ফুটবলজীবনের সেরা ছন্দে থাকার সময় ভেঙেছিল গোড়ালি। বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন শেষ হয়ে গিয়েছিল। যে ইউরো কাপ ফাইনালে তিনি গোল করে নায়ক হয়েছেন, সেখানেও হয়তো খেলতে পারতেন না। ফুটবলজীবন শেষ হয়ে যেতে পারে যে চোটে, সেই অ্যান্টিরিয়র ক্রুশিয়েট লিগামেন্ট (এসিএল) ছিঁড়েছিল গত মরসুমে। সব পেরিয়ে ইউরো কাপের দলে সুযোগ এবং ফাইনালে গোল করে নজর কেড়ে নেওয়া — ক্লো কেলি বোধহয় গত এক মাসের অভিজ্ঞতা সারাজীবনেও ভুলতে পারবেন না। ফাইনালে গোলের পর তাঁর জার্সি খুলে ওড়ানোর দৃশ্য ইতিমধ্যেই ভাইরাল।
না ভোলারই কথা। ১৯৬৬-র বিশ্বকাপ জেতার পর ইংল্যান্ডের ফুটবলে গর্ব করার মতো কিছু ছিল না। গত বার পুরুষদের ইউরোয় ইংল্যান্ড ফাইনাল উঠেও হেরে যায় ইটালির কাছে। ২০১৮ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে হারে ক্রোয়েশিয়ার কাছে। ‘ইটস কামিং হোম’ স্লোগান তুললেও ‘হোম’-এ কখনওই কাপ আসেনি। সেই অভাব মিটেছে। ১৯৬৬-র পর ফুটবলে আবার গর্ব করার মতো কৃতিত্ব দেখিয়েছে ইংল্যান্ড। সেই জয়ে কেলির অবদান কম নয়।
উইন্ডমিল পার্ক এস্টেটের খাঁচা দিয়ে ঘেরা একটি মাঠে পাঁচ দাদার সঙ্গে সাত বছর বয়স থেকেই ফুটবলে লাথি মারা শুরু কেলির। ছোট থেকেই ফুটবল নিয়ে পাগল। তখন থেকেই ৯২ নম্বর বাস ধরে প্রতি বছর এক বার ইলিং থেকে লন্ডন যেত কেলি। এফএ কাপের ফাইনাল দেখতে দেখতেই স্বপ্ন দেখত, এক দিন এই মাঠে নেমে সে নিজেও গোল করবে। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে রবিবার।
এই মাঠেই খেলা শুরু করেন কেলি।
কেমন ছিল বেড়ে ওঠার সেই দিনগুলি? কেলি বলেছেন, “আমার মনে হয় না খাঁচাঘেরা মাঠে খেলে খুব বেশি ফুটবলার উঠে এসেছে। সাত বছর বয়স থেকেই দাদাদের সঙ্গে খেলা শুরু করি। আমার থেকে বয়সে ওরা অনেক বড় ছিল। খেলত বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে। গরমকালে প্রত্যেক দিনই সকালে খেলতে চলে যেতাম। বাড়ি ফিরে একটু খাবার খেয়ে আবার মাঠে।”
উইন্ডমিলের শক্ত মাঠে খেলতে গিয়ে প্রায় দিনই চোট লাগত। কেটেছড়ে যেত হাত-পা। কিছুই দমাতে পারেনি কেলিকে। দাদারা নির্দয় ছিলেন। বোন খেললেও ট্যাকল বা শট মারার সময় কোনও দয়ামায়া দেখাতেন না। কেলি বলেছেন, “ওরা বরং বাকিদের বলে দিত আমাকে কড়া কড়া ট্যাকল করতে। মাটিতে পড়ে যেতাম, কেটে যেত। আবার উঠে দাঁড়াতাম। আমার ব্যথা লাগলে কোনও দিনই ওরা এসে পাশে দাঁড়ায়নি। পরে বুঝেছিলাম, মানসিক ভাবে শক্তিশালী করে তোলার জন্যেই এ রকম করত। বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল যে, ফুটবল খেলা সহজ কাজ নয়। যদি হালকা ভাবে খেলত, তা হলে হয়তো এতটা মানসিক শক্তি আসত না আমার। অস্বীকার করে লাভ নেই, আজ আমি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, তার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান খাঁচায় ঘেরা ওই মাঠে খেলারই।”
স্কুলে থাকাকালীন কেলিকে পছন্দ হয়েছিল কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্স ক্লাবের। তারা সই করায়। খাঁচায় ঘেরা মাঠ ছেড়ে সেই প্রথম কোনও পেশাদার ক্লাবে সই করা কেলির। পেশাদার ফুটবলার হিসাবে আত্মপ্রকাশ আর্সেনালে। বাবা নোয়েল এবং মা জেনের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছেন ফুটবলার হয়ে ওঠার এই সময়টায়। প্রায় প্রতি ম্যাচেই বাবা-মা হাজির থাকতেন।
লন্ডনের ক্লাবে সময় ভালই কাটছিল। তবে ম্যাচ খেলার সুযোগ সে ভাবে পাচ্ছিলেন না কেলি। ২০১৬ সালে জীবনের সবচেয়ে সাহসী সিদ্ধান্তটা নিলেন। আর্সেনাল ছেড়ে যোগ দিলেন এভার্টনে। প্রথম দিকে বাড়ির জন্য মনকেমন করত। প্রতিনিয়ত বাবা-মায়ের ফোন আসত। বাড়ি ছেড়ে থাকার যন্ত্রণায় মাঝেমাঝে কেঁদেও ফেলতেন। তবে অটুট বিশ্বাস রেখেছিলেন নিজের সিদ্ধান্তের উপরে। সেই নিয়ে বলেছেন, “যদি এভার্টনে না যেতাম, তা হলে আজ হয়তো (ম্যাঞ্চেস্টার) সিটিতে খেলার সুযোগ পেতাম না। আর্সেনালের মতো ক্লাবে রিজার্ভ বেঞ্চে বসে থাকাটাও হয়তো অনেক সম্মানের। তবে আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল মাঠে নেমে খেলা। নিজের দক্ষতা প্রমাণ করার জন্যে ওটাই সবচেয়ে বড় জায়গা। আমার মনে হয় না ছোট বয়সে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সেটা অন্য কেউ পারত। এভার্টনে যাওয়া দরকার ছিল।”
এভার্টনে প্রথম মরসুমেই কামাল করে দেন কেলি। ন’টি গোল করেন। গোলদাতাদের তালিকায় ছিলেন চার নম্বরে। সিটি নজর রেখেছিল শুরু থেকেই। ২০২০-র জুলাইয়ে কেলিকে সই করায় তারা। প্রথম মরসুমেই ১০টি গোল এবং ১১টি অ্যাসিস্ট কেলির নামের পাশে।
ইউরো কাপে খেলার আগে জাতীয় দলের হয়ে সময়টা মোটেও সহজ ছিল না। ২০১৮-র নভেম্বরে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে পরিবর্ত খেলোয়াড় হিসাবে অভিষেক। সেই ম্যাচেই গোড়ালিতে চোট পেয়ে দীর্ঘ দিনের জন্যে ছিটকে যান। ফেব্রুয়ারিতে অস্ত্রোপচার হয়। ছ’মাস মাঠের বাইরে ছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই বিশ্বকাপের দলে সুযোগ পাননি। গত মরসুমে এসিএল-এ চোট ইউরো কাপে খেলা নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল। ফুটবলই শুধু নয়, যে কোনও খেলাতেই এসিএলের চোট কেরিয়ার শেষ করে দিতে পারে। মারাত্মক এই চোটও দমাতে পারেনি কেলিকে। ঠিক সময়ে সুস্থ হয়ে উঠে সারিনা ওয়েগম্যানের দলে জায়গা করে নেন।
সাত বছর বয়স যে স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল, রবিবার ওয়েম্বলির মাঠে ১১০ মিনিটে করা গোলে তা অবশেষে সার্থক।