সপ্তাহের ছুটিতে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবছেন? কোথায় যাবেন, কীভাবে যাবেন, থাকার জায়গা আছে কি না, কী কী দেখবেন– এ সবও নিশ্চয়ই ভাবতে হচ্ছে। এবার থেকে সেই দায়িত্ব আমাদের। যাঁরা বেড়াতে ভালবাসেন, যাঁরা দেখতে চান বাংলার মুখ, তাঁদের কথা মনে রেখেই শুরু হল নতুন এই ধারাবাহিক ‘পায়ে পায়ে বাংলা’। এ হল বেরিয়ে পড়ার ভ্রমণ গাইড। এ এমন এক সোনার কাঠি, যার ছোঁয়ায় জেগে উঠবে রোজকার হাঁপিয়ে ওঠা জীবন, ফুসফুসে ভরে নেওয়া যাবে তাজা হাওয়া, মন মেতে উঠবে আনন্দে। তা হলে আর দেরি নয়। খুঁজে নিন আপনার পছন্দের জায়গা, গুছিয়ে ফেলুন ব্যাগ, হুশ করে বেরিয়ে পড়ুন সপ্তাহের শেষে। আপনার সঙ্গে রয়েছে ‘পায়ে পায়ে বাংলা’।

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পাথরা শুধু এক মন্দিরময় গ্রাম নয়, আরও কিছু। যেখানে মহম্মদ ইয়াসিন পাঠান মুসলমান হয়েও লড়াই করেন হিন্দু মন্দির বাঁচানোর জন্য। শুনে অবাস্তব মনে হলেও তাকে বাস্তবে পরিণত করেছেন ইয়াসিন পাঠান। কী অদম্য জেদ আর স্বপ্ন দেখার সাহস রাখেন মানুষটি! শুধু মন্দির বাঁচানো নয়, পাথরাকে পর্যটনস্থল করে তোলার স্বপ্ন রয়েছে তাঁর।

মেদিনীপুর শহরের অনতিদূরে ইতিহাসের উপাদানে ভরপুর পাথরা গ্রাম আজ আর ততটা অপরিচিত নয়। সংবাদমাধ্যমের দৌলতে সে আজ প্রচারের আলোয় আলোকিত। ৩৪টি মন্দিরের অবস্থান এ গ্রামকে পরিচিতি এনে দিয়েছে। মেদিনীপুর শহর থেকে ওড়িশা ট্রাঙ্ক রোড ধরে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে হাতিহলকা গ্রাম। সেখান থেকে উত্তর–পুবে পিচ রাস্তা ধরে আরও ২ কিলোমিটার গেলে কাঁসাই নদীর তীরে ছোট সুন্দর গ্রাম পাথরা। শহর থেকে রিজার্ভ করা অটো বা রুটের ট্রেকারে পাথরা পৌঁছনো যায়।

প্রখ্যাত গবেষক তারাপদ সাঁতরার একটি লেখা থেকে জানা যাচ্ছে যে, পাথরা গ্রামটি একসময় কেবল বর্ধিষ্ণুই ছিল না, গুরুত্বপূর্ণও ছিল। কারণ, ইংরেজ সার্ভেয়ার জেনারেল রেনেল সাহেবের মানচিত্রে এই গ্রাম চিহ্ণিত ছিল। কেবল তাই নয়, একসময় বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা তিনটি পথ এসে মিলেছিল এই গ্রামে। তারপর সে পথটি পাথরা থেকে মেদিনীপুর শহর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। এছাড়া গুপ্তযুগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র ছিল পাথরা। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত পাথরা যে হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈনদের আবাসভূমি ছিল তার প্রমাণ হল বিষ্ণুলোকেশ্বর মূর্তি এখান থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছে।

পাথরায় একসময় বহু মন্দির ছিল। পশ্চিমমুখী নবরত্ন মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন মজুমদার বংশের বংশধররা। এটি কংসাবতী নদীর তীর বরাবর অবস্থিত। উচ্চতা প্রায় ৫৫ ফুট। যদিও রত্ন বলতে শিখর বা চূড়াকেই বোঝায়, কিন্তু এই মন্দিরটি নাকি ন’টি মূল্যবান রত্ন যেমন মুক্তো, মাণিক্য, বজ্র, বিদ্রুম, পদ্মরাগ, মরকত, নীলকান্ত, বৈদুর্য ও গোমেদ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাই এটি নবরত্ন। পাথরায় যতগুলো মন্দির আছে তার মধ্যে সর্বোচ্চ মন্দির এটি। মন্দিরের ন’টি চূড়াই অটুট। এই রত্ন বা চূড়া ‘দ্বি’ বা ‘ত্রি’ রথবিশিষ্ট। প্রধান রত্নটি একমাত্র ত্রিরথ বাকি আটটি দ্বিরথ। স্থাপত্যটি সত্যি এক অনুপম সৃষ্টি। টেরাকোটা ভাস্কর্য কিছু অবশিষ্ট আছে। যেমন উত্তরের থামে নৃত্যরত কৃষ্ণ ও গোপিনী, দক্ষিণ থামে শিবদুর্গা ও পোড়ামাটির নকশা।

ত্রিখিলান প্রবেশপথের ওপরের দিকে এখনও কিছু অলংকরণ আছে। যেমন, একদম বাঁদিকে একটি ভাঙাচোরা ছত্রধর মূর্তি এবং প্রবেশপথের দু’ধারে একসারি ফলকসজ্জার বিষয়বস্তু ছিল দশাবতার, কৃষ্ণলীলা ও পৌরাণিক দেবদেবীর টেরাকোটা মূর্তি। মন্দিরের ভেতরে শূন্য এক গর্ভগৃহ। দু’দিকে খিলান, জানালা। এরকম একটি মন্দির বিশেষ বিশেষ তিথিতে কত জমজমাট হয়ে উঠত তা কল্পনা করা যায় সহজেই। বর্তমানে কেবলই শূন্যতার হাহাকার।

নবরত্ন মন্দিরের মতো দালানরীতির দুর্গামন্দিরটি আকারে বড় হলেও বর্তমানে তা ভগ্নস্থাপত্য। মন্দিরের লাগোয়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় যাওয়া যায়। সম্ভবত দোতলায় নহবতখানা ছিল। উপরে উঠলে চোখে পড়ে প্রশস্ত ভাঙা মণ্ডপ, বড় বড় মাকড়া পাথর দিয়ে তৈরি। নাটমন্দিরের চওড়া সমস্ত স্তম্ভ ভাঙা অবস্থায় থাকলেও এটি যে সেকালের স্থাপত্যশিল্পের এক অমূল্য নিদর্শন তা বলাই বাহুল্য।

মূল মণ্ডপটি বেশ বড় এবং চওড়া। সামনে এক খিলানের প্রবেশপথ, দেওয়ালে কুলুঙ্গি। প্রবেশপথের দু’দিকে পাথরের স্তম্ভে ঝালরের মতো নকশা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। মণ্ডপের ছাদ বিনষ্ট। কল্পনা করতে অসুবিধে হয় না, একসময় খুবই জাঁকজমক সহকারে এই মণ্ডপে দুর্গা পুজো হত। আনন্দের কথা, প্রায় দু’শো বছর পর সব সম্প্রদায়ের মানুষ নিয়ে এই দুর্গামণ্ডপে গত দশ বছর ধরে পুজো শুরু হয়েছে।

নবরত্ন ও দুর্গামণ্ডপের মাঝে জমিদারি বাঁধের উপর কালাচাঁদের দালানবাড়িটি অবস্থিত। এটি অনেকটা এলাকা নিয়ে বিস্তৃত। তার মধ্যে রয়েছে তিনটি আটচালা, চারটি দালান ও একটি পঞ্চরত্ন মন্দির। মন্দিরগুলি সংস্কার করেছে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের কলকাতা শাখা।

পাথরা সহায়ক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ঠিক আগে কংসাবতী নদীর জমিদারি বাঁধের পাশে অবস্থিত শীতলা মন্দিরটি আকর্ষণীয়। মন্দিরটি সংস্কার করার ফলে বেশ দৃষ্টিনন্দন হয়েছে। স্থানীয় গ্রামবাসীরা এটিকে বুড়িমার থান বলে অভিহিত করে থাকেন। ওড়িশার কোণার্ক মন্দিরের আদলে মন্দিরটি নির্মিত।

পাথরা ঘুরতে গেলে অবশ্যই দেখা উচিত বন্দ্যোপাধ্যায় বংশের কাছারি মহলের সামনে অবস্থিত নয় চূড়াবিশিষ্ট রাসমঞ্চটিকে। আট কোনা রাসমঞ্চের আট কোণে আটটি পেখম তোলা ময়ূরের অপূর্ব মূর্তি। কাছারি মহল ও রাসমঞ্চ দুটিরই জীর্ণ দশা ছিল। সে দশার মুক্তি ঘটিয়েছে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ। টেরাকোটা সম্বলিত তিনটি পঞ্চরত্ন শিবমন্দিরও অবশ্য দ্রষ্টব্য। এগুলিরও নির্মাতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার। উল্ল্যেখযোগ্য, মন্দিরের পোড়ামাটির দ্বারপালগুলি তিনটি মন্দিরে তিন রকম। এই মন্দিরগুলিতে অসাধারণ সব টেরাকোটা ফলক রয়েছে।

বাংলার ঐতিহ্য ও অহংকার এইসব প্রাচীন মন্দির যাঁর জন্য আত্মপ্রকাশ করেছে তিনি হলেন পরমবন্ধু মহম্মদ ইয়াসিন পাঠান। মুসলমান হয়েও নিজের জীবন বিপন্ন করে অসম সাহসিকতায় যেভাবে তিনি হিন্দু মন্দির বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন তার জন্য তাঁকে শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারা যায় না। ইসলাম ধর্ম পৌত্তলিকতা মানে না। তবু তিনি দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে ‘মন্দির বাঁচাও কমিটি’ গড়েছেন।

কাঁসাই নদীর ধারে নির্জন পরিবেশে এক মন্দিরনগরী, চারপাশে ফুলের বাগান, পর্যটকদের জন্য আবাস প্রভৃতি নিয়ে এক পর্যটনস্থলের স্বপ্ন ইয়াসিন পাঠানের চোখে। এই স্বপ্ন সফল হোক, পর্যটনস্থল হয়ে উঠুক পাথরা।

মেদিনীপুর শহরে রাত্রিবাস করে পাথরা ঘুরে নেওয়া উচিত হবে। দুটি রাত্রিবাসের ঠিকানা দেওয়া রইল।

রত্না ভট্টাচার্য্য

শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.