যাকে কেউ মনে রাখেনি

স্টিফেন হকিং, রজার পেনরোজ এর নাম আমরা সবাই শুনেছি | বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী | প্রচুর খ্যাতি ,নামডাক | পুরো দুনিয়া তাদের সন্মান করে | কিন্তু আপনি কি জানেন সাধারণ আপেক্ষিকতায় পেনরোজ-হকিং সিংগুলারিটি তত্ত্বগুলো প্রতিপাদনের জন্য তাঁরা সাহায্য নিয়েছিলেন এক বাঙালি বিজ্ঞানীর গবেষণালব্ধ সমীকরণকে | চমকে উঠলেন ? না চমকে ওঠার কিছুই নেই কারণ এটাই বাস্তব |সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ও বিশ্বতত্ত্ব-সম্পর্কিত আধুনিক গবেষণায় বিরাট ভূমিকা আছে এক বঙ্গসন্তানের | যিনি তৎকালীন কলকাতায় আধুনিক সুযোগ সুবিধা ছাড়াই আবিষ্কার করেছিলেন আপেক্ষিকতা তত্ত্ব সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণ | সত্যি কথা বলতে আমরাই আমাদের মেধাগুলোকে কখনও দাম দিতে শিখিনি। কিংবা আমরা হয়ত তাদের চিনতে অনেক বেশি দেরি করে ফেলেছি |

অমল কুমার রায়চৌধুরী | জন্ম ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই সেপ্টেম্বর | বর্তমান বাংলাদেশের বরিশালে |বাবা সুরেশচন্দ্র রায়চৌধুরী ছিলেন গণিতের স্কুলশিক্ষক। বাবাকে দেখে অণুপ্রাণিত হয়েই ছোটবেলা থেকেই অমল গণিত বিষয়ে আকৃষ্ট হন | অঙ্কের অনেক জটিল প্রশ্ন খুব সহজেই সমাধান করতে পারতেন ছোট থেকেই | এরপর উচ্চশিক্ষার্থে ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে | ১৯৪২ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক এবং ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অব সায়েন্সেসে যোগ দেন।

চালু করলেন গবেষণা | দীর্ঘ চার বছর গবেষণা করলেন | কিন্তু কোন তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল পেলেন না রায়চৌধুরী | বেশ কিছুটা হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন | এরপর তিনি আশুতোষ কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। অধ্যাপক এন আর সেন তখন সেখানে আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব পড়াতেন। অমল রায়চৌধুরী অধ্যাপক সেনের সান্নিধ্যে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব শিখতে শুরু করেন এবং তাঁর সাহায্যেই প্রথম কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। পরের দিকে তিনি একা একাই গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন। আবিষ্কার করেন যুগান্তকারী “রায়চৌধুরী সমীকরণ” | সাড়া পড়ে গেল চারিদিকে |

অমল কুমার রায়চৌধুরী তাঁর সমীকরণটি ১৯৫৩ সালে বের করলেও এটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করার জন্য তাঁকে দুই বছর অপেক্ষা করতে হয়। ১৯৫৫ সালে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় বিখ্যাত জার্নাল ফিজিক্যাল রিভিউ –তে। এই গবেষণা প্রবন্ধের হাত ধরেই অমল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তখনো কিন্তু তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেননি। তাঁর পিএইচডি সম্পন্ন হয় ১৯৫৯ সালে।

চতুর্মাত্রিক জগৎ সময়ের সাথে কীভাবে বিবর্তিত হয় সেটার ব্যাখ্যা মেলে রায়চৌধুরী সমীকরণ থেকে। নিউটন তাঁর বিখ্যাত মহাকর্ষ সূত্রে বলেছিলেন যে মহাবিশ্বের যেকোন দুটি বস্তুকণার মধ্যে মহাকর্ষ নামক একটি আকর্ষণধর্মী বল কাজ করে। কিন্তু এই বলের উৎস কী- সেটা নিউটন কখনোই বলে যেতে পারেননি। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে এটা প্রমাণিত হয়- মহাকর্ষ কোন বল নয়, এটা আমাদের চতুর্মাত্রিক স্থান-কালের একটা বৈশিষ্ট্য। কোন বস্তুর উপস্থিতিতে স্থান-কাল বেঁকে যায়, আর সেই বক্রতার জন্যই আমরা মহাকর্ষের প্রভাব দেখতে পারি। এখন প্রশ্ন হল- মহাকর্ষের আকর্ষণধর্মিতার ব্যাখ্যা কী? আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখি যে গাছ থেকে ফল মাটিতে পড়ছে, চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। অথচ আইনস্টাইনের দেওয়া ব্যাখ্যায় মহাকর্ষ একটি সম্পূর্ণ জ্যামিতিক ব্যাপার। তাহলে সেই জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্যের কোথায় এই আকর্ষণধর্মিতার ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে? রায়চৌধুরী সমীকরণ থেকে আমরা এটার খুব সুন্দর একটা ব্যাখ্যা পাই। কোন ধরনের বলের প্রভাব ছাড়া একটি বস্তু যে পথে চলাচল করে সেটাকে বলা হয় জিওডেসিক। রায়চৌধুরী দেখান যে কোন ভারী বস্তুর উপস্থিতিতে তার আশেপাশের জিওডেসিকগুলো বস্তুটির দিকে বেঁকে যায়। এটাই মহাকর্ষের আকর্ষণধর্মিতার ব্যাখ্যা দেয়।

রায়চৌধুরী সমীকরণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল রয়েছে। আমরা জানি যে, এই মহাবিশ্বের শুরু হয়েছে বিগ ব্যাং বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। ধরে নেওয়া যাক, আমি কোন একটি বস্তুর সমগ্রজীবনের ইতিহাস জানতে চাই। তাহলে আমাকে যেটা করতে হবে সেটা হলো চার মাত্রার জগতে বস্তুটা যে পথে চলেছে সেই পথ ধরে সময়ে পেছন দিকে যেতে থাকতে হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো- পিছাতে পিছাতে যখন আমরা বিগ ব্যাং এর কাছাকাছি সময় গিয়ে পৌঁছাব তখন আর বলতে পারব না এর আগে কী হয়েছিল। অর্থাৎ আমাদের জগতের যেকোন বস্তুর চলার শুরু ঐ বিগ ব্যাং থেকেই, এর আগের কিছু জানা আমাদের জন্য সম্ভব নয়। যখনই জগতের কোন এক জায়গায় আমরা এভাবে আটকে যাই আমরা বলি সেখানটায় একটা সিঙ্গুলারিটি আছে। প্রশ্ন হলো- জগৎ সৃষ্টি হওয়ার তত্ত্বে এই সিঙ্গুলারিটিকে কি কোনভাবে এড়ানো সম্ভব? আইনস্টাইনের তত্ত্ব থেকে আমরা এমন কোন বিশ্বজগতের ধারণা কি পেতে পারি যেখানে কোন সিঙ্গুলারিটি নেই। এই প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে প্রথম ধারণা পাওয়া যায় রায়চৌধুরী সমীকরণ থেকে। সেখান থেকে এটা দেখানো যায় যে আমাদের মহাবিশ্বে যেকোন দুটি বস্তুকণার চলার পথ ধরে সময়ে পেছন দিকে যেতে থাকলে সেগুলো একটা জায়গায় গিয়ে জড়ো হতে চাইছে। সেটাই বিগ ব্যাং। অমল রায়চৌধুরীই প্রথম ধারণা দেন যে সিংগুলারিটি এড়িয়ে যাওয়া আমাদের জন্য সম্ভব নয়। পরে ১৯৬০-৭০ এর দিকে স্টিফেন হকিং এবং রজার পেনরোজ রায়চৌধুরী সমীকরণের উপর ভিত্তি করেই এ ব্যাপারটা গাণিতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন।

একজন মেধাবী বিজ্ঞানী হবার পাশাপাশি অমল কুমার রায়চৌধুরী একজন প্রাণবন্ত শিক্ষকও ছিলেন। ক্লাসে শিক্ষার্থীরা তাঁর কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত। তিনি ছিলেন একজন কর্মপ্রাণ মানুষ। মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে তাঁর শেষ গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। বই পড়তে ভালবাসতেন | ছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত। রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ রাখতেন, প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না করলেও বিভিন্ন প্রবন্ধে নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা উল্লেখ করেছেন।

২০০৫ সালের ১৮ জুন, ৮১ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন | পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর অবদানের জন্যে অনেকে তাঁকে ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানীর তালিকাভুক্ত করেন | কিন্তু আমরা বাঙালিরা তাঁকে কতটুকু সন্মান দিয়েছি ! আমরা তো তাঁকে চিনিই না !

(তথ্য – উইকিপিডিয়া)

অভীক মণ্ডল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.