ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করলে মানুষ কেবল নিজের বিনাশই ডেকে আনতে পারে। এরাজ্যের বাঙ্গালি হিন্দু আজ সেই অপরাধে বিনাশের দোরগোড়ায় উপস্থিত। নিজেদের শেষ আশ্রয়স্থল পশ্চিমবঙ্গকেও তারা হারাতে বসেছে। একজন মুখোপাধ্যায় (শ্যামাপ্রসাদ) প্রাণান্ত চেষ্টায় অখণ্ড বঙ্গের যে অংশটা তাদের জন্য ১৯৪৭-এ আদায় করতে পেরেছিলেন, একজন বন্দোপাধ্যায় (মমতা) আজ সেটাকে বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের অবাধ চারণ ভূমি বানাতে উঠে-পড়ে লেগেছেন। তাঁর হিংস্র NRC (জাতীয় নাগরিকপঞ্জী) বিরোধিতার আর কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা হতে পারে না। বিপদটা ঠিকমতো বুঝে এখনই যথাযথ প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে না পারলে আগামী দু’ এক দশকের মধ্যে বাঙ্গালি হিন্দুকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে বাকি ভারতের রাজ্যে রাজ্যে ছিন্নমূল উদ্বাস্তু হয়ে ঘুরতে হবে—ঠিক কাশ্মীরি পণ্ডিতদের মতো দশা হবে তাদের।
যেসব তথাকথিত উদারনৈতিক, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী-সাহিত্যিক অনবরত ‘রাজনীতিতে ধর্ম কেন, প্রশ্ন তুলে মড়াকান্না কেঁদে চলেছেন, তারা (ক) ভারত ভাগের তথা বাঙ্গলা বিভাগের ভিত্তিটাকেই অস্বীকার করেছেন, এবং (খ) দুরপনেয় মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদকে তুষ্ট ও পুষ্ট করে দেশের মধ্যে অগণিত ছোটো ছোটো পাকিস্তান বানিয়ে ফেলছেন। এ ব্যাপারে এই মুহূর্তে অগ্রণী ভূমিকায় রয়েছেন জ্ঞান-জর্জর পশ্চিমবঙ্গের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়।
(ক) ভারত ভাগের তথা বাঙ্গলাবিভাগের ভিত্তি জাতীয়তাবাদের তিনটি মুখ্য উপাদান হলো ভাষা, জাতি (নৃতাত্ত্বিক অর্থে) ও ধর্মের ঐক্য (unity of language, ethnicity/race and religion)। এগুলির মধ্যে কেবল ধর্মের ভিন্নতার কারণে ভারতের মুসলমানরা ১৯৪৭ সালে তুমুল আন্দোলন ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে ভারত ভেঙে শুধু মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি (“a separate homeland for Mulsims alone) হিসেবে পাকিস্তান নামে। একটি পৃথক বাসভূমি আদায় করে নেয়। সাথে সাথে স্বাধীন ভারতে তাদের অস্তিত্বের যৌক্তিক ভিত্তিও (raison d’etre) কিন্তু নষ্ট হয়ে যায়। সংখ্যালঘুদরদিরাজনৈতিক দলগুলি এবং বিশ্বপ্রেমিক বাহাদুর বুদ্ধিজীবীরা এই নিদারুণ সত্যটি সুবিধামতো ভুলে থাকেন এবং সবাইকে ভুলিয়ে দিতে চান। মুসলমানরা ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের জনসংখ্যার ২৩%; আর সাধের পাকিস্তানে তাদের জন্য ভারত ভূমির প্রায় ২৩% জায়গা দিতে হয়েছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ভারতের বস্তুত পৃথিবীর কোনো দেশের রাজনীতি থেকেই ধর্মকে মুছে ফেলা যায় না। অন্যদিকে, জাতীয় স্বার্থে প্রগতিশীল আইন কানুন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ধর্মের দোহাই দিয়ে মুসলমানদের ভেটো ক্ষমতা দেওয়ারও কোনো যুক্তি নেই। কেননা মনের সুখে ইসলামি জীবন-চর্যার জন্য তারা তো সাধের পাকিস্তান আগেই বুঝে নিয়েছেন।
মুসলমান ভোটব্যাঙ্ক সৃষ্টির পাপ—এই ধ্বংসাত্মক ধারণাটি নির্মাণের ক্ষেত্রে আদি পাপী হলেন জওহরলাল নেহেরু ও তাঁর কংগ্রেস; সহযোগিতায় সি পি আই অর্থাৎ কমিউনিস্টরা। নেহেরুর নিম্নোক্ত অপকর্মগুলি ইসলামি বিচ্ছিন্নতাবোধকে পুষ্ট করে জাতীয়। সংহতির স্থায়ী ক্ষতি করে গেছে—
(ক) মুসলমানদের ধর্মীয় স্পর্শকাতরতার অজুহাতে সংবিধান-প্রতিশ্রুত অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়ন থেকে বিরত থাকা। (খ) সংবিধানের ৩৭০ ধারা সন্নিবিষ্ট করে জম্মু-কাশ্মীরকে Special status দেওয়া এবং আর্টিকল ৩৫-এ-র মাধ্যমে কাশ্মীরি মুসলমানদের ‘অতি-নাগরিক’বানিয়ে ফেলা, কার্যত চিরস্থায়ী নতুন জামাই করে রাখা। বাস্তবিকই কাশ্মীর সমস্যা দেশবাসীর প্রতি নেহরুজির প্রীতি উপহার। সুখের বিষয়, ৫-৮-১৯ তারিখে রাষ্ট্রপতির আদেশবলে এই দুষ্ট ধারা দুটির বিলুপ্তি ঘটেছে।
(গ) ১৯৬০-এর দশকের শুরুতেই বাধ্যতামূলক পরিবার পরিকল্পনা চালু না করে মুসলমানদের বেপরোয়া সংখ্যাবৃদ্ধির সুযোগ অটুট রাখা।
পরবর্তীকালে আরও অনেক রাজনৈতিক দল নেহরুজির পথ ধরে জাতীয় স্বার্থের তোয়াক্কা না করে স্রেফ ভোটের লোভে মুসলমান তোষণের অশুভ প্রতিযোগিতায় নগ্নভাবে ঝাপিয়ে পড়েছে।
সাম্প্রদায়িক দল কোনটি এবং কীভাবে : যিনি মানুষের খণ্ড পরিচয় অর্থাৎ জাতিগত পরিচয় (নৃতাত্ত্বিক অর্থে—যেমন বাঙ্গালি, বিহারি, ওড়িয়া, তামিল, রাজপুত, নাগা, মারাঠী, পঞ্জাবি প্রভৃতি), ধর্মীয় পরিচয় (যেমন—হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ প্রভৃতি), ভাষাগত পরিচয় (যেমন—বাঙ্গালি, ওড়িয়া, অসমিয়া, তামিল, কন্নড়, হিন্দিভাষী প্রভৃতি), আঞ্চলিক পরিচয় (যেমন—অসাম, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র, কাশ্মীর, নাগাল্যান্ড, তামিলনাড়ু প্রভৃতি অঞ্চলে ভূমিপুত্রদের জন্য অসংগত অগ্রাধিকার বা privilege-এর দাবি), অথবা অন্য কোনো পরিচয়কে তার সামগ্রিক পরিচয় অর্থাৎ মানবিক বা জাতীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন, এমনকী বিরুদ্ধে দাঁড় করান, তিনিই সাম্প্রদায়িক। আর যিনি প্রতিটি ভারতীয়ের সামগ্রিক মানবিক পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে তাকে অভিন্ন আইনের কাঠামোর মধ্যে এনে পূর্ণ নাগরিকের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তিনি অসাম্প্রদায়িক।
এই সংজ্ঞা মেনে নিতে কারও কোনো আপত্তি থাকতে পারে না এবং এই মানদণ্ডে ভারতের একমাত্র অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হলো বিজেপি বা ভারতীয় জনতা পার্টি। কারণ, একমাত্র এই দলই অবিচলভাবে দাবি করে যে, প্রতিটি ভারতীয় তার খণ্ড পরিচয়ের গৌরব বজায় রেখেও দেশের সামগ্রিক স্বার্থের কথা ভেবে জাতীয় প্রশ্নে তার জাতীয় অর্থাৎ ভারতীয় পরিচয়েই ভোট দেবেন। পক্ষান্তরে, অন্যান্য জাতীয় বা আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল, এমনকী উত্তরাধিকার-সূত্রে শাসন ক্ষমতার দাবিদার কংগ্রেসও জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে দেশবাসীর কোনো না কোনো খণ্ড পরিচয়কে উস্কে দিয়ে নির্বাচনে বাজিমাত করতে চায়। মুসলমানদের তো এরা স্বতন্ত্র বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিমানুষ হিসেবেই গণ্য করে না, কেবল ধর্মীয় সত্তা-সর্বস্ব একটা ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে দেখে। গির্জা বা মসজিদ যখন দলবিশেষকে ভোট দিতে বা না দিতে ফরমান জারি করে, তখন সেটাই হয়। সাম্প্রদায়িকতার চূড়ান্ত নিদর্শন।
ভরসার কথা এটাই যে, জনগণ এদের উস্কানিতে সাময়িকভাগে প্ররোচিত ও বিভ্রান্ত হলেও শেষ পর্যপ্ত দেশের তথা জাতির স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়। এটা মোটেই আকস্মিক ব্যাপার নয় যে, স্বাধীনতার দীর্ঘ ৭২ বছর পরেও (ক) উন্নয়নের স্বার্থে দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন ও (খ) দৃঢ় জাতীয়তাবাদের প্রয়োজনে (যেটা স্বাধীনতার প্রথম দশকেই মিটে যাওয়া উচিত ছিল।) দেশের মানুষ ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি-রনরেন্দ্র মোদীকেই বিপুলতর সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী করেছে। নিছক ক্ষমতালোভীদের খিচুড়ি সরকারের হাতে পড়লে দেশ বিপন্ন হবে, আখেরে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, সেটা বুঝতে জনগণ ভুল করেনি।
১৯৭৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে বামফ্রন্ট তথা সি পি এম-এর অপশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যখন একটা পরিত্রাণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল, তখন মমতা ব্যানার্জি এলেন তাঁর ধমক-চমক-ধাপ্পার রাজনীতি নিয়ে। এবং ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো রাজ্যবাসী তাকেই পরিত্রাতা ভেবে সমর্থন করলো। অথবা বলা যায়, বহুতল বাড়িতে আগুন লাগলে মানুষ যেমন দিশেহারা হয়ে রেলিংটপকে নীচে ঝাপ দেয়, তেমনিভাবে ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তৃণমূলকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় বসালো। এটা যে এক মরণ-ঝাপ, তা বুঝতে অবশ্য রাজ্যবাসীর মোটেই দেরি হলো না। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা হয়ে উঠলেন চূড়ান্ত উদ্ধৃঙ্খল, উদ্ধত ও স্বৈরাচারী। এটা বুঝেও বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির অনুপস্থিতির কারণে ২০১৬-র নির্বাচনে টিএমসি-র জবরদস্তির কাছে মানুষ অসহায় আত্মসমর্পণ করলো। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেই মমতা ব্যানার্জির স্বেচ্ছাচারিতা লাগামছাড়া হয়ে গেল। কেন্দ্রের নেহরু-গান্ধী পরিবারের আদলে তিনি রাজ্যে ব্যানার্জি ডাইনাস্টি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হলেন, ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জিকে দলের শীর্ষে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করলেন। মানুষ বুঝে গেল যে, আন্দোলনকারী হিসেবে মমতা যতটা সফল, প্রশাসক হিসেবে ঠিক ততটাই ব্যর্থ এবং বিপজ্জনক।
মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা ব্যানার্জির কাজ মাত্রেই অকাজ। (১) তৃণমূল সরকার শুরু থেকেই উৎসব-মহোৎসবে মেতে উঠল—সারা রাজ্যের ক্লাবগুলিকে লক্ষ লক্ষ টাকা বিলিয়ে দেওয়া হলো; ছলে-ছুতোয় যখন তখন রকমারি উৎসবের—যাত্রা উৎসব, মাটি উৎসব ইত্যাদি অনুষ্ঠান হলো। এর সবটাই অনুৎপাদনশীল অপব্যয়। অন্যদিকে, অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে একাধিক বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলন করেও শিল্পের দেখা মিললো না। মমতার উন্নয়নকাণ্ড স্রেফ বিউটিশিয়ানের কারিগরি। রাস্তায় ত্রিফলা বাতি লাগানো, আর নানা জায়গায় কিছু পার্ক ও পুকুরপাড় সাজিয়ে তোলা।
(২) পার্কস্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডকে মুখ্যমন্ত্রী ‘সাজানো ঘটনা বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন; আর কামদুনির ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় অত্যাচারিত পক্ষকে তিনি সরকারি ও দলীয় ক্ষমতার জাঁতাকলে পিষে নিরস্ত করতে চেয়েছিলেন।
(৩) ভবানীপুরের এক ক্লাবের কিছু সদস্য মারামারি করে গ্রেপ্তার হলে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং রাতের বেলায় থানায় গিয়ে পুলিশকে ধমকে-চম্কে তাদের ছাড়িয়ে নেন।
(৪) স্রেফ একটা কার্টুন সোশ্যাল মিডিয়ায় ফরোয়ার্ড করার জন্য তার দল ও সরকার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে নিগ্রহের চূড়ান্ত করে।
(৫)সভাস্থলে সারের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলার অপরাধে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ছত্রধর মাহাতোকে ‘মাওবাদী’ আখ্যা দিয়ে গ্রেপ্তার করান এবং জেল খাটান।
(৬) মমতা এ রাজ্যে ইমামভাতা চালু করেন, নানা স্থানে সংখ্যালঘু ভবন নির্মাণ করেন, মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীর কল্যাণের জন্য গাদাগুচ্ছের প্রকল্প চালু করেন, সর্বোপরি, হিন্দু OBC-কে বঞ্চিত করে মুসলমানদের গায়ের জোরে OBC বানিয়ে শিক্ষা ও চাকুরিক্ষেত্রে তাদের জন্য অন্যায়ভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন।
বস্তুত, আলাদা করে মুসলমানদের কল্যাণ সাধনের ধারণাটাই অযৌক্তিক এবং অন্যায়। দেশের রাস্তা-ঘাট ভালো হলে, কৃষিতে ফলন বাড়লে, বিদ্যুৎ সরবরাহের উন্নতি হলে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি হলে হিন্দুর মতো মুসলমানও তাতে সমানভাবে উপকৃত হয়। রাষ্ট্রের কাজ শুধু এটা নিশ্চিত করা যে, ধর্মবিশ্বাসের কারণে কোনো ভারতীয়কে যেন পড়াশুনা, চাকুরি, ব্যবসা বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্যের শিকার হতে না হয়। তাই, মুসলমানদের বৈষয়িক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে সাচার কমিটি বানানোর কাজটি ছিল দুরভিসন্ধিমূলক। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, মুসলমানদের মধ্যে একটা ভিত্তিহীন বঞ্চনাবোধ জাগিয়ে তাদের সম্মিলিত ভোট কাছে টানা। কংগ্রেস এই অপকর্মটি করেছে চুপিসারে, আর মমতা ব্যানার্জি করছেন রণহুংকার দিয়ে।
NRC বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর ঘোষিত উদ্দেশ্য হলো ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টের পর প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে যেসব মানুষ। অবৈধভাবে ভারতে এসে বসবাস করছেন, তাদের চিহ্নিত করা এবং তাদের ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া। আর, নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিলের লক্ষ্য হলো দেশভাগের সময়ে বা তার পরে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান-সহ পাশ্ববর্তী দেশগুলি থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যেসব মানুষ প্রধানত হিন্দু তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে অত্যাচারিত হয়ে ভারতে চলে এসেছেন, তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দান। সেখানে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কোনো cut-off date হিসাবে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। দেশভাগের অসহায় বলি এই মানুষগুলিকে নাগরিকত্ব দিয়ে মানবিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা স্বাধীন ভারতের ঐতিহাসিক দায়। বিল দুটি পরস্পরের পরিপূরক এবং সর্বতোভাবে ন্যায়সম্মত। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদেরও (যারা স্বাধীনতার সময় থেকেই এরাজ্যের বাসিন্দা) এতে স্বার্থ আছে। তারাও নিশ্চয়ই চাইবেন না যে, বাংলাদেশ থেকে মুসলমান অনুপ্রবেশকারীরা এসে তাদের জীবিকায় ভাগ বসাক। দু’টি উদ্যোগকেই অকুণ্ঠ সমর্থন ও সাধুবাদ জানানো সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন। মানুষেরই কর্তব্য। অথচ কী আশ্চর্য! মমতা ব্যানার্জি NRC-র বিরোধিতায় ক্ষেপে উঠেছেন, আর নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিলও তিনি সমর্থন করছেন না। তার অভিসন্ধি কিন্তু সরল এবং সোজা তিনি চাইছেন, দু’টি বিল থেকেই ধর্মীয় কারণে নিপীড়নের প্রশ্নটি উঠে যাক এবং বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী মুসলমানরা কাতারে কাতারে এসে তার মুসলমান ভোট ব্যাঙ্ক বাড়িয়ে তুলুক, তাতে রাজ্য তথা দেশের যত সর্বনাশই হোক না কেন।
জীবজগতে কোনো প্রজাতির বিপন্নতার কারণ দ্বিবিধ—(১) প্রাকৃতিক ও (২) জৈবিক। কেউ কেউ বলেন, অতীতে কোনো এক সময়ে অতিকায় উল্কাপাতের ফলে ডাইনোসরদের বিলুপ্তি হয়ে থাকতে পারে। এটি প্রকৃতিক কারণ। আবার, বনাঞ্চল ধবংস করে মনুষ্য-বসতি সম্প্রসারণের ফলেই নাকি রয়াল বেঙ্গল টাইগার ক্রমশ পিছু হটে সুন্দরবন অঞ্চলে ঘাঁটি গাড়তে বাধ্য হয়েছে। এটি প্রাকৃতিক ও জৈবিক কারণের সম্মিলিত ফল।
বাঙ্গালি হিন্দুর বিপন্নতার গতিপথটি এরকম ঃ ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে অত্যাচারিত হয়ে তারা যে যখন পেরেছে। পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের ফলেও হিন্দুর অবস্থার কিছুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। কেননা, বাংলাদেশ সর্বার্থে পূর্ব পাকিস্তানেরই বাঙ্গালি সংস্করণ মাত্র। বস্তুত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে বাঙ্গালি হিন্দু পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের হাতে যতটা অত্যাচারিত হয়েছে, তার চাইতে শতগুণ শরণার্থীর স্রোত পশ্চিমবঙ্গে অব্যাহত রয়েছে। তার সাথে ভয়ংকর এক নতুন উপসর্গ যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ নামক মনুষ্য প্রজনন খামারে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত মুসলমানদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ জীবিকার সন্ধানে বা জেহাদি জোশে উদ্বুদ্ধ হয়ে অবাধে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়ছে, এরাজ্যের জন-বিন্যাসকে পাল্টে দিয়ে বাঙ্গালি হিন্দুর জীবন-জীবিকাবিপন্ন করে তুলছে।
পূর্ববঙ্গ থেকে বিপুল সংখ্যক হিন্দু শরণার্থীর আগমন সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুর তুলনায় মুসলমানের অনুপাত আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এর একমাত্র ব্যাখ্যা হলো–মুসলমান জনসংখ্যার দ্রুততর বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ থেকে অগণিত মুসলমান অনুপ্রবেশকারীর আগমন। এখনও সতর্ক না হলে অদূর ভবিষ্যতে বাঙ্গালি হিন্দুর বাঁচার জায়গা থাকবে কি?
‘জয় শ্রীরাম’বনাম ‘জয় বাংলা’—ভারত বনাম পশ্চিমবঙ্গ ও যাত্রাপথে কোথাও ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি শুনলেই মমতা ব্যানার্জি গাড়ি থেকে নেমে তেড়ে যাচ্ছেন স্লোগান দাতাদের শায়েস্তা করতে। বশংবদ পুলিশকে দিয়ে তিনি সেখানে যাকে তাকে শুধু ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দেবার অপরাধে মিথ্যে অভিযোগে গ্রেপ্তার করাচ্ছেন। অথচ ১৯৯১-৯২ সালে ঘোর বাম জমানায়ও এরাজ্যে ‘জয় শ্রীরাম’ কোনো সরকারি দমন-পীড়নের সম্মুখীন হয়নি।‘জয় শ্রীরাম’-এর স্থলে ‘জয় ভারত’, ‘জয় হিন্দ’, ‘জয় দুর্গা’, ‘জয় কালী’ ইত্যাদি বলে মমতা ব্যানার্জি শেষ পর্যন্ত ‘জয় বাংলায় পৌঁছে। গেছেন। আর কে না জানে, ‘জয় বাংলা’হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের যুদ্ধনাদ। এ কোন্ সর্বনাশা ইঙ্গিত ? তবে কি, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের বোকা বানিয়ে তিনি কোনো আঞ্চলিক স্বাধীনতা যুদ্ধে ঠেলে দিতে চাইছেন?
আবার দেখুন, রাজ্যে ক্ষমতালাভের পর থেকেই মমতা ব্যানার্জি যুক্তরাষ্ট্রীয়তার দোহাই দিয়ে ধারাবাহিকভাবে পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছেন, পদে পদে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করছেন। সারদা কাণ্ডে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের এক বড় কর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে সিবিআই-এর একটা টিম তার বাড়িতে গেলে রাজ্য পুলিশ উল্টে তাদেরই আটক ও হেনস্তা করে। সংবিধানের কাশ্মীর সংক্রান্ত 370 ও 35(A) ধারার বিলুপ্তি ঘোষণা করে রাষ্ট্রপতির আদেশটি অনুমোদনের জন্য গত ৫-৮-১৯ তারিখে রাজ্যসভায় পেশ করা হলে সেটার বিরোধিতা করে তৃণমূলের সাংসদরা ওয়াক-আউট করেন।হ্যামলেটের পাগলামির মতোই তার আপাতখ্যাপাটে কথাবার্তা ও কাজকর্মের মধ্যে একটা গূঢ় অভিসন্ধি সতত ক্রিয়াশীল। মুসলিম আগ্রসন ও বিচ্ছিন্নতাবাদকে উস্কে দিয়ে নিজের মুসলমান ভোটব্যাঙ্ককে মজবুত করে তিনি ব্যানার্জি বংশের পত্তন করতে চাইছেন এবং সেটা বাঙ্গালি হিন্দুর সর্বনাশের মূল্যে।
EVM-এ কারচুপির প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনের প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জের কাছে সব রাজনৈতিক দল যখন উপর্যুপরি হার মেনেছে, তখনও TMC-র সাংসদরা লজ্জার মাথা খেয়ে গত ২৬-৬-১৯ তারিখে পার্লামেন্ট চত্বরে গান্ধী মূর্তির পাদদেশে ধরনায় বসলেন এবং লোক হাসালেন। নিজের রাজনৈতিক পুঁজি একেবারেই শূন্য হয়ে গেছে বুঝে মমতা ব্যানার্জি এখন ব্যালটকেই শেষ ভরসা বলে আঁকড়ে ধরছেন। কারণ, পুলিশের সহায়তায়। জবরদস্তি করে প্রতি মিনিটে একশো জাল ভোট ব্যালটবাক্সে ভরা সম্ভব। হায়রে দুর্মতি।
গত জুন মাসের গোড়ার দিকে প্রকাশ্য দিবালোকে তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ট্রাক ভর্তি করে এসে শাজাহান শেখের নেতৃত্বে সন্দেশখালির ভাঙ্গিপাড়ায় হামলা চালায়। তাতে বিজেপির সমর্থক প্রদীপ মণ্ডল ও সুকান্ত মণ্ডল খুন হয়। দিদির অনুগত পুলিশ খুনীদের শাস্তিবিধানের জন্য যথারীতি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি।
এই ঘটনার দু’চার দিন পরে NRS হাসপাতালে মহম্মদ সইদ নামে এক মুমূর্য হৃদরোগীর মৃত্যু হলে ট্যাংরা কলোনির বিবির বাগান এলাকা থেকে ট্রাক ভর্তি করে সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা এসে হাসপাতালে চড়াও হয় এবং কর্তব্যরত ডাক্তারদের মারধোর করে। একজন ডাক্তারের মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাত লাগে। এর প্রতিবাদে NRS-এর ডাক্তাররা কর্মস্থলে নিরাপত্তার দাবিতে অনির্দিষ্ট কালের জন্য। ধর্মঘটে নামেন। এতবড় ঘটনার পর দুষ্কৃতীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের নির্দেশ এবং চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আশ্বাস দানের বদলে মুখ্যমন্ত্রী কেবল ডাক্তারদের কাজে যোগদানের আহ্বান জানিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। ক্রমশ দেশের সর্বত্র বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা NRS-এর ধর্মঘটি ডাক্তারদের সমর্থনে কর্মবিরতি শুরু করেন; ফলে গোটা দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবা ভেঙে পড়ার উপক্রম হল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য মদগর্বী মুখ্যমন্ত্রীর সুমতি হলো–তিনি ডাক্তারদের সাথে আলোচনায় বসলেন এবং দীর্ঘ সাতটি দিন পরে ১৮-৬-১৯ তারিখে ডাক্তারদের ধর্মঘট উঠে গেল, রাজ্যের তথা দেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
আপন ভালো নাকি পাগলেও বোঝে। তবে বাঙ্গালি হিন্দু বোঝে কি-না, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে সেটাই দেখার ছিল। এই পরীক্ষায় সে কোনোমতে উতরে গেছে। ৪২-এর মধ্যে ১৮টি আসন থেকে TMC-কে দুর করতে পেরেছে। আসল পরীক্ষা এখনও বাকি। 2021-এর বিধানসভা নির্বাচনে মমতার TMC-কে সমূলে বিনাশ করতে না পারলে বাঙ্গালি হিন্দু নামক বিপন্ন প্রজাতিটি অবধারিত বিলুপ্তির গ্রাসে পড়বে।
মমতা ব্যানার্জিকে নিয়ে মুশকিল এই যে, তিনি মেরেও জিতবেন, আবার কেঁদেও জিতবেন। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের মিটিং, মিছিলে তার ভাইয়েরা অনবরত হামলা করবে, এমনকী বাড়ি-বাড়ি গিয়ে প্রচারেও বাধা দেবে, আর উনি কঁদুনি গাইবেন শান্ত পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি অশান্তি ছড়াচ্ছে, মারামারি-খুনোখুনি শুরু করছে। এই ধোঁকাবাজি মানুষ ধরে ফেলেছে। মমতা ব্যানার্জির পশ্চিমবঙ্গে বিগত পঞ্চায়েত ও লোকসভা নির্বাচনে যত মানুষ। খুন-জখম হয়েছে, তার 10% ও অন্য কোনো রাজ্যে হয়নি। আবার, ভিন্ন দলের, বিশেষ করে বিজেপি-র, রাজনৈতিক প্রচারকে উনি সর্বদা বাংলার সংস্কৃতির পরিপন্থী বলে দুষছেন; অথচ, গালিগালাজপূর্ণ ভাষণ ও আক্রমণাত্মক অঙ্গভঙ্গির দৌলতে উনি নিজেই হয়ে উঠেছেন মূর্তিমতী অপসংস্কৃতি।
দুনীতি, তোলাবাজি ও দমন-পীড়নের ক্ষেত্রে সিপিএম যেখানে শেষ করেছিল, টিএমসি সেখান থেকেই শুরু করেছে, এবং এগুলিকে জনজীবনের সর্বত্র সম্প্রসারিত করছে। তবে সিপিএম-এর অত্যাচার ছিল পরিকল্পিত ও সুশৃংখল, অন্যদিকে টিএমসি-র অত্যাচার নিয়ন্ত্রণহীন ও বিশৃঙ্খল। দেশে এ মুহূর্তে দুজন সফল ধাপ্পাবাজ দু’টি রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রিত্বে অধিষ্ঠিত—একজন দিল্লিতে, অন্যজন পশ্চিমবঙ্গে; একজন sophisticated (মার্জিত), অন্যজন valgar (মেঠো)। রাজ্য শাসন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে দু’জনেই সমান বেপরোয়া, অপব্যয়ী, ধ্বংসাত্মক এবং ব্যর্থ।
নিজের অপকর্মের বিষে টি এম সি তথা মমতা ব্যানার্জি আজ যখন জর্জরিত ও মুমুর্য, তখন ঝাড়ফুকে প্রাণ বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টায় প্রশান্ত কিশোর-রূপী ওঝাকে ডেকে আনা হয়েছে। তার প্রথম দাওয়াই ‘কাট-মানি ফেরানোর ডাক’বুমেরাং হয়েছে; আর দ্বিতীয় দাওয়াই ‘দিদিকে বলো’ অভিযান মাটি ছেড়ে। উঠতেই পারেনি। দেয়ালের লিখন অতি স্পষ্ট—তৃণমূলের সমূলে বিনাশ। কিন্তু তার আগে বিপদের কথা এটাই যে, বিরোধী রাজনীতি দমনে মমতা ব্যানার্জি পুলিশকে যেভাবে যতখানি কাজে লাগাচ্ছেন, তাতে পুলিশ ক্রমশ জনগণের প্রতিপক্ষ বা শক্ত হয়ে উঠছে। এভাবে চলতে থাকলে রাজ্যে ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্য ব্যাপক রক্তক্ষয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। মমতা ব্যানার্জির বেপরোয়া এবং ধ্বংসাত্মক রাজনীতি থেকে রাজ্যটাকে বাঁচানোই এখন কর্তব্য। বাঙ্গালি হিন্দুকে মনে রাখতে হবে, মমতা ব্যানার্জিকে একটি ভোট দেওয়ার (কিংবা তার বিরুদ্ধে একটি ভোট দিতে না পারার) মানে হলো নিজের জীবিত সন্তানের জন্য আগাম চিতা সাজিয়ে ফেলা।
নন্দদুলাল চৌধুরী
2019-08-23