সকলকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল সুমিত্রা দেবীর

গত শতকের মাঝামাঝি বাংলা চলচ্চিত্রে এক অভিনেত্রীর, বলা যায় তৎকালীন সেরা সুন্দরী অভিনেত্রীর আবির্ভাব ঘটে। পরে পাঁচের দশকে অবশ্য সেরা সুন্দরী অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনকে পাই আমরা। বাংলা ছবির সেই সুন্দরী অভিনেত্রী সাকুল্যে মাত্র আঠারোটি ছবিতে অভিনয় করেছেন। কিন্তু সে সময়ের বাঙালি যুব সম্প্রদায়কে আপন সৌন্দর্য ও অভিনয়ে তিনি পাগল করে তুলেছিলেন। তাঁর অভিনীত ছবিগুলি দেখার জন্য কলকাতার সিনেমা হলে সাড়ে চার আনার টিকিটের কাউন্টারে বিরাট লাইন লেগে থাকত। এই সাড়ে চার আনার টিকিট হল ফোর্থ ক্লাসের। মানে আম জনতার।

অভিনেত্রীর আসল নাম নীলিমা চট্টোপাধ্যায়। ১৯২৩ সালে বীরভূম জেলার সিউড়িতে জন্ম। ফুটফুটে সুন্দর দেখতে নীলিমার বাবা মুরলীধর চট্টোপাধ্যায় লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যবহারজীবী ছিলেন। তাঁর বাল্য শিক্ষা মজফফরপুরে। ১৯৩৪ সালে বিহারে ভূমিকম্পের জেরে নীলিমারা কলকাতায় চলে আসেন। ভর্তি হন দেশবন্ধু গার্লস হাইস্কুলে। তবে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেননি। গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মের ফলে অনেক অনুশাসন মেনে চলতে হতো নীলিমাকে। কিন্তু ছোট থেকেই তাঁর ইচ্ছা ছিল রুপোলি পর্দার ভাল অভিনেত্রী হওয়ার, নায়িকা হওয়ার। যৌবনে সবে পা রেখেছেন, তখনই সর্বস্তরে শুরু হয়ে যায় নীলিমার রূপের প্রশংসা। মেয়ে সিনেমায় অভিনয় করতে ইচ্ছুক জেনে বাবা চিন্তায় পড়লেন। তাই তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিলেন মেয়ের। কিন্তু বিবাহিত জীবন সুখের হল না। একদিন স্বামীগৃহ ছেড়ে চলে এলেন। এব্যাপারে ছোটভাই তাঁর পাশে থেকেছেন সব সময়। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবে নিউ থিয়েটার্সের কথা তাঁর জানা ছিল। ভাইয়ের উৎসাহে উদ্বুদ্ধ হয়ে নীলিমা একদিন তাঁর ফটোসহ একটি আবেদন পত্র পাঠান নিউ থিয়েটার্সে অভিনয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করে। চিঠির উত্তর এল। নিউ থিয়েটার্স তাঁকে ডাকল ইন্টারভিউয়ের জন্য। ইন্টারভিউ দিলেন। তাতে উতরে যাওয়ায় অভিনয়ের শিক্ষাদান শুরু হল। ছবির পর্দায় আর নীলিমা নয়, তাঁর নাম হল সুমিত্রা দেবী।

নিউ থিয়েটার্সের ‘মাই মিস্টার’ ছবির নায়িকা রূপে সুমিত্রা দেবী নির্বাচিত হলেও তাঁর প্রথম মুক্তি প্রাপ্ত ছবি ‘সন্ধি’। প্রথম ছবিতেই দর্শকের মন জয় করে ফেলেন তিনি। ছবির নায়ক বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৪৪ সালে। নবাগত নায়িকা সুমিত্রা দেবী সে বছর বিএফজেএ (বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন) পুরস্কার পান সেরা অভিনেত্রী হিসাবে। এ ছবি যে আলোড়ন তুলবে কেউ ভাবেননি। ‘সন্ধি’র পরিচালক অপূর্ব মিত্র হলেও এ ছবির প্রযোজক ও চিত্রনাট্যকার দেবকী কুমার বসু। প্রকৃত পক্ষে তিনিই সুমিত্রা দেবীকে ট্রেনিং দেন। তাতেই সুমিত্রা দেবী প্রথম ছবিতেই অসাধারণ অভিনয় করেন। এই ছবিতে তাঁর চরিত্রটি খামখেয়ালি এক বিবাহিতা তরুণীর। স্বামী যার একজন ভাল মানুষ। কিন্তু স্ত্রীর খেয়ালের সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে স্বামী বেচারার কাহিল অবস্থা। তরুণীর একটাই দুর্বলতা। আরশোলা ভীতি। স্বামী সেটা জানতে পেরে বোতলে আরশোলা রেখে স্ত্রীকে জব্দ করতেন। শেষ কালে স্বামীর সঙ্গে সন্ধি করলেন তরুণী। কলেজে পড়ার সময় ছবিটি দেখেছিলাম কয়েকজন বন্ধু মিলে। পরে যখন প্রথমবার বোম্বাই যাই তখন কে এস ফিল্মসের ক্যামেরাম্যান আমাকে সুমিত্রাদেবীর সঙ্গে পরিচয় করে দেন। আমি আরশোলার গল্প বলতে কী হাসি। অবশ্য এর মধ্যে তাঁর ‘পথের দাবি’, ‘দেবী চৌধুরাণী’ , ‘সাহেব বিবি গোলাম’ , ‘একদিন রাত্রে’ , ‘আঁধার আলো’ দেখেছি। সেই সব ছবি নিয়েও কথা হল ওঁর সঙ্গে।

অভিনয়ের জগতে আসার পর তাঁর বিয়ে হয় অভিনেতা দেবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সে সময় দেবী মুখোপাধ্যায় বিরাট মাপের অভিনেতা। ১৯৪৭ সালে দেবী মুখোপাধ্যায় মারা যান। ‘ভাবীকাল’ ছবিতে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য দেবী মুখোপাধ্যায় বিএফজেএ পুরস্কার পেয়েছিলেন। ‘সন্ধি’ ছবির পর সুমিত্রা দেবী ‘পথের দাবী’, ‘অভিযোগ’, ‘দেবী চৌধুরাণী’, ‘স্বামী’, ‘সমর’, ‘দস্যু মোহন’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘একদিন রাত্রে’, ‘আঁধার আলো’, ‘খেলা ভাঙার খেলা’, ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’, ‘যৌতুক’, ‘কিনু গোয়ালার গলি’ প্রভৃতি ছবিতে দুর্দান্ত অভিনয় করেন। তাঁর অভিনয়ের জন্য ছবিগুলি ভালো চলেছিল। হরিদাস ভট্টাচার্য পরিচালিত ‘আঁধার আলো’ ছবিতে সুমিত্রা দেবীর অভিনয় দর্শকমহলে সাড়া ফেলে দেয়। ‘আঁধারে আলো’ সেই বছর দ্বিতীয় সেরা ছবি হিসাবে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পায়। কার্লোভিভারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটি মনোনীত হয়েছিল। এই ছবিতে সুমিত্রা দেবীর অভিনয়ের প্রশংসা অনেকের মুখেই শুনেছি।

তিনি বোম্বে টকিজের ব্যানারে বঙ্কিমচন্দ্রের কাহিনি ‘রজনী’ অবলম্বনে হিন্দি ও বাংলা দ্বিভাষিক ছবি করেন। তাতে তরঙ্গিণীর ভূমিকায় অভিনয় করে হিন্দি ছবির দর্শকদেরও বেশ আপন হয়ে উঠলেন। রাজ কাপুরের ‘একদিন রাত্রে’র হিন্দি ‘জগতে রাহো’ ছাড়াও সুমিত্রা দেবী আরও কয়েকটি হিন্দি ছবিতে কাজ করেছেন। সেগুলির মধ্যে আছে ‘ময়ূরপঙ্খ’, ‘মমতা’, ‘দিওয়ানা’, ‘আরাবিয়ান নাইটস’, ‘মেরে আরমান মেরে সপনে’,’বীর ভীমসেন’ প্রভৃতি।

সম্ভ্রম জাগানোর মতো ব্যক্তিত্ব ছিল সুমিত্রা দেবীর। বোম্বেতে শুনেছি সুমিত্রা দেবী খুব বিনয়ী ছিলেন বলে সকলের ভালোবাসা পেয়েছেন। চলচ্চিত্রের মানুষজন তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। পঞ্চাশের দশকের শেষাশেষি চিনে অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। এতে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন তিনি।

‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবিতে সুমিত্রা দেবীর পটেশ্বরী চরিত্র আজও মনে দাগ কেটে আছে। প্রতিটি ছবিতেই তিনি অন্তর দিয়ে অভিনয় করেছেন। সে সব ছবি তাঁর অভিনয়ের জন্যই বক্স অফিস পেয়েছিল। অবশ্য ‘একদিন রাত্রে’ ছবিতে সুমিত্রা দেবী ছাড়া আর একজন অভিনেতা মন কেড়ে নিয়েছিলেন। তিনি হলেন ছবি বিশ্বাস। তাঁর লিপে মান্না দে-র গান ‘এই দুনিয়া ভাই সব সত্যি’ সবার মুখে মুখে ফিরত। সলিল চৌধুরির কী সুন্দর সুর।
কাননদেবীর বাড়িতে একবার তাঁর সঙ্গে অনেক গল্প করার সুযোগ হয়েছিল। সঙ্গে ছিলেন গায়ক জগন্ময় মিত্র। তিনি বলেছিলেন, ‘সুমিত্রার মধ্যে একজন প্রতিভাময়ী অভিনেত্রীর সব গুণই ছিল। সত্যই তাঁর ছবিগুলি দেখলে সেকথা বার বার মনে পড়ে। বাংলা চিত্র জগতে এরকম সব গুণসম্পন্না অভিনেত্রী আমরা খুব কি বেশি পেয়েছি?
মাত্র ৬৭ বছর বয়সে তাঁকে আমাদের হারাতে হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.