা ‘বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্ত অঞ্চল, তকমা দেওয়া হয়েছে; এর মানে এই নয়। যে এখানে কোনো উন্নতিবিধান করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক উন্নতি করা সিপিইসি-র লক্ষ্য নয়। বরং সেটা করা হয়েছেমাকরানের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। মাকরান হচ্ছে ওমান উপসাগরের তীরবর্তী পাকিস্তানের বালুচিস্তানে এবং ইরানে অবস্থিত একটা সরু প্রায় মরুভূমি অঞ্চল। মাকরান অঞ্চলের বাইরে একটাও কোনো রাস্তা তৈরি হয়নি। সন্দেহ করা হয় যে ১৯৩ কিলোমিটার লম্বা এই রাস্তা তৈরি করা হয়েছেমাকরানের দুর্গম অঞ্চলে যাওয়ার পথ সুগম করার জন্য। আগে এখানে কোনো সড়ক যোগাযোগ ছিল না। আর সেখানে ছিল বিদ্রোহের উর্বর ক্ষেত্র, বিশেষ করে এর আওয়ারান এলাকা। এই পথ নির্মাণ করা হয়েছে সামরিক অভিযান চালানোর সুবিধার জন্য। তাই । বালুচিস্তানের লোকে এটাকে খারাপ চোখেই দেখে।
বালুচিস্তানে উন্নতির নাম করে শোষণ করা হয়। ইসলামাবাদ-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সবসময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর দোষারোপ করে যে তাদের উন্নতি মানে রাস্তা-নির্মাণ, প্রাকৃতিক সম্পদ নিষ্কাশন করা ও সামরিক ছাউনি তৈরি করা, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় বা হাসপাতাল নির্মাণ নয়। মুশারফের আমলে ৮ বছরে মাত্র একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাও সুবিধাবাদী জনজাতি গোষ্ঠীর লোকেদের দ্বারা। সব থেকে খারাপ ব্যাপার হলো জিনজন বাদে জনজাতি প্রধানদের সবাই নিজ স্বার্থে সরকারি যন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে জনগণের সর্বনাশ করে, যেমন মাগসি, রিন্দ, জাম, জামালি, জেহরি এরা। ভোটে তাদের নির্বাচন করা হয় না, সরকারের পছন্দ মতো লোক বসিয়ে দেওয়া হয়। তারা দুর্নীতিগ্রস্ত, অত্যাচারী। মনে করা হয় যে বালুচরা সংখ্যায় অল্প আর অশিক্ষিত, কিছু করতে পারবে না।
গেরিলা যুদ্ধ : বালুচ জাতীয়তাবাদীরা পাকিস্তানের দক্ষিণ- পশ্চিমে বালুচিস্তান প্রদেশে, ইরানের দক্ষিণ-পূর্বে সিস্তান ও বালুচিস্তান প্রদেশে ও দক্ষিণ আফগানিস্তানের বালুচিস্তান অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ চালায়। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এই প্রদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের উপরে অধিক স্বত্ব দাবি করে। বালুচ দেশপ্রেমিকরা এই প্রদেশে অন্য জাতিগোষ্ঠীর অসামরিক আধিকারিকদের উপরে আক্রমণ চালায়। ২০১০-এর দশকে বালুচ গেরিলারা শিয়াদের আক্রমণ করেছিল। এর আগে ১৯৪৮, ১৯৫৮-৫৯, ১৯৬২-৬৩ এবং ১৯৭৩-৭৭ পর্বে বালুচ জাতীয়তাবাদীদের বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে। ২০০৩ সালেও আরও শক্তিশালী, বিস্তৃত বিদ্রোহ চালানো হয়েছে। বালুচ লিবারেশন অর্গানাইজেশন ২০০০ সাল থেকে পাকিস্তানি সেনা, পুলিশ ও অসামরিক অফিসারদের উ পরে সাংঘাতিক ভাবে আক্রমণ চালিয়েছে। অন্য সংগঠনের মধ্যে আছে লস্কর-ই-বালুচিস্তান ও বালুচ লিবারেশন ইউনাইটেড ফ্রন্ট। ২০০৫ সালে ইসলামিক রিপাব্লিক অব ইরানের সিস্তান-ই-বালুচিস্তানে সেখানকার মাত্র ২ শতাংশ বালুচরা বিদ্রোহ ঘটায়। তবে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। ২০১৬ সালের আগস্টে চারজন সামরিক কম্যান্ডার বিদ্রোহীকে খতম করা হয় ও ১০২৫ জন। আত্মসমর্পণ করে ২০১৭-র এপ্রিলে আরও ৫০০ জন আত্মসমর্পণ করে।বালুচিস্তানের পাশতুন জনগণের মাত্র ১২ শতাংশ আর বালুচদের ৩৭ শতাংশ মাত্র স্বাধীনত চায়। তবে বালুচিস্তানের ৬৭ শতাংশ বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন চায়। পাকিস্তান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিলেও কার্যত কিছুই করেনি। কিন্তু একথা বললে ভুল হবে যে বিদ্রোহ নিবে গেছে। ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। যে কোনো সময়ে তা ফেটে পড়তে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, পারমাণবিক শক্তিধর হলেও পাকিস্তান রেহাই পাবে না। ইউগোশ্লাভিয়া পূর্ব ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হয়েও টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এখন ইসলামাবাদ সামরিক ও অসামরিক উভয় দিক থেকে তার বালুচিস্তান। নীতি বদল করলেও পাকিস্তানের তাবেহয়ে থাকতে তারা নারাজ। তাদের চোখে, মনে ও মুখে একটি ভাষা— স্বাধীন বালুচিস্তান।
সুদীপ নারায়ণ ঘোষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.