যত খুঁড়ছি কেউটে বেরোচ্ছে । রাত ভোর হচ্ছে । লেখার নেশা জমাট বাঁধছে ।
গত কিছুদিন ধরে শিকড়ের টানে দৌড়চ্ছি । রাজ্যে যে চুরি হয়, বলা বাহুল্য ডাকাতি হয়, তার মূলে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি । কিভাবে আসছে টাকা, কিভাবে সরকারি কোষাগার থেকে বেরিয়ে যায় টাকা, তাঁর অনুসন্ধান করতে গিয়ে মনে হচ্ছে এত স্টাইলে চুরি করা যায় !!
কিভাবে শুনুন ।
সুপ্রিম কোর্টের দাবড়ানিতে রাজ্য সব রেশন কার্ডে লিংকিং করতে শেষ পর্যন্ত রাজী হয় । রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার কার্ডের লিঙ্কিং না করতে চাওয়ার পেছনে ছিল গভীর অর্থনৈতিক অঙ্ক । ভুয়ো রেশন কার্ডের টাকায় চলত রাজ্যের RKSY I এবং RKSY II এর ভরণ পোষণ । কেন্দ্রের “ভুয়ো ভর্তুকি”র টাকায় রাজ্যের রেশন ব্যবস্থা চালানো এবং সবটাকেই নিজেদের খাদ্যসাথী তকমা দেওয়া । মানুষ বুঝতো সবটাই দিদি দিচ্ছে । আদতে মাথা পিছু কেন্দ্রের ভর্তুকি ছিল ১৩৫ টাকা, রাজ্যের ছিল ৫ টাকা কেন্দ্রের তিন ধরনের রেশন কার্ডে যার সংখ্যা এ রাজ্যের পেশ করা তথ্য অনুযায়ী ৬ কোটি ২ লক্ষ । যা আদতে চার কোটির আশে পাশে । বাকি প্রায় ভুয়ো ২ কোটির জন্য পাওয়া কেন্দ্রের মাসিক ভর্তুকি দিয়ে চলত রাজ্যের নাম করে দেওয়া রেশন ব্যবস্থা । যার সংখ্যা কাগজে কলমে আড়াই কোটি । মাছের তেলে মাছ ভেজে খাদ্য সাথীর নাম দিয়ে চলছিল রাজ্যের সামগ্রিক রেশন ব্যবস্থা ।
এসব নিয়ে লিখেছিলাম আগে । এই চৌর্যবৃত্তির বাইরেও আছে বৃহত্তর চৌর্যবৃত্তি । যার সন্ধান পাচ্ছি, যত খুঁড়ছি তত । এই অনুসন্ধান করতে গিয়ে ভাবছি এর শেষ কোথায় ? হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো তো একসময় শেষ হয়েছিল । এর শেষ কোথায় ? কবে একটু বিশ্রাম পাব ?
একটা ছোট পর্বের চুরির কথা এই পর্বে লিখি ? বাকিগুলো দফায় দফায় না হয় পেশ করব । ডিজিটাল রেশন কার্ডের যে লিঙ্কিং প্রসেস চলছে সেটা করানো হচ্ছে সরকারের ওয়েবেলের নিযুক্ত ঠিকা কর্মীদের দিয়ে । আপনি লাইনে দাঁড়িয়ে আধার লিঙ্কিং করে যদি তার রশিদ চান পাবেন না । কেন ? তাহলে জানবেন কি করে যে আপনার লিঙ্কিং হল কি না ? জানার কোন উপায় রাখা হয়নি । পরিকল্পিত ভাবে । এতে সরকারের লাভ কি ? পুরো বিষয়টাকে অস্বচ্ছ রাখা । যাতে আধার লিঙ্কিং এর সময়টা বিলম্বিত করা যায় । এবং ততদিন পর্যন্ত ভুয়ো রেশনের ভর্তুকি ঢুকবে রাজ্যের ঘরে ।
এমনিতেই লিঙ্কিং এর বহুবিধ সমস্যা আছে । যেমন ধরুন আপনার আধার কার্ডে টাইটেল আছে ” ব্যানার্জি ” আর আপনার রেশন কার্ডে টাইটেল আছে ” বন্দ্যোপাধ্যায় ” । লিঙ্কিং আটকে যাবে । আপনি জানলেনও না আপনার লিঙ্কিং হল না । আর এই বিষয়টি যত বিলম্বিত হবে সরকারের লাভ । ভুয়ো ভর্তুকির বাজার দীর্ঘস্থায়ী হবে । ভূতে খাবে চাল, গম সব কিছু । আন ডিস্ট্রিবিউটেড কার্ডের নাম করে ভর্তুকি ঢুকতেই থাকবে ডিস্ট্রিবিউটরদের ঘরে । ” খাদ্য সাথী”র ঢোল বাজবে বাজারে ।
অঙ্কে যা প্রতি মাসে কয়েকশো কোটি । ডিস্ট্রিবিউটর, ডিলার, ফুড ইন্সপেক্টর, এফ সি আই বসেরা, ফোঁড়েরা সবাই ঘরে তুলবেন নিজেদের প্রাপ্য । আর তার ভাগ শেষ পর্যন্ত পাওয়ার ফুল ভাইপোর হাত ঘুরে গোয়া কিম্বা আগরতলা বেড়াতে যাবে । আপনি জানতে পারবেন ? পারবেনই না । নিশ্চিত ।
এভাবেই চলছে রাজ্যের খাদ্য দফতর । দস্যু রত্নাকর এর মাঝেই নিজের ভাগটা বেশি বুঝে নিতে গিয়ে খাদ্য হারা হয়ে দফতর হারিয়ে “বনে” চলে গিয়েছেন । ভাগটা তাই সর্বোচ্চ পর্যায়ে এখন বেশিই পৌঁছচ্ছে ।
এটা আমার কথা নয়, দীর্ঘদিন দফতর সামলানো এক সচিবের ।
তাঁর কথায় রাজ্যের যে তিন দফতরে বেশি চুরি হয় তাতে এখনও খাদ্য দফতর নিজের সর্বোচ্চ স্থান ধরে রেখেছে, খুব কাছে আছে পূর্ত, পুর ও পঞ্চায়েত দফতর, আগে শিক্ষা দফতর ছিল “,ক্লোজ থার্ড” । এখন recruitment বন্ধ বলে বাজার মন্দা যাচ্ছে, পিছিয়ে পড়ছে । দৌড়চ্ছে খাদ্য দফতর এখনও । আধার লিঙ্কিং ক্লোজ হলে চুরিতে দ্বিতীয় স্থানে নামতে বাধ্য হবে খাদ্য দফতর । এগিয়ে যাবে পঞ্চায়েত, সিঙ্গুরের বেচা ঢুকেছে সদ্য । মিলিয়ে নেবেন ।
সদ্য অবসর নেওয়া প্রাক্তন এই আমলা শেষ করলেন এই বলে – চিটফান্ডের থেকে বেশী রসদ দিয়েছে এই দফতর । এই দফতর হারা হলে মানুষ সুইসাইড করে কিম্বা “বনে” চলে যায় । আর এই দফতরের রসদ ঠিক ঠাক এলে মানুষ গোয়ার সমুদ্র সৈকতেও বেড়াতে যায় । ত্রিপুরেশ্বরি কালি মন্দিরে পুজোও দিতে যায় ।
ভুল বলেননি এই আমলা । কি বলেন ?
সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় (৯৮৩৪২৬০৭৮)