নেহাতই সমাপতন। শ্রাবণী পূর্ণিমায় শ্রীকৃষ্ণের ঝুলন যাত্রা যা হিন্দোলের সমাপ্তি। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছে এটি কৃষ্ণভজনার এক মহাপুণ্যদিন। পূজা-আরতি, ভোগ নিবেদন, কীর্তন ও ভজন গানের মধ্য দিয়ে পালন করেন তারা দিনটি। বঙ্গদেশে অবশ্য ঝুলনের শুরু থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত সাতটি দিন। বিশেষ করে ছেলে-মেয়েরা নানারকম পুতুল দিয়ে, পাহাড় বানিয়ে তা নানা ভাবে সাজিয়ে নিজেদের সৃজনকর্মের পরিচয় দেয়। বাচ্চাদের এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হন বড়োরাও। ঝুলনের শেষ বা পূর্ণিমায় পুরোহিত ছাড়া নিজেরাই লুচি পায়েস ইত্যাদি রাধা-কৃষ্ণের প্রতি নিবেদন করে বাচ্চাদের মধ্যে তা বিলিয়ে দেন। এই ভাবে সকলকে খাইয়ে এক ধরনের মানসিক তৃপ্তি পান সকলে। এখন অবশ্য কিছু কিছু জায়গায় ছোটোরা নয়, পেশাদার শিল্পীদের দিয়েই ঝুলন সাজানো বা মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে।
এই শ্রাবণী বা ঝুলন পূর্ণিমারই একটি অনুষ্ঠান রাখি বা রক্ষাবন্ধন। কেউ কেউ এই কারণে দিনটিকে রাখি পূর্ণিমা হিসেবেও অভিহিত করেন। কিন্তু মনে রাখা দরকার, রাখি বা রক্ষাবন্ধনের সঙ্গে ঝুলনযাত্রার কোনো সম্পর্কই নেই। তার চেয়েও বড়ো কথা, রাখি বা রক্ষাবন্ধন সম্পূর্ণ ভাবেই একটি লৌকিক উৎসব। এরসঙ্গে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানই যুক্ত নয়। অবশ্য পশ্চিম বা উত্তর ভারতে অনেকে এই দিনে পিতৃপুরুষকে স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানাতে বিশেষ তর্পণ বা শ্রাদ্ধ করেন। সেক্ষেত্রে পুরোহিতের প্রয়োজন হলেও অনুষ্ঠান হিসেবে রক্ষাবন্ধনের সঙ্গে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের কোনো যোগই নেই। এই উৎসবের উৎস জনজীবন। সেখান থেকেই স্বতোৎসারিত এই রাখি বা রক্ষাবন্ধন উৎসব।
রক্ষাবন্ধনের মূল আয়োজক মহিলারা। ভাই, স্বামী বা অন্য পরিজনদের সুরক্ষা, তাদের মঙ্গলকামনায় নারী এদিন হাতে বেঁধে দেন মঙ্গলসূত্র। সেই সুতোর সঙ্গে থাকে অন্তরের যোগ। উত্তর ও পশ্চিম ভারতের সামাজিক ক্ষেত্রে এই উৎসব বহুকাল ধরেই একটা বড়ো জায়গা জুড়ে রয়েছে। নারী তার স্নেহ ভালোবাসা, অন্তরের সবটুকু সদিচ্ছা দিয়ে শুভকামনা জানায় ভাই, স্বামী বা অন্যান্যদের। বাঙ্গালির ভাইফেঁটার মতোই রক্ষাবন্ধনও সামাজিক সম্প্রীতি, পারিবারিক অন্তর বন্ধনের এক অপূর্ব প্রীতিময় অনুষ্ঠান। একদিক থেকে এটি এক অনন্য অনুষ্ঠান। পৃথিবীর আর কোথাও এমন কোনো একটি অনুষ্ঠানের খোঁজ পাওয়া যাবে না।
মেয়েরা ভাই-স্বামী বা অন্যান্যদের আরতি করে হাতে মঙ্গলসূত্র বেঁধে দেয়। প্রতিদানে ছেলেরা তুলে নেয় নিজেদের সাধ্যমতো বিভিন্ন উপহার।
দেশ বিদেশের নৃ-বিজ্ঞানীরা ভারতের রক্ষাবন্ধন অনুষ্ঠানের নানা দিক পর্যালোচনা করে মনে করেন, এটি সম্পূর্ণভাবে একটি লৌকিক উৎসব।
লৌকিক উৎসব হলেও, কোনো কোনো পৌরাণিক কাহিনির মধ্যে এই উৎসবের বীজ খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন একটি পৌরাণিক কাহিনিতে আছে, একবার দেবাসুরের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। টানা বারো বছর ধরে চলে। সে যুদ্ধ। শেষপর্যন্ত কিন্তু সে যুদ্ধে জয়ী হয়। অসুররাই। দেবরাজ ইন্দ্রের নেতৃত্বে দেবতারা সে যুদ্ধে সম্পূর্ণ ভাবেই পর্যদস্ত হয়।
পরাজিত দেবতারা যান তাদের গুরু বৃহস্পতির কাছে। জানতে চান, কেন এমন হলো? কেন তারা আজ পরাজিত? স্বর্গরাজ্য উদ্ধারের কি আর কোনো পথই নেই।
সব শুনে বৃহস্পতি বলেন, দেবরাজ ইন্দ্র হীনবল হয়ে পড়ার কারণেই এই পরাজয়।
তাহলে উপায়?
আকুল কণ্ঠেই জানতে চান দেবরাজ। তাহলে এমন করেই পরাজিতের জীবনযাপন করতে হবে।
বৃহস্পতি বলেন, উপায় একটা আছে।
কী? কেমন করে উদ্ধার পাওয়া যাবে এঅবস্থা থেকে?
বৃহস্পতি ‘যেন বন্ধো বলিরাজা দানবেন্দ্র মহাবলঃ।
তেন ত্বাং অনুবদ্ধামি রক্ষে মা চল মা চল॥’
এই মন্ত্র উচ্চারণ করেন। বলেন, এই মন্ত্রে সঞ্জীবিত করতে হবে একটি মঙ্গলসূত্রকে। তারপর সেটি ইন্দ্রের ডান হাতে বেঁধে দেবেন ইন্দ্রাণী। তাহলেই বল ফিরে পাবেন ইন্দ্র। পরাজিত হবে অসুররাও।
দেবগুরু বৃহস্পতির নির্দেশ মতো একটি মন্ত্রে সঞ্জীবিত মঙ্গলসূত্রটি ইন্দ্রের হাতে বেঁধে। দেন তাঁর স্ত্রী শচী। সেই মঙ্গলসূত্রের গুণেই ইন্দ্র ফিরে পেলেন তার শৌর্য-বীর্য। প্রবল বিক্রমে আক্রমণ করে উদ্ধার করেন তিনি অমরাবতী।
দেবগুরু বৃহস্পতির এই মন্ত্র উচ্চারণের দিনটি ছিল শ্রাবণী পূর্ণিমা। তারপর থেকেই দিনটি হয়ে ওঠে এমন তাৎপর্যপূর্ণ। রক্ষাবন্ধন অনুষ্ঠানের প্রবর্তন হয় তারপর থেকে—এই শ্রাবণী পূর্ণিমায়, এমনই বিশ্বাস একদল পণ্ডিতের।
ভাইফেঁটার মতোই রক্ষাবন্ধন সম্পর্কিত এক পৌরাণিক কাহিনিতে রয়েছে যম ও যমুনার কথা। বলা হয়েছে, প্রতি শ্রাবণী পূর্ণিমায় যমুনা ভাই যমকে রাখি পরান তার দীর্ঘ, সুস্থ ও নিরাপদ জীবন কামনা করে। আর এ থেকেই নাকি শ্রাবণী পূর্ণিমায় ভাইদের মঙ্গল কামনায় রাখি পরানোর রীতির সূত্রপাত।
ভবিষ্য পুরাণের উত্তর পর্বে আছে, একবার জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে ডেকে শ্রীকৃষ্ণ বলেন, শ্রাবণী পূর্ণিমায় রাজপুরোহিতকে দিয়ে মন্ত্রপুত রক্ষাবন্ধনী অবশ্যই বাঁধবে। এতে তোমরা নিরাপদ থাকবে। রক্ষাবন্ধনীর এই মহিমার কারণেই নারীরা অন্যদের রাখি পরিয়ে থাকেন। প্রাথমিক পর্বে যা ছিল শুধুই মাত্র শোধিত সূত্র, কালক্রমে তা পরিণত হয়েছে প্রায় অলংকারে।
মহাভারতের একটি কাহিনিতে বলা হয়েছে, একবার শিশুপালের সঙ্গে যুদ্ধের সময় শ্রীকৃষ্ণের আঙুল বিক্ষত হয়। রক্ত ঝরতে থাকে ক্রমাগত। তা দেখে অস্থির দ্রৌপদী তাড়াতাড়ি পরনের শাড়ি ছিড়ে সেই টুকরো দিয়ে ক্ষতস্থান বেঁধে দেন। আর তাতেই বন্ধ হয় রক্ত পড়া। সে দিনটাও নাকি ছিল শ্রাবণী পূর্ণিমা।
তুষ্ট শ্রীকৃষ্ণ বলেন, এখন থেকে এই দিনে কারো হাতে সুতো বেঁধে দিলে তার জীবন থাকবে সুরক্ষিত। আর এরই সূত্র ধরে নাকি প্রবর্তন রক্ষাবন্ধন উৎসবের।
রাখি শুধু ভাই, স্বামী বা অন্যান্য পরিজন বা বন্ধুবান্ধবদের পরানো হয় না, পরানো হয়। যে কোনো মানুষকে। সেখানে বর্ণ, শ্রেণী বা ধর্মের কোনো ভেদাভেদ নেই। এমনকী মুসলমান ভাইকে রাখি পরাচ্ছে হিন্দু বোন, এমন ঘটনার বহু ঐতিহাসিকনজিরও রয়েছে। এই প্রসঙ্গেই বলতে হয় চিতোরের রানি কর্ণাবতী এবংমুঘল বাদশাহ হুমায়ুনের কথা। চিতোরের বিধবা রানি কর্ণাবতী হুমায়ুনকে রাখি পাঠিয়ে তার সঙ্গে ‘রাখি-ভাই’ সম্পর্ক গড়েন। বোনের মর্যাদা রাখতে বাদশাহ হুমায়ুন পরবর্তীকালে তার পাশে থেকেছেন। বলেই ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন।
মুঘল বা তার পরর্তীকালেও হিন্দু-মুসলমান উভয়েই পরস্পরকে রাখি পরিয়ে সম্প্রীতির এক অপরূপ নিদর্শন রাখতেন। এ সম্পর্কে বিখ্যাত কবি নজির আকবরবাদী (১৭৩৫-১৮৩০) রাখি নিয়ে একটি কবিতা লেখেন। তার শেষ স্তবকে তিনি লিখেছেন, ‘আমি হিন্দু ব্রাহ্মণের মতোই ধুতি-চাদর পরে কপালে তিলক কাটতে চাই। তাহলে আমার চার পাশের ভালো। মানুষগুলিকে আমি রাখি পরাবার সুযোগ। পাব।
রাখিবা রক্ষাবন্ধনের এমন অসম্প্রদায়িক অথচ সর্বজন কল্যাণ কামী রূপ দেখেই এক বিশিষ্ট বিদেশি নৃ-বিজ্ঞানী বলেছেন, রাখি বা রক্ষাবন্ধন হলো ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লোক উৎসব।
নন্দলাল ভট্টাচার্য
(শ্রাবণী পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে প্রকাশিত)
2019-08-10