চরম ধর্মান্ধ মাগারিজের জীবনের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল খ্রীষ্টধর্মের প্রচার – মাগারিজ না থাকলে মাদার টেরেসাকে কেউ চিনত না

১৯৯৭ সালে মাদার টেরেসার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পরে ১২ই অক্টোবর ইউরোপের বিখ্যাত ‘ক্যাথলিক টাইমস’ একটি মন্তব্য করে – “মাগারিজ না থাকলে মাদার টেরেসাকে কেউ চিনত না।”

কে এই মাগারিজ? ম্যালকম মাগারিজ (Malcolm Muggeridge) ছিলেন একজন ব্রিটিশ লেখক ও সাংবাদিক যিনি প্রবল কম্যুনিজম বিদ্বেষ এবং ইহুদি বিদ্বেষের জন্যে কুখ্যাত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি ডায়রিতে লেখেন, “খ্রীষ্টান সভ্যতা ধ্বংসের জন্য প্রধানত দায়ী এই দুজন – মার্কস ও ফ্রয়েড।” (ডায়ারিজ অফ ম্যালকম মাগারিজ, পৃষ্ঠা ৪২৬) ১৯৩৪ সালে তাঁর রচিত ‘উইন্টার ইন মস্কো’ বইটি ইহুদি বিদ্বেষের এক জলজ্যান্ত দলিল। চরম ধর্মান্ধ মাগারিজের জীবনের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল খ্রীষ্টধর্মের প্রচার।

এ হেন মাগারিজ গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের শেষের দিকে হঠাৎ মাদার টেরেসা সম্বন্ধে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। টেরেসা বেসিকালি আলবেনিয়ার অধিবাসী জানতে পেরেই বোধহয় তাঁর উৎসাহ বৃদ্ধি কারন সে সময়ে তিনি ভ্যাটক্যান এবং আমেরিকার সহায়তায় পুর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে খ্রীষ্টান ধর্ম প্রচারে ব্য‍াপৃত ছিলেন।

মাগারিজের টেরেসা সম্বন্ধে আগ্রহী হওয়ার আরেকটি কারন হল এই নানটি তাঁর কাজের জন্য সম্পুর্ন উপযুক্ত – অত্যন্ত রক্ষনশীল, অলৌকিকতায় বিশ্বাসী, জন্মনিয়ন্ত্রণ ও গর্ভপাতের কট্টর বিরোধী।

ব্যাপক মানুষের সামনে টেরেসাকে প্রদর্শন করবার উদ্দ্যেশ্যে বিবিসির সাহায্য নিয়ে ১৯৬৯ সালে মাগারিজ একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন যার শ্যুটিং হয় কলকাতায়। ‘সামথিং বিউটিফুল ফর গড’ নামের এই তথ্যচিত্রটি ইউরোপ ও আমেরিকায় টেরেসার এক অপুর্ব ভাবমূর্তি নির্মাণ করল। দুইবছর পর মাগারিজ একই নামের একটি বই প্রকাশ করলেন যাতে টেরেসাকে উল্লেখ করা হল “মাদার টেরেসা অফ ক্যালকাটা” নামে।

ফিরে চলুন ১৯৬৯ এর কলকাতায়। কলকাতা তখন মিছিল নগরী, বামপন্থী আন্দোলনের দুর্গ। “তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম” স্লোগান কান পাতলেই শোনা যায়। মাগারিজের তথ্যচিত্রে এই কলকাতাকে দেখানো হল ‘অান্ধের নগরী’ হিসাবে। একটি দৃশ্যে ছিল, কলকাতা ধোঁয়াশার ধু ধু প্রান্তর যাতে একটিমাত্র আলোকবিন্দু – মাদার টেরেসা হেঁটে যাচ্ছেন। অন্য একটি দৃশ্যে মাদার একটি অন্ধ শিশুর চোখে হাত বুলিয়ে দিলেন, শিশুর মুখে এক স্বর্গীয় হাসি ফুটে উঠল।

তথ্যচিত্রটির প্রচারে মাগারিজ এক অলৌকিক দাবী করলেন। তাঁর বইতে লিখেছেন, মাদারের হোমের ভিতরে ইনডোর শ্যুটিংএর সময় ফিল্মের অভাবে নাকি ক্যামেরাম্যান আউটডোর শ্যুটিংএর ফিল্ম দিয়ে ছবি তোলে। তা সত্ত্বেও ছবিতে নাকি এক অপার্থিব আলো দেখা যায়। মাগারিজের বক্তব্য অনুসারে, “এই আলো আসলে ‘ঐশ্বরিক জ্যোতি – সন্তদের মাথার চারপাশে যা থাকে।” (সামথিং বিউটিফুল ফর গড, পৃষ্ঠা ৪৮)

যদিও ক্যামেরাম্যান কেন ম্যাকমিলানের বক্তব্য হল তিনি ইনডোর শ্যুটিংএর জন্য কোডাকের কিছু নুতন ফাস্টার ফিল্ম ব্যবহার করেন। এবং তাঁকে এই ব্যাপারে কিছু বলতে মাগারিজ মানা করেছিলেন। (হেলস এঞ্জেল, ১৯৯৪)

যাইহোক, ৫ই ডিসেম্বর, ১৯৬৯ তথ্যচিত্রটি বিবিসি টেলিভিশনে প্রদর্শনের আগেই মাগারিজ “অলৌকিকের প্রথম ফটোগ্রাফিক প্রমাণ” বলে হাওয়া তুলে ব্রিটেন ও আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ও পাবলিকের মধ্যে এটির সম্পর্কে আগ্রহ তুঙ্গে তুলে দেন। তাই মাদারকে ‘আবিস্কারের’ জন্য স্রেফ বিশ্বব্যাপী ক্যাথলিক সংগঠনগুলিই নয়, ইউরোপ ও আমেরিকার রক্ষণশীল সমাজ এমনকি খোদ মাদার টেরেসাও ছিলেন ম্যালকম মাগারিজের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া এবং ‘মাদার টেরেসা- মুখ ও মুখোশ , অরূপ চ্যাটার্জী)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.