দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান দেওয়া হলো রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রয়াত প্রচারক আম্বাদাস অমৃতরাও দেশমুখকে। ভারতরত্ন’ সম্মানে ভূষিত হলেন তিনি। আপামর ভারতবাসীর কাছে তার পরিচিতি নানাজী দেশমুখ নামেই। তার সঙ্গে এই সম্মান আরও দু’জনকে দেওয়া হয়। মরণোত্তর ‘ভারতরত্ন’ সম্মান দেওয়া হয় ‘পদ্মশ্রী’ ও ‘পদ্মবিভূষণ’ প্রয়াত সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকাকে এবং “ভারতরত্ন’ সম্মান দেওয়া হয় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে। ৭০তম সাধারণতন্ত্র দিবসের আগে ওই তিন ভারতরত্ন প্রাপকের নাম ঘোষণা করেছে কেন্দ্রের মোদী সরকার। এর আগে দেওয়া হয়েছিল ২০১৫ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং স্বাধীনতা যোদ্ধা ও বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মদনমোহন মালব্যকে।
কে এই নানাজী দেশমুখ?
১৯১৬ সালের ১১ অক্টোবর তারিখে মহারাষ্ট্রের পরভানি জেলার কাদোলি শহরে জন্মগ্রহণ করেন নানাজী দেশমুখ। সমাজকর্মী হিসাবে মহারাষ্ট্রে পরিচিত ছিলেন এবং আচার্য বিনোভাভাবের দ্বারা শুরু হওয়া ভূদান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ছোটোবেলাতেই বাবা-মাকে হারিয়ে অনাথ তার স্থান হয়েছিল মামার বাড়িতে। মামার আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না তাই নিজের পড়াশুনার খরচ বহন করার জন্য বাজারে সবজি বিক্রি করতেন। সেই উপার্জন থেকেই পড়াশোনার খরচ চালান। উচ্চশিক্ষা লাভ করেন পিলানীর বিড়লা ইনস্টিটিউট থেকে। তবে নানাজীর পরিবারের সঙ্গে সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের যোগাযোগ ছিল। তাই নানাজীর ছোটোবেলাতেই সাক্ষাৎ ঘটে সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের সঙ্গে। তাকে দেখে তিনি উদ্বুদ্ধ হয়ে বালক বয়সেই স্বয়ংসেবক হন।
উচ্চশিক্ষার পর ১৯৫০ সালে তিনি উত্তরপ্রদেশের গোরখপুরে সঙ্ঘের প্রচারক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তবে গোরখপুর যাওয়ার আগে তিনি কিছুদিন আগ্রায় সঙ্ঘের দায়িত্ব পালন করেন। সান্নিধ্যলাভ করেন পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়ের। সংগ্রহ করে নিয়েছিলেন ভবিষ্যতের কর্মজীবনের সমস্ত রকমের বৌদ্ধিক উপাদান।
১৯৪৭ সাল। স্বাধীনতার আনন্দ আর দেশভাগের বেদনার বিচিত্র মিশেল। সঙ্ঘের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রধর্ম, পাঞ্চজন্য নামে দুটি সাপ্তাহিক এবং স্বদেশ নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সম্পাদনার দায়িত্ব ছিল অটলবিহারী বাজপেয়ীর উপর। মার্গদর্শক ছিলেন দীনদয়াল উপাধ্যায়। আর ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে প্রকাশনার দায়িত্বভার পালন করেন নানাজী।
১৯৪৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি গান্ধী হত্যার মিথ্যা অজুহাতে যখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে নিষিদ্ধ করা হয় তখন অন্যান্য সঙ্ঘ কার্যকর্তাদের সঙ্গে নানাজী আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে আন্দোলন শুরু করেন। শিশু শিক্ষার উন্নয়নের প্রতি ঝোঁক ছিল। কচিকাচারা যাতে বড়ো হয়ে “মানি মেকিং মেশিন’ না হয়ে ওঠে তার জন্য তিনি সম্পূর্ণ ভারতীয় পরম্পরায় গড়ে তুললেন ১৯৫০ সালে সরস্বতী শিশু মন্দির। সেখানে তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশুরা শিশুমন্দিরের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকল। শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর চার বছর পর ১৯৫৭ সালে ভারতীয় জনসঙ্ঘ দীনদয়ালজীর নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়াবার সংকল্প নেয়। সঙ্ঘের দ্বিতীয় সরসঙ্চালক শ্রীগুরুজীর পরিকল্পনা মতো জনসঙ্ঘের দায়িত্ব নেন নানাজী। শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক কর্মব্যস্ততা। উত্তরপ্রদেশে প্রথম অকংগ্রেসী সরকার গড়ার নেপথ্যে ছিলেন তিনি। সেখানকার তাবড় কংগ্রেস নেতা চন্দ্রভানু গুপ্তাকে একবার নয়, তিন তিনবার স্রেফ বুদ্ধির জোরে টেক্কা দিয়ে পরাস্ত করেন তিনি।
১৯৬৯ সালে নানাজী দেখতে যান মধ্যপ্রদেশের একটি ছোটো পুণ্যস্থান চিত্রকূট। ‘পুণ্যস্থান’ কারণ এই চিত্রকূটেই শ্রীরামচন্দ্র বনবাসকালে চোদ্দবছর কাটিয়েছিলেন। চিত্রকূটের অবস্থা দেখে নানাজীর মন উদ্বিগ্ন এবং অস্থির হয়ে ওঠেছিল। তখন মনে প্রাণে শপথ নিয়েছিলেন চিত্রকূটের সার্বিক উন্নয়নের। স্বাধীনচিত্তে মনোনিবেশ করেছিলেন এলাকার উন্নয়নে। তখন নানাজীর মুখে একটিমাত্র স্লোগান ছিল। সেটা হলো—‘প্রত্যেকের হাতে কাজ দাও, প্রত্যেকের ক্ষেতে জল দাও।’ তাই প্রথম গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চিত্রকূটে গড়ে তুললেন চিত্রকূট গ্রামোদয় বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭২ সালে পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়ের একাত্ম মানবদর্শনকে স্মরণ করে গ্রামীণ ক্ষেত্রের উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি চিত্রকূটে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দীনদয়াল রিসার্চ ইন্সটিটিউট-এর শাখা। তখন ঠিক করা হয়েছিল এলাকায় বৃষ্টির জল ধরে রাখা হবে। তাই কৃষিকাজের জন্য গড়ে তোলা হয় জলাশয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, কোনও জলাশয় সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা হলো না। স্থানীয় এলাকার পাথরকুচি, নুড়িপাথর আর কাদা দিয়ে গড়ে তোলা হয় এইসব ড্যাম বা ছোটো ছোটো বাঁধ। পরে গড়ে তোলেন কৃষিবিকাশ কেন্দ্র। গ্রামবাসীদের জন্য নানাজী গড়ে তুললেন ‘সীড ক্লাব’ (বীজ সংগ্রহশালা)। ধর্মকে বাদ দিয়ে যে ভারতের শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে পারে না, একথা মহাপুরুষরা বার বার বলেছেন। নানাজী তাই গড়ে তুলেছেন ‘রামদর্শন’। রামদর্শনের মাধ্যমে রামায়ণের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি করেন। সবশেষে চিত্রকুটের উন্নয়নে যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন নানাজী সেটি হলো— ‘সমাজ শিল্পী দম্পতি’। অর্থাৎ স্নাতকস্তরের দম্পতিরা একজন করে পাঁচটি গ্রামের উন্নয়নের দায়ভার নেবেন এবং তারাই দেখাশোনা করবেন গ্রামবাসীদের। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে চিত্রকূটের দুর্দশার ছবি পাল্টে যায়। এই চিত্রকূটে এসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সঞ্জীব রেড্ডি নানাজীর সঙ্গে সহভোজে অংশ নিয়েছিলেন। নানাজীর কর্মকাণ্ড দেখে রাষ্ট্রপতি রেডি বলেছিলেন—“সমস্ত রকমের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ছাড়াও নানাজী যে দীনদয়াল রিসার্চ ইন্সটিটিউট গড়ে তুলেছেন আমি মনে করি তা জাতপাতের সংঘর্ষমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। আমি সেই কারণেই বুঝতে পারছি চিত্রকূটকে ঘিরে থাকা ৮০টি গ্রামে কেন কোনো মোকদ্দমা নেই।”
১৯৭৫ সালে দেশে জারি হয় জরুরি অবস্থা। নানাজী অকুতোভয়। চিত্তে জয়প্রকাশ নারায়ণের সহযোগী হিসাবে ঝাপিয়ে পড়লেন ইন্দিরা গান্ধীর অপশাসন বিরোধী আন্দোলনে। পরে ১৯৭৭ সালে কেন্দ্রে মোরারজী দেশাইয়ের নেতৃত্বে প্রথম অকংগ্রেসি সরকার গঠিত হয়। ওই সময় নানাজী সাংসদ নির্বাচিত হন। মন্ত্রীসভায় নানাজীকে যোগদানের অনুরোধ জানানো হলে তিনি বয়সের কারণ দেখিয়ে সবিনয়ে অস্বীকার করেন। তখন নানাজীর বয়স ছিল ৬১। আসলে তখন তিনি ঋষিকল্প মানুষ। গ্রামের গরিব মানুষের উন্নয়নের চিন্তায় তিনি বিভোর থাকতেন।
১৯৯৪ সালে নানাজী নিজের দেহদান করে যান দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সে। ১৯৯৯ সালে নানাজী দেশমুখ পদ্মবিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি তৈরি করেছিলেন চিত্রকূট গ্রামোদয় বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত নানাজী দেশের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক রাজ্যসভার সাংসদ মনোনীত হন। ২০১০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন। পরে নানাজীর ইচ্ছে অনুসারে মরণোত্তর দেহ দান করা হয় দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সে। আর সেই নানাজীকে কেন্দ্রের বর্তমান মোদী সরকার দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘ভারতরত্ন’ প্রদান করে নানাজীর প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করেছে। তাই ভারতরত্ন প্রাপকদের নাম ঘোষণার শেষে দেশের প্রধানমন্ত্রী ২৫ জানুয়ারি, ২০১৯ সালে এক এক টুইট বার্তায় জানান দেশবাসীকে
“Nanaji Deshmukh’s stellar contribution towards rural development showed the way for a new paradigm of empowering those living in our villages. He personifies humility, compassion and service to the downtrodden. He is a Bharat Ratna in the truest sense!”
গ্রামবিকাশের পুরোধাপুরুষকে মরণোত্তর ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত করা মোদী সরকারের নিঃসন্দেহে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
ধর্মানন্দ দেব
(লেখক পেশায় আইনজীবী)