তানসেন: ছয় দশক আগে তৈরি বিস্মৃত বাংলা ছবি

Memory

তানসেন: ছয় দশক আগে তৈরি বিস্মৃত বাংলা ছবি

তৎকালীন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ গায়ক সাধক হরিদাস স্বামী। তিনি কোনও রাজদরবারের গায়ক নন, তাঁর সংগীত তাঁর পরমেশ্বর বাঁকেবিহারীর আরাধনায় অর্পিত। ইষ্টদেবতা বাঁকেবিহারীর নির্দিষ্ট পথে তিনি খুঁজে পান তন্না-কে। কে এই তন্না(রামতনু পান্ডে)? মকরন্দ নামের এক ব্যক্তির একমাত্র সন্তান সে। মকরন্দ-র কাছেই হরিদাস স্বামী ভিক্ষে ক’রে নিলেন তন্না-কে। তন্না-র মধ্যে অশ্রুতপূর্ব কণ্ঠ-প্রতিভা। সেই প্রতিভাকে বিশ্বের দরবারে তুলে আনতে হবে। অল্প সময়ের মধ্যেই তন্না আয়ত্তে আনে হরিদাস স্বামীর সমস্ত গুণ। কিন্তু প্রভুর মুখের প্রশংসা না শুনে ব্যথিত তাঁর হৃদয়। হরিদাস স্বামী বোঝেন সে কথা কিন্তু প্রশংসা ক’রে মধ্যপথেই রুদ্ধ করে দিতে চান না তন্নার বিরাট সংগীত প্রতিভাকে। তবে সময় হ’লে তিনি তন্নাকে পাঠিয়ে দেন গোয়ালিয়রে। সেখানে রানী মৃগনয়নীর সভায় শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞদের আশ্রয়, সমাবেশ। সেই সভায় সহজেই রানীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলো তন্না। রানী নিজেও সঙ্গীতজ্ঞা, সুর রচয়িতা। সংগীতের মাধ্যমেই রানীর হৃদয় স্থান হয় তন্নার। মৃগনয়নী নিজে কাঠ-কুড়ানি, গুজারি সম্প্রদায়ের মেয়ে-সংগীত গুণেই হয়েছিলেন গোয়ালিরের রানী। এই দুই প্রতিভার মিশ্রনে তৈরী হ’তে থাকে নতুন গান, নতুন রাগ। দেশ বিদেশে ছড়িয়ে যায় তন্নার নাম। তন্না আকৃষ্ট হয় রানীর প্রতি। কিন্তু তন্নার প্রেম যে হিন্দু বিধবা রানীর পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়না! রানীর প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তন্না আত্মহত্যা করতেও চেষ্টা করলেন। তাঁকে বাঁচালেন রানীর সহচরী প্রেমকুমার। তন্না ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ক’রে আশ্রয় নেন প্রেমকুমারীর হৃদয়ে। বিয়ে করেন প্রেমকুমারীকে, তাঁদের এক সন্তানও হয়, নাম রাখা হয় সরস্বতী। তখন বীজপুর থেকে সভাগায়ক হওয়ার জন্য ডাক পেলেন। দিল্লির সম্রাট আকবর তন্নাকে তাঁর সভাগায়ক নিযুক্ত করলেন, নতুন নাম দিলেন ‘তানসেন’। পর-দুঃখ কাতর হয়ে তানসেন তাঁর কণ্ঠের টোরি রাগিনী বাঁধা দিয়ে দেন। পরের ডাক মেটাবার দায়ে সম্রাটের দেওয়া অমূল্য নৌলখা হার বিক্রি ক’রে বসলেন। সম্রাট জানতে পেরে ক্রুদ্ধ হয়ে নির্বাসনে পাঠালেন তানসেনকে। কিন্তু সংগীতের তৃষ্ণায় নিজেই আবার থাকতে না পেরে তাঁকে ফিরিয়ে আনলেন। এদিকে অনেকেরই সহ্য হয়না সম্রাট-তানসেনের এই সখ্যতা। ষড়যন্ত্র করেন তাঁরা। তাঁরা সম্রাটকে দিয়েই তানসেনকে আজ্ঞা করেন শুদ্ধ বিস্তারে দীপক রাগ গাইতে-এতে যে গায়ক দগ্ধ হবে সেটা সম্রাট জানেন না। কিন্তু বিদগ্ধ সঙ্গীততান্ত্রিক তানসেন জানেন তবুও প্রস্তুত হন। এতে পুলক জাগে ষড়যন্ত্রীদের মধ্যে, কিন্তু সব জানতে পেরে আতঙ্কিত হন মৃগনয়নী, হরিদাস স্বামী সহ প্রায় সব শুভাকাঙ্খী! কী হবে শেষ পর্যন্ত?

নিশ্চই বুঝে গেছেন এই কাহিনি সুরে সুরেই আগুন-বৃষ্টির খেলা খেলতেন, দীপক রাগে যদিবা বহ্নিশিখা ছড়িয়েও পড়তো, মেঘমল্লার গেয়ে বৃষ্টি আনতেও ভুলতেন না সম্রাট আকবরের সভার নবরত্নের অন্যতম সঙ্গীতের জাদুঘর তানসেনের। অনেকে হয়তো এখনও ভাবেন বাংলা ছবিতে মিউজিক নিয়ে প্রথম কাজ বুঝি ‘তানসেনের তানপুরা’! পরিতাপের বিষয় অনেকে তো মিঞা তানসেনের নামটাও হইচইয়ের ওই ওয়েবসিরিজ দেখেই জেনেছিলেন, যদিও সিরিজটি বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে পুরোনো দিনের একটি কল্পনিক তানপুরার রহস্য উদ্ধারের গল্প বলেছিল, ট্রেজার হান্ট ন্যারেটিভে। কিন্তু তার ৬২ বছর আগেই যে স্বয়ং ‘তানসেন’-কে নিয়েই ছবি হয়ে গেছে সেটা কি জানতেন? জানলে হয়তো বহু ফিল্মবোদ্ধা ‘বাংলায় এখন নতুন ঘরানা এক্সপ্লোরড হওয়া শুরু হয়েছে’ জাতীয় হাস্যকর কথাবার্তাগুলো বলতেন না কারণ, এসবের শুরু অনেক আগেই, তাঁরা নিজেরা জানেন না সেটা সেটা অন্য কথা, কিন্তু না জেনে যা ইচ্ছে বলাটা অন্যায়। আর হিন্দিতে তো স্বাধীনতার আগেই হয়ে গেছে। জয়ন্ত দেশাইয়ের পরিচালনায় ১৯৪৩ সালে কুন্দন লাল সায়গল ও খুরশিদ বানু অভিনীত ‘তানসেন’ নামের হিন্দি ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। ছবিতে খেমচাঁদ প্রকাশের সুরে “মেরে বালাপন কে সাথী”, “রুম ঝুম রুম ঝুম চল তিহারি” সহ ১৩টি গান ছিল ছবিতে। এই ছবির ওপর ভিত্তি ক’রে পরিচালক সতীশ কৌশিক ২০০৯ সালে আরও একটি ছবি তৈরি করেছিলেন কিন্তু সেটা শেষ করতে পারেননি! এখন এই যে বাংলা ছবিটার কথা বলছিলাম সেটায় ফিরি। সে সময় কিন্তু এখনকার মতো প্রযুক্তি উন্নত ছিল না, দেখনদারি, চটকদারির চেয়ে সুলেখকদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হ’তো। তখন সবে পাঁচের দশকের শেষ। বিমল মিত্রের কাহিনি ও চিত্রনাট্যে নীরেন লাহিড়ীর পরিচালনায় ১৯৫৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল বাংলা ছবি ‘তানসেন’। ওঁর তৈরি রাগাশ্রয়ী গান ছাড়াও অতিরিক্ত গীতরচনা করেছিলেন প্রণব রায় ও কুমার সেলিমপুরী, সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন রবিন চট্টোপাধ্যায়, চিত্রগ্রাহক ছিলেন বিজয় বোস। ছবিতে মোট ১৬টি গান ছিল। তানসেনের চরিত্রে নাম ভূমিকায় অসীমকুমার বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন কিন্তু মৃগনয়নী চরিত্রে নবাগতা রীতা রায়কে একেবারেই মনে ধরেনি সেকালের দর্শকদের। এমন কি কোনও এক্সট্রা শিল্পীকে দিয়ে করলেও এই মূল চরিত্রটি তিনি উৎরে দিতে পারতেন বলেও ব’লে সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি। সর্বোপরি অনুভা গুপ্তা-কে মৃগনয়নী চরিত্র দিলে তিনি যে সাফল্যের সঙ্গেই চরিত্রে মিশে যেতেন সেই কথাও উঠেছিল। তবে গুরু হরিদাস স্বামীর চরিত্রে পাহাড়ি সান্যাল, তানসেনের স্ত্রী প্রেমকুমারের চরিত্রে অনুভা গুপ্ত, তানসেনের বাবা মকরন্দের চরিত্রে হরিমোহন বসু সবাই স্বভাবসিদ্ধ প্রাঞ্জল অভিনয়ে দর্শকদের প্রীত করেন। অন্যান্য শিল্পীদের মধ্যে তন্দ্রা বর্মন, মিহির ভট্টাচার্য্য, নিভাননী, প্রীতি মজুমদার প্রমুখরা ছিলেন উল্লেখযোগ্য। এই ছবির কাহিনিকার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বিমল মিত্র শুধু গুণীই চিলরন না সঙ্গে উনি যে কীরকম অমায়িক ও সৎ লোক ছিলেন, আপনারা চাইলে সেটা নিয়ে পরে কখনও লিখবোক্ষণ, আপাতত অনুরোধ রইলো এ জাতীয় তথ্য উৎসুক মানুষদের জানান🙏

🎼🎺https://youtu.be/kw4tP8AnYEk

আরফিন শুভ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.