প্রতিটি নব নির্বাচিত সরকারের কিছু নির্দিষ্ট অঙ্গীকার, পরিকল্পনা এবং অ্যাজেন্ডা থাকে। ২০১৪-এর পর মোদী সরকার প্ল্যানিং কমিশনের নাম পরিবর্তনে করেছিল। নতুন নাম হয়েছে নীতি আয়োগ। ধীরে ধীরে আমরা দেখেছি জিএসটি, বিমুদ্রীকরণ অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়াদের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণ প্রভৃতি গত সরকারের সাহসী পদক্ষেপ। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের অভূতপূর্ব জনাশীর্বাদ নিশ্চয় গত ৫ বছরের সন্তুষ্টি প্রকাশ পেয়েছে। তবে মোদী সরকারের সম্মুখে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম সংবিধানের ধারা ৩৭০ এবং ৩৫ (এ)-র উচ্ছেদ, জন্মনিয়ন্ত্রণ আইন লঘুকরণ, তিন তালাক নিষিদ্ধকরণ, এক দেশ এক আইন এবং অবশ্যই এক দেশ এক নির্বাচন প্রভৃতি ইস্যুর বাস্তবায়ন করা। স্বাভাবিকভাবে খোদ শরিক দলের সঙ্গে মতবিরোধ সহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের চরম প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে সংবিধান সংশোধন মোটেই সহজতর নয়। তবে সরকারের দৃঢ় মানসিকতা এবং রাজনৈতিক পারদর্শিতায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকেও বাগে আনা সম্ভব যেটা আমরা বিগত সরকারের অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়াদের সংরক্ষণে দেখেছি। বৃহত্তর জনস্বার্থকে মাথায় রেখে দেশের সকল রাজনৈতিক শক্তির সরকারের পাশে দাঁড়ানো একান্ত কাম্য, অন্যথায় বিরোধীদের ভোট পুঁজি জনসমর্থন খুইয়ে ক্রমান্বয়ে তলানিতে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী। সরকারের বিরোধিতা করা মানে এই নয় যে তার জনকল্যাণমূলক প্রকল্প বা যোজনায় বাধা সৃষ্টি করা।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ‘এক দেশ এক নির্বাচন ইস্যু নিয়ে দিল্লিতে সর্বদলীয় এক বৈঠকের আহ্বান করেন। প্রত্যাশিতভাবে বৈঠকটি কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজবাদী পার্টি, ডিএমকে বৈঠকে অংশগ্রহণ করেনি। বিরোধীরা ইস্যুটিকে পাশ কাটিয়ে ইভিএমের পরিবর্তে ব্যালট ভোট ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের কাছে আর্জি জানান। বর্তমানে ‘এক দেশ এক নির্বাচন একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় থাকলেও এর সূচনা হয়েছিল ১৯৫২ সালে। সেবার ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন এবং প্রতিটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন একসঙ্গে হয়। খরচ হয়েছিল ১০ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এক দেশ এক নির্বাচন’ ধাঁচে পুরো দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৫২ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এক দেশ এক নির্বাচন’ ধাঁচে পুরো দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল কিন্তু মাঝপথে অনেক রাজ্য সরকার ভেঙে যাওয়ায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের এককালীন এই নির্বাচন ব্যবস্থা প্রথম ভেস্তে যায়। ১৯৭৭ সালে প্রথম যে অকংগ্রেসি সরকার এসেছিল সেটিও পুরো মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন ছাড়াও পৌর ও পঞ্চায়েত নির্বাচন লেগেই থাকে। ২০১৪ সালের ষোড়শ সাধারণ নির্বাচনে ওড়িশা ও তেলেঙ্গানা ছাড়াও দুটো কেন্দ্র শাসিত রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে খরচ হয়েছিল প্রায় ৩ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। বর্তমান সরকার রাজকোষের এই অর্থ অপচয় রোধে সময় ও প্রশাসনিক ক্ষমতা সাবলীল রেখে দেশের সাধারণ নির্বাচনকে সরল রাখতেই এই এক দেশ এক নির্বাচন’-এর প্রস্তাব এনেছে। প্রস্তাবটিতে প্রধানমন্ত্রী মোদী ২০১৬ সাল থেকে সক্রিয় ছিলেন, সেই সুবাদে দেশের আইন কমিশন সংবিধানের কিছু নীতি পরিবর্তন ও সংশোধনের সুপারিশ করেছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ধারা ৮৩-তে সংসদের দুই কক্ষের মেয়াদের কথা বলা হয়েছে, ধারা ৮৫-তে লোকসভা ভেঙে দেওয়ার নথিবদ্ধ রয়েছে এই ধারায়, ধারা ১৭২-তে রাজ্যে বিধানসভাগুলির মেয়াদের কথা বলা হয়েছে, ধারা ১৭৪-তে বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার নিয়ম নথিভুক্ত রয়েছে, ধারা ৩৫৬-তে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির বিধি নথিভুক্ত। ১৯৫১ সালের তৈরি জনপ্রতিনিধিত্ব আইনেও সংশোধনী প্রক্রিয়া করতে হবে। উল্লেখিত এই ধারাগুলি সংশোধন না করলে ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ কোনো ভাবেই সম্ভবপর নয়। ২০২৪ সালে দেশের পরবর্তী অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন অর্থাৎ সেই বছরে লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে ২৯টি রাজ্যে ও দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হবে। কিন্তু ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে বিধানসভা নির্বাচন, গুজরাট ও উত্তরপ্রদেশে ২০২২ সালে অর্থাৎ এই সমস্ত রাজ্যের বিধানসভার মেয়াদ শেষ হবে যথাক্রমে ২০২৬ এবং ২০২৭ সালে। ২০২৪ সালে ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ধাঁচে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এই সমস্ত অনেক রাজ্যের বিধানসভার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার অনেক আগেই ভেঙে ফেলতে হবে। কিন্তু এক দেশ এক নির্বাচন হলেই যে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার তাদের ৫ বছরের নির্দিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ করতে পারবে বা কোথাও ৩৫৬ ধারা জারি হবে না এর নিশ্চয়তা তো নেই! তাই নির্বাচন সম্পর্কিত সব ধারা সংশোধন করে সরকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে যে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের কোনো কারণে ভেঙে গেলেও অকাল নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে ভারতে অকাল নির্বাচন বন্ধ করা তখনই সম্ভব যদি ভারতও আমেরিকা ধাঁচে রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রিক সরকার গঠনের পথ বেছে নেয়। অর্থাৎ কেন্দ্রে বা রাজ্যে যদি কোনো সরকার মাঝপথে ভেঙে যায় তবু আইনসভা নির্দিষ্ট ৫ বছর যাবৎ বৈধ থাকবে, চেষ্টা করা হবে নতুন কোনো মন্ত্রীসভা গঠন করার। তাও যদি সম্ভবপর হয় তাহলে জারি হবে রাষ্ট্রপতি শাসন। অর্থাৎ ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ সংজ্ঞায় দেশের কোনো প্রান্তে অকাল নির্বাচনের আর কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না। তবে প্রয়োজনানুসারে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে এই নির্বাচন নীতি কোনো বাধানিষেধ আরোপ করবে না।
একটি বেসরকারি সংস্থা মিডিয়া স্টাডিজ-এর এক রিপোর্ট অনুসারে ২০১৯-এর সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে খরচ হয়েছে পায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। মূলত রাজকোষের এই অপচয় রোধ করতেই ‘এক দেশ এক নির্বাচন-এর কৌশল। ১৯৫২, ১৯৫৭, ১৯৬২, ১৯৬৭-তে দেশের সকল রাজ্যে এবং কেন্দ্রে এক সঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তারপর ১৯৬৭-এর পরে দেশে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলির শক্তি বৃদ্ধি হওয়াতে অনেক রাজ্যে অকাল ভোটের প্রকট ঘটে।১৯৭১, ১৯৮০, ১৯৮৪, ১৯৯১, ১৯৯৮, ১৯৯৯ সালে কেন্দ্রে সরকার নির্দিষ্ট সময় পূর্ণ না করে ভেঙে যায়। প্রধানমন্ত্রীর ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২১টি অংশগ্রহণ করে তাঁরা সমর্থন জানায়, তবে কয়েকটি যুক্তি ও শর্তের সঙ্গে। বৈঠক বয়কটকারী তৃণমূল কংগ্রেসের মতো আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল মনে করে এইরকম নির্বাচনে তারা অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাবে। কংগ্রেসিরা মনে করছে এটা নরেন্দ্র মোদীর কেন্দ্রে দীর্ঘশাসন ব্যবস্থা কায়েম করার একটি চাল। সপা-বসপা বলছে ইভিএম থেকে জনসাধারণকে নজর ঘোরানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর একটা নতুন পরিকল্পনা।
ভারতের পূর্ব নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশি ‘এক দেশ এক নির্বাচন ব্যবস্থাকে সমর্থন করে জানান এই নির্বাচন ব্যবস্থাটি দেশের আর্থিক ব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করবে। তবে নির্বাচন কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী নতুন করে নির্বাচন ব্যবস্থাটি চালু করতে এককালীন ইভিএম এবং ভিভিপিএটি ক্রয় করতে অতিরিক্ত খরচ লাগবে প্রায় ৯ হাজার ২৮৪ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা। একটি বেসরকারি সমীক্ষায় দেখা গেছে কোনো রাজ্যে লোকসভা ও বিধানসভা ভোট এক সঙ্গে হলে ৭৭ শতাংশ ভোটার একই দলকে ভোট দেন। কিন্তু রাজ্য ও কেন্দ্র স্তরের রাজনৈতিক ইস্যু সম্পূর্ণ আলাদা থাকে, তাই এই সমীক্ষা যথেষ্ট গুরুত্ব পাবে বলে মনে হয় না। উদাহরণ স্বরূপ, এবার ২০১৯ এর সপ্তদশ নির্বাচনে ওড়িশায় রাজ্য ও কেন্দ্র স্তরের নির্বাচনে লোকসভায় বিজেপি বেশি ভোট পেলেও বিধানসভায় বিজেডি জয়ী হয়েছে। ১৪৬টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে বিজু জনতা দল (বিজেডি) পেয়েছে ১১২টি এবং বিজেপি পেয়েছে মাত্র ২৩টি আসন। পক্ষান্তরে সেখানে ২১টি লোকসভা কেন্দ্রে বিজেডি পেয়েছে ১২টি এবং বিজেপি ৮টি। অনুরূপভাবে এই নির্বাচনে বিজেপির পদ্ম পুরো দেশে ফুটলেও অন্ধ্রপ্রদেশে জগমোহন রেডি বিধানসভা ও লোকসভায় ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সুতরাং‘এক দেশ এক নির্বাচন কোনো ভাবেই আঞ্চলিক রাজনৈতিক পার্টির জন্য বিপদসংকেত নয়। এটা ঠিক জিএসটি, বিমুদ্রীকরণের মতো ‘এক দেশ এক নির্বাচন ব্যবস্থায়ও সাময়িক কিছু অসুবিধা আসবেই, তবে কেন্দ্রে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের সুফল তো দেশবাসী পাবেই।
আর. কে. দে
2019-07-06