গণ্ডাচারেক গুণ্ডা যিনি পুষতে পারেন, কন্ট্রোলে রাখতে পারেন, তিনিই হলেন সবচেয়ে পাওয়ারফুল রাজনেতা। তাই রাজনৈতিক সভাসমিতিতে বলতে বাধে না যে, গুণ্ডারা এখন তাঁদের কন্ট্রোলে। কখনও কখনও সেটা তাঁরা বেশ ফলাও করেই বলেন। বুঝিয়ে দেন, তাঁরাই গুণ্ডাদের বস। তাঁদের একটা ইশারাতেই যে-কোন সময় যে-কেউই ছোবল খেয়ে ছবি হয়ে যেতে পারে! এই বস-অবশের খেলায় কখনও কখনও গুণ্ডাদের বস থেকে বশ্য হয়ে ওঠেন রাজনেতারা।
‘গুণ্ডা’ কারা? যারা খুনি থেকে ভদ্রলোক, প্রয়োজনে সব কিছুই হতে পারে, শুধু ‘নেতা’ হতে পারে না; যারা গুপ্তি থেকে গুলি কিছু একটা চালিয়ে নেতাকে ইলেকশনে জেতানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, নেতার সমস্ত সমস্যা হুমকি থেকে হাতিয়ার কিছু একটা বাগিয়ে উতরে দেয়, তারাই ‘গুণ্ডা’।
আপনারা অল্পবিস্তর সবাই জানেন যে, আজকাল যেমন নির্ভেজাল নেতা নেই, যেমনি খাঁটি গুণ্ডাও চোখে পড়ে না। হিন্দি সাহিত্যের সুলেখক জয়শঙ্কর প্রসাদ যাদের নিয়ে তাঁর বিখ্যাত ‘গুণ্ডা’ গল্পটি লিখেছেন, সেই নীতিবাগীশ গুণ্ডার প্রজাতিটাই এখন হেজে গেছে। নেতাগিরি এখন যে-লেভেলে টেকনিক্যাল হয়ে উঠেছে, তাতে করে শুধুমাত্র ছুরি-চাকু-হুমকি-থ্রেটে আর গুণ্ডাগিরি হয় না। আজকাল গুণ্ডা-বদমাশ হতে হলে বিলক্ষণ খরচা আছে! পিস্তল-বন্দুক-গুলি-বোমার চাই নিয়মিত এবং পর্যাপ্ত সাপ্লাই। চাই দমদার বাইক বা গাড়ি আর ট্যাঙ্কভর্তি পেট্রোল। এ-সবের জন্য প্রচুর টাকা চাই। কালো টাকা। সেটা সাপ্লাই দেবার মতো যোগ্য লোক নেতা ছাড়া আর আছেটাই বা কে!
সবচেয়ে জরুরি জিনিস যেটা হল, সেটা হচ্ছে অ্যাকশন করে ফ্যাসাদে পড়লেই গুণ্ডাদের আন্ডারগ্রাউন্ড হবার জন্য চাই নিশ্চিত ও নিরাপদ একটা আশ্রয়; যেখানে হুইস্কি গেলা যাবে, মুরগির ঠ্যাং চিবিয়ে আয়েশে আঙুল চাটা যাবে। সেদিক থেকে নেতার বাংলো-ফার্মহাউস-গেস্টহাউসের চেয়ে নিরাপদ আশ্রয় আছে আর কোথায়!
একটা সময় ছিল, যখন জমিদারেরা লেঠেল পুষতেন আর তাঁর সব হুকুম লেঠেলরা বিনাবাক্যে তামিল করত। তার বদলে সামান্য কুত্তার খাবার ছুঁড়ে দিলেই তাদের খুশির আর কিনারা থাকত না! কিন্তু হায়, সেই দিন আজ কোথায়! এখন তো গুণ্ডারা সন্ত্রাসবাদীর খাতির আদায় করে ছেড়েছে! ধর্মক্ষেত্র থেকে তাদের উৎপাদন করা হয়, বিদেশে প্রশিক্ষণ হয়, মহাদেশ তাদের খরচ চালায়। তারা স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে নয়, কেন্দ্রীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ওদের নিকেশ করতে সেনা নামাতে হয়!
এরকম একটা জাতীয় পরিস্থিতিতে কোন লোকাল নেতা যখন আভাস দেন যে, গুণ্ডারা তাঁর বশে, মানে কন্ট্রোলে; তার মানে এটাই দাঁড়ায়, গুণ্ডাদের তিনিই পোষক, তিনিই জোগাড়ে, তিনিই দালাল, তিনিই তাদের চাকর এবং আসলে গুণ্ডারাই তাঁর বস। তাই গুণ্ডা-মালিকের সঙ্গে ঝামেলা হলে চাকরের সঙ্গে অর্থাৎ নেতার সঙ্গে কথা বলতে হয়!
ভারতীয় রাজনীতিতে এইসব গুণ্ডাদের বস-নেতা আর গুণ্ডার বশ্য-নেতাদেরই ভিড়, গণতন্ত্রের ঘেঁটি মুচড়ে মওকা বুঝে তারাই দলবদল করে কোনও না কোনও দলের মুখ হয়ে ঘুরেফিরে আসে। আজ ভোট দেবার জন্য আমাদের কম-চোর, কম-গুণ্ডা ব্যালটে খুঁজে মরতে হয়, সৎনেতার অপশন খুঁজেই পাওয়া যায় না! শেষ পর্যন্ত দেখি, ভোট ভণ্ডুল করে জড়ভরত নির্বাচন কমিশন আর বেকুব জনতার মাথায় চাঁটি মেরে সবচেয়ে বাজে লোকটা যখন মন্ত্রীত্বের শপথ নেয়, তখন আগামী পাঁচ বছর চায়ের দোকানে তাকে খিস্তি করা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় থাকে না। এটা কি ভারতীয় জনগণ আর গণতন্ত্রের চরম ব্যর্থতা নয়?