কলকাতা…. ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭।
সকালবেলা...
সকালের পরিবেশ এমনিতেই মনোরম হয়। কিন্তু এদিন বেলিয়াঘাট (বেলেঘাটা) অঞ্চলে তার কোনও চিহ্ন ছিলনা। চারদিকে কাদা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দুর্গন্ধ গ্রাস করেছে এলাকার আকাশ বাতাস।
গান্ধীজি প্রাতঃভ্রমণের জন্য রাস্তায় বেরিয়েছেন।আশেপাশের অঞ্চলে রাস্তার দু-ধারে ঘরবাড়ির ভাঙা ও পোড়া অংশ দেখা যাচ্ছে।দাঙ্গার পরদিন মুসলিম গুন্ডারা হিন্দুদের বাড়িঘর লুটপাট, ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দিয়েছে। গান্ধীজি নিঃশ্চুপ। চারিদকে নজর ঘুরিয়ে দেখছেন এবং সামনের দিকে হেঁটে চলেছেন। মুসলিমলীগ নেতা হুসেন সাঈদ সুহরাবর্দী কয়েকদিন ধরে বাপুজির সামনে পিছনে ঘোরাঘুরি করলেও এদিন সকালে গান্ধীজির সঙ্গে প্রাতঃভ্রমণে যোগ দেননি। কারণ তিনি দাঙ্গার কলকাতায় হয়তো অন্যকাজে ব্যাস্ত ছিলেন। তবে, মুসলীম লিগ নেতা বেলা ১১টার সময় গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করবেন বলে খবর পাঠিয়েছিলেন।
একজন কংগ্রেস কার্যকর্তা দাবী করেন যে গান্ধীজির আহ্বানে সাড়া দিয়ে কলকাতা শহরের হিন্দু ও মুসলমানদের যৌথ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এরফলে গতকাল থেকে কলকাতায় আর একটিও দাঙ্গার খবর পাওয়া যায়নি।
_ _ _ _
করাচী…সকাল ৯টা
করাচির পরিবেশ মোটামুটি শান্ত। তবে গ্র্যান্ড অ্যাসেমব্লি হলে প্রচুর বিশৃঙ্খলা রয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে।
গ্র্যান্ড অ্যাসেমব্লি হলে বিভিন্ন ধরণের মানুষ বসে আছেন। এসমস্ত লোকেরা তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের নেতা। এর মধ্যে পাঠান, আফ্রিদি, উজির, মেহসুদ, পাঞ্জাবি, বালুচ, সিন্ধি এবং মুসলমান বাঙালিরাও রয়েছে। তবে দেশ ভাগের পরে পাকিস্তানে থেকে যাওয়া হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ ও খ্রিশ্চান ধর্মাবলম্বী মানুষদের এই অনুষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিতে দেখা যায়নি। তারা অধিকাংশ অ্যাসেমব্লি হল থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের মধ্যে বিশেষ একটা উতসাহ লক্ষ্য করা যায়নি।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাঁর নৌ অফিসারের সাথে পূর্ণ সমরিক ইউনিফর্মে উপস্থিত আছেন। তাকে প্রথম বক্তৃতা করতে হবে। যে ভদ্রলোক তাঁর বক্তব্য লিখেছিলেন তিনি হলেন জন ক্রিস্টি। মাউন্টব্যাটেন দৃঢ়়তার সুরে বক্তৃতা শুরু করলেন। তিনি বলেন, “পাকিস্তানের উত্থান একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। প্রতিটি ইতিহাস আইসবার্গের মত, ধীর গতিতে বা জলের প্রবাহের মতো দ্রুত গতিতে চলে। ইতিহাসের প্রবাহের বাধাগুলি সরিয়ে দিয়ে আমাদের উচিত বর্তমান ঘটনা প্রবাহে নিজেকে জড়িয়ে দেওয়া। এখন আমাদের আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না, আমাদের কেবল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত।
আলি জিন্নাহর দিকে তাকিয়ে মাউন্টব্যাটেন বলেন, এই উপলক্ষে জনাবকে ধন্যবাদ জানাতে হবে। আমাদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব এবং ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এজন্য ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্ক ভাল থাকবে, এতে আমার পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে।”
দেশভাগের কাণ্ডারি ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক জিন্নার শরীরী ভাষা সব কিছু বলে দিচ্ছিল। শানদার শেরওয়ানি, গলা পর্যন্ত বোতাম আঁটা। এক চোখে চশমা এবং তা আবার নাকের ডগায় আটকানো! একেবারে নাটকীয় ভঙ্গিতে জিন্নাহ কথা বলতে শুরু করলেন। “যদিও ব্রিটেন এবং তাদের নির্মিত উপনিবেশগুলি আজ ভেঙে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের পারস্পরিক ভালবাসা ও বোঝাপড়া আজও অটুট আছে। আমাদের পবিত্র ইসলামের পক্ষে যা গত ১৩০০ বছর ধরে বিদ্যমান, আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে পাকিস্তান অন্যান্য ধর্মের প্রতি সহনশীলতা অনুসরণ করে চলবে। আমাদের প্রতিবেশী এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পাকিস্তান কখনই পিছিয়ে থাকবে না ….! “
এই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার পরে, তিনি পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসাবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন। এর সাথেই আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে।
এই পর্বের পরবর্তী পর্যায়ে ছিল শোভাযাত্রা সহকার মিছিল। শোভাযাত্রাটি একটি সুসজ্জিত ছাদ খোলা রোলস রয়েস গাড়িতে চেপে অ্যাসেম্বলি হল থেকে গভর্নর হাউস পর্যন্ত শোভাযাত্র করেন জিন্না। এই তিন মাইল রাসতার দুদিকে অগনিত মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। তারা করতালি, হাত নেড়ে ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ভালবাসা জানান। জিন্নাহ ও লর্ড মাউন্টব্যাটেন গাড়ীর পিছনের সিটে বসে ছিলেন। একুশটি বন্দুকের মাধ্যমে তোপধ্বনি করে সেনাবাহিনীর তরফে অভ্যর্থণা জানানো হয়। গাড়ি ধীরগতিতে গভর্নর হাউসের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
রাস্তার দুপাশে ভিড়করে প্রচুর মানুষ দাঁড়িয়েছিল। হাজার হাজার পাকিস্তানি, জিন্নার নাম নিয়ে চিৎকার করছিল। পুলিশ ও সৈন্যরা নিরজত্তার দায়িত্ব সামলাচ্ছিল। তিন মাইলের এই দূরত্বটি অতিক্রম করতে অনেকটা সময় লেগে যায়।
গভর্নর হাউসের মূল প্রবেশ পথে গাড়ি থামার পর জিন্নাহ তার শুষ্ক হাতটি মাউন্টব্যাটেনের হাঁটুর উপর রেখে কিছুটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, “ইনশাআল্লাহ … আমি আপনাকে বাঁচিয়ে আনতে পারলাম…!”
মাউন্টব্যাটেন জিন্নাহর দিকে কিছুক্ষণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলেন। আর মনে মনে বলতে থাকলেন, কে কাকে বাঁচিয়েছে তা বিশ্ব দেখছে….! আরে বদমাস …..আমার কারণেই তুমি এখান পর্যন্ত জীবিত আবস্থায় ফিরে আসতে পেরেছ…!’
_ _ _ _
শ্রীনগর… সকাল ১০টা।
শহরের প্রধান ডাকঘরের কর্মকর্তারা অফিসে পাকিস্তানের পতাকা লাগাচ্ছেন। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা সংঘের দুই স্বয়ংসেবক তৎখনাত পোস্ট মাস্টারের কাছে জানতে চেয়েছেন, আপনি কীভাবে পাকিস্তানের পতাকা এখানে লাগাতে পারেন? স্বয়ংসেবকরা পোস্টমাস্টারকে এটাও স্মরণ করিয়ে দেন মহারাজা হরি সিংহ কাশ্মীরকে পাকিস্তানের সাথে মিলিয়ে দেয়নি।
তখন, ওই মুসলিম পোস্টমাস্টার বলেন, শ্রীনগর পোস্টঅফিস এখন শিয়ালকোট সার্কেলের আওতায় রয়েছে। দেশভাগের পর শিয়ালকোট পাকিস্তানের অঙ্গ হয়েগেছে, তাই আমরা এই পোস্টঅফিসে পাকিস্তানের পতাকা প্রদর্শন করেছি।
উভয় স্বেচ্ছাসেবক জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাদেশিক গভর্নর প্রেমনাথ ডোগরাকে এই ব্যাপারে অবহিত করেন। ডোগরাজি সঙ্গে সঙ্গে মহারাজ হরি সিংহের কার্যালয়ে বার্তাটি পৌঁছে দিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন। ইতিমধ্যে দশ থেকে পনেরোজন স্বয়ংসেবক মূল পোস্টঅফিসে জড় হন। স্বয়ংসেবকরা পোস্ট মাস্টারকে তাদের আপত্তির কথা বুঝিয়ে বলতে সমর্থ হন এবং আধ ঘন্টার মধ্যে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে দিয়ে স্বয়ংসেবকরা স্থান ত্যাগ করেন।
——-
করাচি …… দুপুর ২টা
লর্ড মাউন্টব্যাটেন এবং লেডি মাউন্টব্যাটেন দুজনেই সকালের অনুষ্ঠানে দরবারি পোশাক পরেছিলেন। সেই পোষাক পরিবর্তন করে নতুন পোষাকে দিল্লির উদ্দেশে রওনা হন তাঁরা। দুজনকেই বেশ খুশি লাগছিল। রাত্রে তাদের ভারতের রাজভবনে স্বাধীন ভারতবর্ষের সমারোহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হবে।
সদ্য গঠিত পাকিস্তানের প্রথম অতিথি হিসাবে গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও লেডি মাউন্টব্যাটেনকে বিদায় জানান মহম্মদআলি জিন্নাহ ও তাঁর বোন ফাতিমা।
_ _ _ _
কলকাতা বিমানবন্দর … বিকাল ৩টা …
দেশভাগের ফলে নবগঠিত প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গর রাজ্যপাল হিসাবে নিযুক্ত হন চক্রবর্তী রাজাগোপালচারী। তিনি বিশেষ বিমান দিল্লি থেকে কলকাতায় আসছেন। রাজাজীর শপথ অনুষ্ঠান আজ রাতেই অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। বিমানবন্দরে কিছু কংগ্রেস কর্মী জড়ো হয়েছেন। তবে তাদের মধ্যে কোনও উৎসাহ নেই। কারণ বাংলায় রাজাজীর বিরোধ অব্যাহত রয়েছে। বাংলার মানুষ দ্বারা রাজাগোপালচারীর আক্রান্ত হওয়ার প্রতিবাদে সুভাষ চন্দ্র বসুর ভাই, বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বসু ইতিমধ্যেই পদত্যাগের চিঠি জমা দিয়েছেন।
গভর্নর হাউসের কয়েকজন কর্যকর্তা রাজাজীকে তাঁর বিশেষ গাড়িতে করে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি গভর্নর হাউসে নিয়ে আসেন।
—–
সিঙ্গাপুর ….
সিঙ্গাপুরের ‘ভারতীয় স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটি – মলয় এয়ারওয়েজ’ এর সঙ্গে দিবটি বিষেশভাবে উজ্জাপনের জন্য পরিকল্পনা করেছিল। মলয় এয়ারওয়েজের একটি বিশেষ বিমান প্যাডাংয়ের ওয়াটারলু স্ট্রিটের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার কথা ছিল। যখন সেখানে ভারতের ত্রিরঙ্গা পতাকা উত্তোলন হবে ঠিক সেই সময় ওই বিমান থেকে পুষ্পবৃষ্টি করার কথা ছিল। বিমানটিতে সুভাষচন্দ্র বসুর ‘আজাদ হিন্দ বাহিনীর’ ‘রানী ঝাঁসি রেজিমেন্ট’-এর কিছু সেনা এবং ‘বাল সেনার’ কয়েকজন সেনা আধিকারিক থাকার কথা ছিল।
কিন্তু ‘আজাদ হিন্দ বাহিনীর’ এই কর্মসূচীর উপর সিঙ্গাপুর সিভিল এভিয়েশন বিভাগ আপত্তি জানায় এবং এই বিমান সঞ্চালনের অনুমতি বাতিল করে দেয় …! আগামীকাল ‘ভারতীয় স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটি’ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের পরিকল্পনা করে।
——
করাচি …. বিকেল ৪টা।
পাকিস্তানের করাচি শহরের মাঝখানে সংঘের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি পারিবারের বিশাল বাড়ি রয়েছে। বাড়ির দুই মহিলা রাষ্ট্র সেবিকা সমিতির সক্রিয় সদস্য। প্রাসাদ প্রমান বাড়ির ছাদে স্বয়ংসেবিকাদের একত্রিকরণের একটি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। করাচি শহরের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনবসতি থেকে রাষ্ট্র সেবিকারা ওই বাড়ির ছাদে জড়ো হতে শুরু করেন। সকালে কায়দ-ই-আজম জিন্নাহ এবং লর্ড মাউন্টব্যাটেনের শোভাযাত্রা অনেক আগে শেষ হয়ে গিয়েছে। এ কারণে রাস্তায় এখন আর কোনও ভিড় নেই। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পাকিস্তানের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ রয়েছে।
প্রাসাদের সোপানটি বেশ বড়। প্রায় সাত-আট’শ সেবিকা উপস্থিত হয়েছেন। অনেকে বসার জায়গা পাননি। প্রাসাদের ছাদে তিল ধরানোর জায়গা ছিল না। তাই অনেকে নিচে দাঁড়িয়েই কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। দেশভাগ হয়ে গিয়েছে। পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান দুই অংশে ভাগ হয়ে গিয়েছে দেশ। তাই সকলের মন ভারাক্রান্ত। প্রাসাদের ছাদে রাষ্ট্র সেবিকা সমিতির একটি শাখা স্থাপন করা হয়েছে। পতাকা লাগানো আছে। একটি রাষ্ট্রভক্তির গান, উপস্থিত সকল সেবিকাদের মনে আশা জাগিয়ে তোলে এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। লক্ষীবাই কোলকার অর্থ্যাৎ মৌসিজী তাঁর শান্ত দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিশ্রুতি মন্ত্রটি উচ্চারণ করছিলেন। উপস্থিত সকল সেবিকাগণ দীপ্তকন্ঠে তা অনুসরণ করছিলেন। অন্তিম লগ্নে প্রশ্নোত্তরের জন্য কিছু সময় রাখা হয়েছে।
একজন তরুণী স্বয়ংসেবিকা জিজ্ঞাসা করলেন, “পাকিস্তানে আমাদের সম্মান বিপদে রয়েছে। আমাদের কি করা উচিত ..? আমরা কোথায় যাব .. ? “
মৌসিজী তাঁকে আশ্বস্ত কন্ঠে বলে যে, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভারতে চলে আসুন। কীভাবে এখান থেকে হিন্দুস্তানে পৌঁছানো যায়, তা কেবল বিবেচনা করুন। মুম্বই এবং অন্যান্য শহরগুলিতে, সংঘ আপনার জন্য ব্যবস্থা করেছে, চিন্তা করবেন না। আমরা সবাই এক পরিবার। আমরা একসাথে এই কঠিন সময়ের মোকাবিলা করব ।”
মৌসিজী তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেছিলেন… “বোনরা ধৈর্য ধরুন, ধৈর্য ধরুন… আপনার নিজেদের মর্যাদা রাখুন… প্রতিষ্ঠানের উপর আপনারা পুরোপুরি বিশ্বাস করুন। এই কঠিন সময়ে মাতৃভূমীর সেবা করার কাজ জারি রাখুন। সংগঠনের শক্তি দিয়ে আমরা নিরাপদে এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।”
লক্ষ্মীবাই কেলকার অর্থ্যাৎ মৌসিজীর মুখ থেকে দৃঢ়-প্রত্যয়ী কথা শুনে সেবিকাদের মনে আত্মবিশ্বাস জেগে উঠে…!
——
আবারও করাচি …
যদি করাচিতে জিন্নাহ-মাউন্টব্যাটেন মিছিল এবং উদযাপনের উল্লাসবাদ দেওয়া হয়, তবে পাকিস্তানে স্বাধীনতা দিবস নিয়ে তেমন উৎসাহ নেই। চাঁদ-তারা যুক্ত পাকিস্তানের সবুজ পতাকাটি অনেক জায়গায় প্রদর্শিত হচ্ছে তবে কেবল পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে মানুষের মধ্যে তেমন উদ্দীপনা লক্ষ করা যায়নি। তবে একটি বিষয় অবশ্যই নিশ্চিত যে, পাকিস্তানের উত্থানের ফলে ইসলামী দেশগুলির মধ্যে শক্ত নেতৃত্বের একটি দেশ উদয় হয়েছে, প্রত্যেকেই এরকম অনুভব করছেন।
_ _ _ _
কলকাতা, বেলেঘাটা।
গান্ধীজির সন্ধ্যার প্রার্থনার সময় হয়েছে। পরাধীন ভারতবর্ষে এটা তাঁর শেষ প্রার্থনা । এদিন পর্যন্ত, গান্ধীজি সন্ধ্যার প্রার্থনায় অনেকগুলি বিষয় নিয়ে কথা বলে এসেছেন। তাঁর পছন্দের বিষয় হল চরকায় সূতা-কাটা থেকে শুরু করে মানব সভ্যতার উপর পরমানু বোমার বিপদ। দেহকে সুস্থ রাখার জন্য অন্ত্রের গঠন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ব্রহ্মচর্য, ব্রত-উপবাসের উপকারিতা, ভগবদগীতার শিক্ষা, অহিংসা, সত্যাগ্রহ প্রভৃতি বিষয়ে কথা বলতেন।
স্বাধীনতার প্রাক্কালে গান্ধীজি এইদিন কি বলবেন তা নিয়ে প্রত্যেকের মনে একটি কৌতূহল… এবং সে কারণেই এদিন সন্ধ্যার প্রার্থনাটি বেলেঘাটার খোলা পার্কের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে।
সামনে দাঁড়িয়ে প্রায় দশহাজার লোকের ভিড়ের সামনে গান্ধীজি শান্ত কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন, “প্রথমে আমি আপনাদের অভিনন্দন জানাই যে আপনারা কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম বিরোধ দূর করেছেন। এটি খুব ভাল হয়েছে। আমি আশা করি এটি কোনও তাৎক্ষনিক বোঝাপড়া নয়। উভয়ই সর্বদা ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সহাবস্থানে থাকবেন”
“আগামীকাল আমরা ব্রিটিশদের দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে চলেছি। তবে আজকের এই রাত থেকে আমাদের এই দেশটিও বিভক্ত হতে চলেছে। সুতরাং, আগামীকালকের দিনটি একদিকে উপভোগ্য, অন্যদিকে এটি বেদনাদায়কও। স্বাধীনতা অর্জনের পরে, সকল মানুষের দায়িত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। কলকাতা শহরের চেতনা ও ভ্রাতৃত্ববোধের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তাতে সমগ্র দেশ একটি বড় সংকট থেকে মুক্তির রাস্তা খুঁজে পাবে। যদি জাতিগত ও ধর্মীয় বিদ্বেষের আগুন দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তবে আমাদের সদ্যপ্রাপ্ত এই স্বাধীনতা কতদিন টিকে থাকতে পারবে….?
“আপনাদের বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে যে ব্যক্তিগতভাবে আমি আগামীকাল স্বাধীনতা দিবসটি আনন্দের সাথে উদযাপন করব না। আমি আমার অনুসারীদের অনুরোধ করব আগামীকাল চব্বিশ ঘন্টা উপবাস করুন। প্রার্থনা করে সময় কাটান। চরকাতে সূতা কাটুন, এতে দেশ বেঁচে থাকবে”
—–
দিল্লি ….
কংগ্রেস সদর কার্যালয়। সন্ধ্যা ৬টা বাজে। অবিরাম বৃষ্টি হয়েই চলেছে।
কংগ্রেসের রাষ্ট্রীয় সভাপতি প্রেস বিবৃতি প্রকাশের জন্য বের হতে চলেছেন। কংগ্রেস সভপতি আচার্য জে বি কৃপালানী লিখেছেন, “আজ আমাদের জন্য দুঃখের দিন। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বিভক্ত হতে চলেছে। তবে আমরা এটিকে কাটিয়ে নতুন ভারত গড়ব…!”
_ _ _ _
দিল্লি। সন্ধ্যা ৬টা
নেহেরু বাদে তাঁর মন্ত্রিসভায় বেশিরভাগ মন্ত্রীরা, ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের বাংলোয় এসে উপস্থিত হয়েছেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলদেব সিং পাঞ্জাব সফরে আছেন, তাই তিনি এখনও পৌঁছেননি। তবে শীঘ্রই পৌঁছে যাবেন।
স্বাধীন ভারতের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য, এই বাংলোর প্রাঙ্গনে যজ্ঞ অব্যাহত রয়েছে। বেদ বিদ্যায় পারদর্শী আচার্য দ্বারা শুদ্ধ ও স্পষ্ট সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে পূজা পাঠ চলছে। বাইরে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। পুরো পরিবেশটি একটি পবিত্র ও স্নিগ্ধ আবেশ পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে।
এই যজ্ঞ শেষ হওয়ার পরে স্বল্পাহার করে সকল মন্ত্রীকে শপথ অনুষ্ঠানের জন্য স্টেট কাউন্সিল ভবনে যেতে হবে।
_ _ _ _
দিল্লি …. রাত ১০টা বেজে গেছে …
তখনও বৃষ্টি হয়েই চলেছে। গণপরিষদের সকল সদস্য, মন্ত্রী, উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ধীরে ধীরে রাজ্য কাউন্সিল ভবনে জমায়েত হচ্ছেন। বৃষ্টি উপেক্ষা করে বৃত্তাকার মিলনায়তনের বাইরের কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়েছেন।
সরদার বল্লভভাই প্যাটেল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ডঃ আম্বেদকর, বলদেব সিং, জওহরলাল নেহেরু, রাজকুমারী অমৃত কৌর….. সমস্ত মন্ত্রী একের পর এক আসছেন এবং সেখানে উপস্থিত জনগণের উত্সাহ শিখরে পৌঁছতে শুরু করেছে। প্রতিটি মন্ত্রীর আগমনের সাথে সাথে তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন আম-জনতা। ‘বন্দে মাতরম’ সঙ্গীত ও ‘মহাত্মা গান্ধির জয়’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠছে স্টেট কাউন্সিল ভবন চত্ত্বর।
সভাগৃহে সর্বোচ্চ আসন আর্থাত রাষ্ট্রপতির আসনে ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ বসে আছেন। তাঁর বাম দিকে খানিকটা নিচে লর্ড মাউন্টব্যাটেন পূর্ণ সামরিক পোশাকে উপস্থিত আছেন। নেহেরুর পরনে সাদা পাজামা ও বন্ধ গলার কোট এবং কোটের পটেকে গোলাপ গোঁজা ছিল ….
ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ সভা শুরু করলেন। তিনি সমস্ত বীর শহিদদের স্মরণ করলেন। যারা এই দেশের স্বাধীনতার মৃত্যু বরণ করেছিলেন তাদের তিনি স্মরণ করেছিলেন। বক্তৃতার শেষে তিনি মহাত্মা গান্ধীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে “আমাদের গুরু এবং অন্ধকারে পথ দেখিয়েছেন যে মানুষটি সেই গান্ধীজী আজ আমাদের থেকে হাজার মাইল দূরে রয়েছন, তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে নিরন্তর নিযুক্ত আছেন … “।
এর পরে নেহেরু কথা বলতে দাঁড়িয়েছিলেন। মধ্যরাতে তাঁর মত তার সুতির কোর্টের পকেটে থাকা গোলাপ ফুলটিও খুব সতেজ ও প্রাণবন্ত ছিল।
শান্ত ও গম্ভীর কণ্ঠে নেহেরু কথা বলতে শুরু করেছিলেন … “বহু বছর আগে আমাদের নিয়তির একটি চুক্তি হয়েছিল। আজ, আমরা এটি সম্পূর্ণ করতে যাচ্ছি, পুরোপুরি পূ্র্ণ না হলেও, তা অনেকাংশে সফল হয়েছে। এখন ঠিক মধ্যরাত্রি ১২টা। সমগ্র বিশ্ব শান্তিতে ঘুমাচ্ছে, ভারত স্বাধীনতার এক নতুন যুগে পা রাখল … একটি নতুন জন্মে প্রবেশ করল…।” নেহেরুর ভাষণ বক্তৃতায় বেশ গুরুগম্ভীর শব্দ ব্যাবহার করেছিলেন। এমন একটি ভাষণ প্রস্তুত করতে তিনি অনেক রাত জেগে কাটিয়েছেন …!
রাত ঠিক বারোটা বাজে, সেই হলটিতে বসে গান্ধী টুপি পরা একজন সদস্য সঙ্গে নিয়ে আসা শঙ্খটি বাজিয়ে দিলেন। সেখানে উপস্থিত প্রত্যেক ব্যক্তি শঙ্খধ্বনিতে শিহরিত হয়ে উঠলেন। একটি নতুন ইতিহাস তৈরি করা হচ্ছিল … একটি নতুন যুগ শুরু হতে চলেছিল। স্বর্গে উপস্থিত বীর বিপ্লবীদের আত্মা এই দৃশ্য দেখে তৃপ্ত পয়েছল এই ভেবে যে তাদের বলিদান বিফলে যায়নি …।
ভারত এখন স্বাধীন দেশ।
——–
দিল্লি। মধ্যরাত …
মুসলধারে বৃষ্টি অব্যাহত। পুরান দিল্লির দরিয়াগঞ্জ, মিন্টো ব্রিজের মতো জায়গায় জল জমে গিয়েছে। এইরকম তীব্র বৃষ্টিপাতের ফলে ই-৪২ কমলা নগর-এ অবস্থিত সংঘের ছোট কার্যালয়ে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য প্রচারক এবং স্বয়ংসেবক জড়ো হন। দেশভাগের ফলে পাকিস্তানে হিন্দুদের উপর অত্যাচার শুরু হয়েছে। হাজার হাজার হিন্দু পরিবার ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতবর্ষে আশ্রয় নিচ্ছেন। পাকিস্তানের পাঞ্জাব এবং সিন্ধু প্রদেশ থেকে দলে দলে হিন্দুরা দিল্লিতে আসছেন। তাদের বাসস্থান এবং খাবারের ব্যবস্থা করার দাযিত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। স্বয়ংসেবকরা নিজেদের খাওয়া দাওয়া ভুলে পীড়িত শরণার্থীদের সেবায় নিয়েজিত হয়েছেন। স্বাধীনতা দিবসের দিন, মুসলমানদের কয়েকটি দল ঝামেলা পাকাতে পারে, স্বয়ংসেবকদের কাছে এরকম খবর রয়েছে। তাই সেদিকেও তাদের নজর রাখতে হয়েছিল।
অনেক স্বেচ্ছাসেবক গত বেশ কয়েকটি রাত ধরে ঘুমোয়নি … পরের কয়েক রাত্রিও তাদের সামনে এই জাতীয় অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করে রয়েছে।
_ _ _ _
কলকাতা। গভর্নর হাউস, রাত্রি ১টা …
দিল্লিতে ক্ষমতা হস্তান্তর কর্মসূচি শেষ হয়েছে এবং এখানে ব্রিটিশদের এই পুরাতন রাজধানী কলকাতা-তে একটি নতুন অধ্যায় লেখা হচ্ছে।
রাজ ভবনে, রাজ্যপাল চক্রবর্তী রাজগোপালচারী-র শপথ গ্রহণ কার্যক্রম শুরু হতে চলেছে। খুব ছোট প্রোগ্রাম। বর্তমান গভর্নর স্যার ফ্রেডরিখ বুরোজ তাঁর দায়-দায়িত্ব রাজগোপালচারী-কে হস্তান্তর করবেন। মাত্র দশ-পনেরো মিনিটের এই কর্মসূচিতে রাজাজী ইংরেজিতে শপথ নিলেন, তবে নবনিযুক্ত মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ প্রফুলচন্দ্র ঘোষ এবং অন্যান্য সমস্ত মন্ত্রীরা বাংলাতে শপথ নিলেন।
এই প্রোগ্রামটি দেখতে প্রচুর ভিড় জমেছে। আজ যাই হোক স্বাধীনতার রাত। এই কারণে, রাজভবন সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। মধ্যরাত রাজভবনে অসংখ্যা মানুষ ভিড় জমিয়েছেন। জনতা প্রচন্ড উত্সাহ নিয়ে স্লোগান দিচ্ছে, ‘জয় হিন্দ’, ‘বন্দে মাতরম’ ‘গান্ধীজী জিন্দাবাদ’ … যে গভর্নর হাউসে ভারতীয় বিপ্লবীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করা হত। বিপ্লবীদের আর্তনাদে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠত সেই রাজভবনে দাঁড়িয়ে জনসাধারণ ‘বন্দে মাতরম’ শ্লোগান দিয়ে আনন্দ উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করছেন। রাজভবন প্রাঙ্গন বন্দেমাতরম ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে।
উচ্ছ্বাস এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে রাজভবনের মধ্যে রাখা মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে মানুষজন রাজপথে নেমে আসে!
স্বাধীন ভারতে প্রথম সূর্যোদয় তখনও ঘটেনি। স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা দিবসের উদযাপন এভাবেই করেছিল ভারতবাসী!