জম্মু ও কাশ্মীর (J&K) রাজ্যকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করার সঙ্গে ভারত সরকারের দ্বারা ৩৭০ ধারা সংশোধন করার এবং ৩৫এ সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত অনেককে বিস্মিত এবং হতবাক করেছে। এই বিষয়ে সংসদে বিতর্ক চলাকালীন বিরোধী দলগুলি যুক্তি দিয়েছিল যে এই পদক্ষেপটি নাকি অসাংবিধানিক এবং জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের বিরোধী ছিলো!
সাংবিধানিক অবস্থান
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার সময় ভারতে ৫৬০টিরও বেশি দেশীয় রাজ্য ছিল। তখন তাদের সামনে কেবল দুটি বিকল্প দেওয়া হয়েছিল, হয় ভারতে নয়তো পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার! বিদায়ী ব্রিটিশ সরকার কোনও দেশীয় রাজ্যকেই স্বাধীন থাকার অনুমতি দেয়নি। সেই হিসাবে ১৯৪৭ সালের ২রা অক্টোবর জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের শাসক মহারাজা হরি সিং যে ভারতভুক্তির দলিলটি স্বাক্ষর করেছিলেন তা ভারতের অন্যান্য সমস্ত দেশীয় রাজ্যের থেকে আলাদা কিছুই ছিল না। কিন্তু ভারতভুক্তির দলিলটি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমগ্র কাশ্মীরকে জোর করে দখল করার জন্যে কাবাইলিস (আদিবাসী)-দের ছদ্মবেশে কাশ্মীর আক্রমণ করে বসে।
যদিও সঠিক সময়ে ভারতীয় বাহিনীর হস্তক্ষেপের ফলে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য রক্ষা পায়, তবুও এই রাজ্যের কিছু অঞ্চল পাকিস্তানের অবৈধ দখলে রয়ে গিয়েছিলো, যা বর্তমানে পাকিস্তান অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীর (POJK) নামে পরিচিত। যদিও এই ভারতভুক্তির প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হয়েছিল, তবে বিষয়টি তখন জাতিসংঘের কাছে বিচারাধীন ছিল এবং কিছু অঞ্চল পাকিস্তানের অবৈধ দখলে ছিল, তাই ভারত সরকার সদ্য ভারতভুক্ত হওয়া জম্মু কাশ্মীর রাজ্যে সামগ্রিকভাবে ভারতীয় সংবিধান বাস্তবায়নের আগে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করার জন্য কিছু সময় চেয়েছিল। এই জন্য, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ৩৭০ ধারা চাওয়া হয়েছিল এবং এটি বলা হয়েছিল যে এটি অস্থায়ী হবে। এর ফলে প্রতিরক্ষা, সুরক্ষা, বিচার বিভাগ এবং বৈদেশিক বিষয়গুলি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে এবং অন্যান্য সমস্ত বিষয় জম্মু এবং কাশ্মীর রাজ্যের বিধানসভার অধীনে পরিচালিত হবে বলে ঠিক হয়েছিল।
তবে শেখ আবদুল্লাহ এবং তাঁর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর পক্ষপাতিত্বের কারণে, অনুচ্ছেদ ৩৫এ অগণতান্ত্রিক ভাবে এবং গোপনীয়তার সঙ্গে ১৯৫৪ সালে একটি রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারাই প্রবর্তিত হয়। এবং এই ব্যাপারে সংসদের অনুমোদনও নেওয়া হয়নি। আর বর্তমানে সমস্ত সমস্যার মূল কারণ এটাই ছিলো যে, জম্মু এবং কাশ্মীর রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা কারা হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রাজ্যের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল এই ধারা। এই অনুচ্ছেদটি তফসিলি জাতি (এসসি) এবং তফসিলি উপজাতি (এসটি)-দের বিরোধী ছিল এবং শুধু তাইই নয়, এটি মহিলাদের প্রতিও সাঙ্ঘাতিক বৈষম্যমূলক ছিলো। আর জম্মু এবং কাশ্মীর রাজ্যের সরকার শুধুমাত্র কাশ্মীর উপত্যকার বাসিন্দাদেরই না়, জম্মু ও লাদাখ অঞ্চলের মানুষদের নিয়েও তৈরী হয়েছিল! ৩৭০ ধারার কারণে প্রাপ্ত সুবিধা বা ক্ষয়ক্ষতিগুলো ভালোভাবে পর্যালোচনা করে দেখা উচিত।
এই আর্টিকেলের ছত্রছায়ায়, পাকিস্তানের সাহায্যপুষ্ট সন্ত্রাসবাদী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলি ধর্ম ও রাজনীতির নামে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল রাখার জন্যে ভারতীয় সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। তাই ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিলুপ্তি এবং ভারত সরকার কর্তৃক জম্মু এবং কাশ্মীর রাজ্যে সমস্ত সাংবিধানিক অধিকার প্রসারিত করার জন্য ৩৫এ অপসারণের এই সংশোধনীটি ভারতবাসীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ছাড়া আর কিছুই নয়।
১৯৫৭ সালের জম্মু ও কাশ্মীরের সংবিধানের ২য় অনুচ্ছেদে “ভারত ইউনিয়নের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক” শিরোনামে অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে “জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য ভারত ইউনিয়নের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।” ৩৭০ ধারা রাজ্যের বিষয়ে সাময়িক বিধান বলে উল্লেখ করে ৩নং সেকশনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “এই অনুচ্ছেদের পূর্ববর্তী বিধানগুলি সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি জনসমক্ষে ঘোষণা করে এই অনুচ্ছেদটি কার্যকর করতে বা বন্ধ করতে বা কেবলমাত্র এই ধরনের ব্যতিক্রম এবং সংশোধনী এবং তিনি যেভাবে চান তা সেই দিন থেকেই চালু হবে।”
১৯৬৪ সালে সংসদের একজন সদস্য, প্রকাশবীর শাস্ত্রীর আনা ৩৭০ ধারা সংশোধন করার একটি ব্যক্তিগত বিল বিভিন্ন দলের সদস্যদের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছিল। এই বিলে ৩৭০ ধারা বিলোপের পক্ষে যাঁরা সমর্থন করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন রাম মনোহর লোহিয়া, মধু লিমায়ে, হরি বিষ্ণু কামাথের মতো সমাজতন্ত্রী, এনসি চ্যাটার্জী, সরজু পাণ্ডের মতো কমিউনিস্ট এবং ভগবত ঝা আজাদ, এস এম বন্দ্যোপাধ্যায়, হনুমানথাইয়ার মতো কংগ্রেসের সংসদ সদস্য এবং জম্মু ও কাশ্মীরের চারজন সংসদ সদস্য। সংসদ সদস্যরা এই বিষয়ে একমত হয়েছিলেন যে ৩৭০ অনুচ্ছেদটি জম্মু-কাশ্মীরের উন্নয়নের পথে বাধা ছিল। সংসদ সদস্যরা, বিশেষত জম্মু এবং কাশ্মীর থেকে আসা সদস্যরা জোর দিয়ে বলেছিলেন যে এটি জাতীয় ঐক্য এবং অখণ্ডতার জন্য হুমকিস্বরূপ! জম্মু ও কাশ্মীরের সংসদ সদস্য গোপাল দত্ত মেনগি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে ৩৭০ ধারাটি হ’ল জম্মু কাশ্মীরের জন্য একটি “অভিশাপ” বিশেষ। তিনি বলেছিলেন যে “৩৭০ অনুচ্ছেদ আমাদের কোনও বিশেষ মর্যাদা তো দেয়ই না, বরং এটি আমাদের নিজের দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে রাখে। এটি জম্মু কাশ্মীর এবং বাকি ভারতের মধ্যে একটি প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে।” জম্মু এবং কাশ্মীর থেকে আসা আর একজন সংসদ সদস্য, আবদুল গনি‚ যিনি শেখ আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীও বটে, এই ধারার কারণে রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে তা সংসদসভার নজরে এনেছিলেন। তিনি দ্বিধাহীন ভাবে বলেছিলেন যে “তৎকালীন জম্মু এবং কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী বকশী গোলাম মোহাম্মদ ৩৭০ ধারা বাতিলের পক্ষে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সে সময় তাতে রাজি ছিল না। আমি জানি না যে কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমের প্রভাবে রয়েছে নাকি তারা পাকিস্তানের প্রতি তোষণ নীতি চায় … তারা আমাদের দিয়ে তাদের প্রতিবেশীদের খুশি রাখতে চায়।” অসন্তোষের উপরোক্ত বিষয়গুলি যোগ করে জম্মু এবং কাশ্মীরের আরও একজন সংসদ সদস্য সৈয়দ নাসির হোসেন সামানানী, ৩৭০ ধারা বাতিল না করার কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে জম্মু এবং কাশ্মীরের জনগণের কী দোষ ছিল যে ৩৭০ ধারা বাতিল করা হয়নি। তিনি আরো বলেন, “আমরা, কাশ্মীরের জনগণ কখনই আমাদের সঙ্গে অন্যরকম আচরণ করার দাবি করিনি। আমরা ৩৭০ ধারা চাই না। আমি আমার জীবদ্দশায়, আমার সুরক্ষার জন্য, আমার বাচ্চাদের সুরক্ষার জন্য, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের সুরক্ষার জন্য এই অভিশাপটি বিলুপ্ত করতে চাই।” এই জাতীয় ঐতিহাসিক সমর্থন সত্ত্বেও, বিলটি পাস হয়নি কারণ এটি ছিল একটি বেসরকারী সদস্যদের বিল! তাই কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যা উল্লেখ করে, কংগ্রেস অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করার জন্য আরও ভাল পদ্ধতি চেয়েছিল।
১৯৯৪ সালে, পি.ভি নরসিমা রাওএর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার, সংসদে একটি ঐতিহাসিক সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস করেন যে জম্মু এবং কাশ্মীর রাজ্যটি ভারতের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং পাকিস্তানের কাছ থেকে পাক অধিকৃত জম্মু এবং কাশ্মীর ফিরে পাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই প্রস্তাব মতে ৩৭০ এবং ৩৫এ অস্থায়ী ধারা দুটোর অপসারণ ছিলো একটি জাতীয় দাবি।
এ কারণে বিরোধী দল কংগ্রেস বর্তমান সরকারের পদক্ষেপকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধিতা করলেও, কংগ্রেস দলেরই মতামত নিয়ে সমস্যা ও মতবিরোধ আছে। এই সমস্ত তথ্য এই সংবিধানিক অবস্থানকেই পরিষ্কার করে দেয় যে অনুচ্ছেদ ৩৭০ সবসময়ই অস্থায়ী ছিলো। এই সিদ্ধান্তটি জম্মু কাশ্মীরের সমস্ত নাগরিকদের উন্নতি, সমৃদ্ধি এবং গণতন্ত্রের দিকে যাত্রায় জাতির সঙ্গে যোগ দিতে সাহায্য করবে।
৭০ বছরের পরেও অস্থায়ী থাকা বিশেষ মর্যাদার অজুহাতে শিক্ষা এবং চাকরিতে সংরক্ষণের ব্যাপারে তপসিলি জাতি এবং তপসিলি উপজাতিগুলি বঞ্চিত ছিল। এছাড়া জমি কেনার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের কারণে কোনও বেসরকারি বিনিয়োগকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উচ্চমানের সুবিধাযুক্ত হাসপাতাল এবং শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে বিনিয়োগ করতে রাজি ছিল না, ফলে জম্মু এবং কাশ্মীরের জনগণ মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং যুবকদের চাকরির সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলো!
জম্মু এবং কাশ্মীরে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা
অনুচ্ছেদ ৩৭০ যে একটি অস্থায়ী আইন ছিল, আমাদের সংবিধান নির্মাতারা এ বিষয়ে দ্বিধাহীন ছিলেন। তবুও বিশেষ মর্যাদার আড়ালে কেবল রাজনীতি চলছিলো। ৩৭০ আর্টিকেলের অপব্যবহারের কারণে কোনও সংসদীয় অনুমোদন ছাড়াই রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে ৩৫এ লাগু করা হয়েছিল। এই বিধানটি অনেক সাংবিধানিক জটিলতা সৃষ্টির কারণ ছিলো এবং জম্মু এবং কাশ্মীরকে গণতন্ত্র ও সুশাসনের আসল স্বাদ থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিল। ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারার এই সাঙ্ঘাতিক সংমিশ্রণ রাজ্যে স্বজনপোষণ, পারিবারিক রাজনীতি এবং সাম্প্রদায়িকতা বজায় রেখেছিল এবং সমগ্র জম্মু এবং কাশ্মীরের উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ করা বিপুল পরিমাণ অর্থের অপব্যবহার করেছিল। কেন্দ্রের বরাদ্দকৃত তহবিলের একটি বড় অংশই চলে যেত সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর কয়েকটি পরিবার এবং কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর পকেটে! ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলিতে, লোকায়ুক্ত নিয়োগ করার সাংবিধানিক বিধান রয়েছে, যা সরকারি তহবিলের ব্যবহার তদারকি করার জন্য এবং বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতি রোধের জন্যে কাজ করে। কিন্তু জম্মু এবং কাশ্মীরের এই বিশেষ মর্যাদা লোকায়ুক্ত নিয়োগকে বাধা দিয়েছে, পাছে বরাদ্দকৃত তহবিলের সমস্ত রাজনৈতিক দুর্নীতি ও অপব্যবহারের বিষয়টি প্রকাশ পেয়ে যায় এই ভয়ে। আরটিআই আইন ভারতে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে কাজ করে। এই সংশোধনী আরটিআই আইন এবং লোকায়ুক্তকে প্রশাসনের দ্বারা দুর্নীতি চিহ্নিত করতে, পরিষ্কার ও মসৃণ প্রশাসন নির্মাণে সাহায্য করবে। এই সিদ্ধান্তটি সমস্ত নারীদের তাদের জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে পুরুষদের সঙ্গে সমানাধিকার দিয়েছে। বিশেষ স্ট্যাটাসের আড়ালে, জম্মু এবং কাশ্মীরের মহিলাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছিল। জম্মু এবং কাশ্মীরের কোনও পুরুষ রাজ্যের বাইরের যে কোনও মহিলাকে বিয়ে করতে পারে, কিন্তু কোনও মহিলা যদি জম্মু এবং কাশ্মীরের বাইরের কোনও ব্যক্তিকে বিয়ে করেন তবে তিনি তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন। এছাড়া এই সিদ্ধান্তের ফলে রাজ্যে বসবাসরত ২৫,০০০ গোর্খার উপর করা অবিচারেরও প্রতিকার করা হয়েছে। এই সমস্ত গোর্খারা ১৯ শতকে জম্মু ও কাশ্মীরে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। তাঁদের বেশিরভাগই সৈন্য ছিলেন যারা পাঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিংহের হয়ে লড়াই করেছিলেন! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৮৪৬ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত জম্মু এবং কাশ্মীর মহারাজা রঞ্জিত সিংহের নিয়ন্ত্রণে ছিলো! অর্থাৎ এটি প্রমাণ করে যে এইসব গোর্খারা ১৮৪৬ সালেরও আগে জম্মু ও কাশ্মীরে জনগণের জন্য কাজ করেছিল। ৩৫এ ধারায় এই গোর্খাদের স্থায়ী আবাসিক শংসাপত্র না দিয়ে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থী বাইশ হাজার পরিবারকে ভারতের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে সম্মানজনক জীবনযাপন করতে সাহায্য করবে। ৭০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও এই পশ্চিম পাকিস্তানি শরণার্থীরা শরণার্থী পরিচয়ের বোঝা বহন করে এবং জাতীয় মূলধারার অংশ হতে পারে না। তপসিলি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত বাল্মিকীদের ১৯৫৭ সালে পাঞ্জাব থেকে ঝাড়ুদার হিসাবে নিয়ে আসা হয়েছিল। আজ ১৫,০০০ বাল্মিকীর মধ্যে কেউই‚ তা সে যতই শিক্ষিত হোক না কেন, তারা ঝাড়ুদার ছাড়া অন্য কোনও কাজ করার অধিকার পায় না। এখন, এই সমস্ত অগণতান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করা অমানবিক অবিচারগুলোকে অবৈধভাবে অনুচ্ছেদ ৩৫এ ধারার অধীনে বজায় রাখা হয়েছিল।
এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কাশ্মীরি পণ্ডিতদের তাদের দেশে শরণার্থী জীবনের সমাপ্তির আশা জাগিয়ে তুলেছে এবং তাদের পৈতৃক ভূমিতে পুনর্বাসনের সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে। ভারত তথা মানবতার ইতিহাসের অন্যতম অন্ধকার দিনটি ছিল রাজ্যের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা এবং শান্তিপূর্ণভাবে উপত্যকায় বসবাসকরা কাশ্মীরি পণ্ডিতদের পেশীশক্তির জোরে হিংস্র বহিস্কার! কেউই তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি তোলেনি কারণ তারা ছিলো হিন্দু। লাদাখের জনগণ, যাদের বেশিরভাগই বৌদ্ধ এবং শিয়া মুসলমান, তারা লাদাখের বিশেষ স্থান ও চরম আবহাওয়ার কারণে দূরে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও জম্মু ও কাশ্মীরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই অঞ্চলটি বহুদিন ধরেই ছিলো ক্ষমতাসীন সরকারের অবহেলা ও বিমাতৃসুলভ আচরণের শিকার্। তাদের পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠনের যে দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, যা অবশেষে মঞ্জুর হয়েছে ফলে সেখানকার সমস্ত মানুষ আজ খুশি। সংসদে আলোচনার সময় কিছু নেতা ৫ আগস্টকে কাশ্মীরের অন্ধকার দিন হিসাবে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে, ১৯৫৪ সালে ৩৫এ ধারার লাগু হওয়ার দিনটি ছিল জম্মু এবং কাশ্মীর রাজ্যের অন্ধকার দিন।
এছাড়া ১৯৮৯ সালে জম্মু এবং কাশ্মীরের ইতিহাসের একটি অন্ধকার দিন ছিল যখন শান্ত, সম্পদ সৃষ্টিকারী কাশ্মীরি পণ্ডিত এবং হিন্দুদের বন্দুকের নলের সামনে উপত্যকা থেকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়েছিল। ৫ আগস্ট কেবল তাদের জন্যই অন্ধকার দিন হতে পারে যারা পারিবারিক রাজনীতিতে লিপ্ত রয়েছে এবং ইসলামের নামে সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকতা ও বাণিজ্যিকীকরণ করেছে। বিজেপির কাছে এই সাংবিধানিক অনিয়ম অপসারণের জন্য এই প্রয়োজনীয় এবং বহু প্রতীক্ষিত পদক্ষেপ গ্রহণের উপযুক্ত কারণ রয়েছে। ভারতীয় জনসঙ্ঘের (যে দলটি শেষ পর্যন্ত বিজেপিতে পরিণত হয়েছিল) প্রতিষ্ঠাতা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জম্মু এবং কাশ্মীরের সম্পূর্ণ সংহতিকরণের দাবিতে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ফলে তাঁকে জেলে বন্দী করা হয় এবং সেখানেই তিনি সন্দেহজনক ভাবে মারা যান।
বিজেপি সব সময় দাবি করে এসেছে যে তারা ক্ষমতা পেলেই ৩৭০ ধারা বাতিল করে দেবে। সাম্প্রতিক এই নির্বাচনেও গত সরকার স্পষ্টভাবে বলেছিল যে ক্ষমতায় এসে তারা এই অস্থায়ী আইনটি বাতিল করার ব্যবস্থা নেবে।
ভারতবাসী তাদের ইশতেহারে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করার জন্য তাদের আরও শক্তিশালী ম্যান্ডেট দিয়েছে। ১৯৫৩ সালে আরএসএস একটি প্রস্তাব পাস করে এবং জম্মু এবং কাশ্মীর প্রজা পরিষদের নেতৃত্বে “ভারতের সঙ্গে জম্মু এবং কাশ্মীর রাজ্যের সম্পূর্ণ সংহতিকরণ”-এর জন্য আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। তার পর থেকে আরএসএস বহুবার রেজোলিউশন পাশ করে এবং মাঝেমধ্যেই ৩৭০ ধারার বিপর্যয় সম্পর্কে সারা দেশে জনসচেতনতামূলক প্রচার চালায়। আরএসএস কর্তৃক সর্বশেষ প্রস্তাবটি ২০১০ সালে পাস হয়েছিল, যেখানে এতে বলা হয়েছিল: “ধারা ৩৭০, যা আমাদের সংবিধানে ‘অস্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী বিধান’ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল, বাতিল করার পরিবর্তে, বিচ্ছিন্নতাবাদীর হাতে হাতিয়ার হিসাবে কাজ করছে।”
যথারীতি, আরএসএস এবং এর সম্পর্কে সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা যুক্ত ভুল ধারণা সম্পর্কে ভিত্তিহীনভাবে অনেক কিছু বলা হচ্ছে। আরএসএস ভারতে মুসলমানদের সম্পর্কে যা ভাবছে তা এমএস গোলওয়ালকর, আরএসএসের তৎকালীন সঙ্ঘচালক শ্রী গুরুজির একটি সাক্ষাত্কারে খুব স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ১৯৭২ সালে প্রবীণ সাংবাদিক সাইফুদ্দিন জিলানিকে তিনি এই ব্যাখ্যাটি দিয়েছিলেন। আমি এখানে একটি উদ্ধৃতি পাঠকদের সুবিধার জন্য দিয়ে দিচ্ছি।
“ডাঃ জিলানী: ‘ইন্ডিয়ানাইজেশন’ সম্পর্কে অনেক কিছু বলা হয়েছে এবং এটি নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। আপনি দয়া করে আমাকে বলতে পারেন কীভাবে বিভ্রান্তি দূর করবেন?
“শ্রী গুরুজি: ‘ভারতীয়করণ’ অবশ্যই জনসঙ্ঘের দেওয়া স্লোগান ছিল। কেন এমন বিভ্রান্তি হওয়া উচিত? ‘ইন্ডিয়ানাইজেশন’-এর অর্থ এই নয় যে সমস্ত লোককে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করা। “আসুন আমরা সবাই বুঝতে পারি যে আমরা সবাই এই মাটির সন্তান এবং আমাদের অবশ্যই এই ভূমির প্রতি আনুগত্য থাকতে হবে। আমরা একই সমাজের এবং সাধারণ পূর্বপুরুষদের উত্তরাধিকার বহন করি। আমরা আশা সাধারণ আকাঙ্ক্ষাও একই। এটি বোঝাই সত্যিকার অর্থে ‘ইন্ডিয়ানাইজেশন’। ”ভারতীয়করণের অর্থ এই নয় যে কাউকে তার ধর্মীয় ব্যবস্থা ত্যাগ করতে বলা উচিত। আমরা না এ কথা বলেছি, না আমরা বলব। বরং আমরা বিশ্বাস করি যে সমগ্র মানব সমাজের জন্য একটি একক ধর্মীয় ব্যবস্থা উপযোগী নয়।
”সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক বক্তৃতা সিরিজের সময় ড. মোহনজি ভাগবত বলেছিলেন, সঙ্ঘ ভ্রাতৃত্ববোধের পক্ষে কাজ করে এবং এই ভ্রাতৃত্বের একমাত্র ভিত্তি “বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য”। “বিশ্ব এই সনাতন চিন্তার প্রক্রিয়াটিকে ‘হিন্দুত্ব’ বলে অভিহিত করে। এ কারণেই যখন আমরা বলি আমাদের জাতি একটি ‘হিন্দু রাষ্ট্র’, এটি কোনওভাবেই বোঝায় না যে আমাদের মুসলমানদের দরকার নেই। যেদিন বলা হবে যে মুসলমানদের প্রয়োজন নেই, তা আর ‘হিন্দুত্ব’ থাকবে না। ”আর আলাদা করে বলার দরকার নেই যে, এটি জম্মু এবং কাশ্মীর রাজ্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যা হাজার হাজার বছরের ভারতীয় সভ্যতার বাকী অংশের উত্তরাধিকারী হয়।
এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের দুই সপ্তাহ পরে আমার নিয়মমাফিক ভ্রমণ পরিকল্পনার অংশ হিসাবে জম্মু, শ্রীনগর, কারগিল এবং লেহ ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছিল। আমি কিছু স্থানীয় লোকের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পেয়েছিলাম। কারগিল ও লেহের লোকেরা ইউটি স্ট্যাটাস পাওয়ার বিষয়ে খুশি হয়েছিল যা তাদের দীর্ঘকালীন সর্বজনগ্রাহ্য দাবি ছিল। আমি জাংস্কার উপত্যকার একজন মুসলিম অ্যাডভোকেটের সঙ্গে দেখা করেছিলাম, যিনি এর আগে পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (পিডিপি) সঙ্গে ছিলেন, কিন্তু লাদাখের জন্য ইউটি-র দাবি সমর্থন করার জন্য তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। জম্মু ও শ্রীনগরে, স্থানীয়রা আমাকে একটি সাধারণ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলো যে, জম্মু ও কাশ্মীরকে একটির পরিবর্তে দুটি পৃথক ইউটি বানানো ভাল হত কিনা। আমি উত্তর দিয়েছিলাম যে, এটি ভুল হবে কারণ এই দেশটি হলো ভারত এবং এটি পাকিস্তানের এই ধারণার বিরোধী ছিল যে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে থাকতে পারে না। এটি ভারতবর্ষের ধারণা যে ধর্মীয় বা অন্যান্য বৈচিত্র্য সত্ত্বেও আমাদের এক দীর্ঘ ঐতিহ্য এবং ঐক্যবদ্ধভাবে একত্রে থাকার ইতিহাস রয়েছে। এটাই ভরতের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য!
ড. মনমোহন বৈদ্য
ড. মনমোহন বৈদ্য হলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সহ-সরকার্যবাহ