পুলিশ সুপার যদি পাশ করা ডাক্তার হন তাহলে সমীকরণটা একটু বিস্ময়কর মনে হয়। কিন্তু ডাঃ অভিষেক পল্লবের সঙ্গে পরিচয় হবার পর বোঝা যায় যিনি রাঁধেন তিনি চুলও বাঁধেন। অর্থাৎ যিনি অটোমেটিক রিভলবার হাতে আততায়ীর পিছু নেন, সেই তিনি ডাক্তারিও করেন।
২০১৭ সালের মার্চ মাসের ঘটনা। বাস্তারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিষেক পল্লবের নাম খবরের কাগজের শিরোনামে উঠে এসেছিল। কারণ সেবার তিনি পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে আহত এক মাওবাদী কম্যান্ডারকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। তাঁর নিজের কথায় : ‘হাতে সময় বেশি ছিল না। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। একজন চিকিৎসক হয়ে আমি চুপ করে বসে থাকতে পারিনি।’
এরপর ২০১৮ সালের জানুয়ারি। সেবার পোহরু নামের এক কুখ্যাত মাওবাদী কম্যান্ডারকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ। এই পোহরুর মাথার দাম ছিল তিন লক্ষ টাকা। ডাঃ পল্লব পোহরুর অসুস্থ স্ত্রী এবং অপুষ্টিতে ভোগা বাচ্চাদের চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। পোহরুর স্ত্রীর টিবি হয়েছে বুঝে তিনি তাকে স্থানীয় জেলা হাসপাতালে ভর্তি করে দেন।
ডাঃ পল্লব ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের ২০১২ ব্যাচের অফিসার। এখন তিনি মাওবাদী অধুষিত ছত্তিশগড়ের দন্তেওয়াড়ার পুলিশ সুপার। প্রশসনিক দায়িত্ব পালনের ফাঁকে তিনি ২০১৬ সালে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স থেকে মনোবিদ্যায় প্রশিক্ষণ নেন। উদ্দেশ্য, প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার মাধ্যমে মূলস্রোতের ভারতীয় সমাজের প্রতি জনজাতি যুবকদের ক্ষোভ প্রশমিত করা এবং দেশবিরোধী মাওবাদের গ্রাস থেকে তাদের মুক্ত করা। এই কাজে তাঁর যোগ্য সহধর্মিণীর ভূমিকা পালন করেন চিকিৎসক-স্ত্রী যশা পল্লবও।
অভিষেক বলেন, গত আড়াই বছরে আমরা ৭০-৮০টা স্বাস্থ্য শিবিরের আয়োজন করেছি। সেই সঙ্গে বলব শতাধিক চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য শিবিরের কথা। আমরা শিবিরের আয়োজন করি এমন সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে চিকিৎসক পাওয়া যায় না, কোনও স্বাস্থ্য- পরিকাঠামো নেই, এমনকী মাওবাদীদের ভয়ে সাধারণ স্বাস্থ্যকর্মীরাও সেখানে যেতে চান না। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই প্রতিটি শিবিরে উপস্থিত থেকে চিকিৎসা করেন। ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করে দেন। এছাড়া জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষকে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি সম্বন্ধে সচেতন করেন। অপুষ্টির হাত থেকে শিশু ও মহিলাদের বাঁচাতে কী ধরনের খাবার খেতে হবে সেই সম্বন্ধেও একটা প্রাথমিক ধারণা গড়ে দেবার চেষ্টা করেন।
অভিষেক জানান, আমরা মূলত প্রাথমিক চিকিৎসা করি। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে সংগ্রহ করা ওষুধ রোগীর প্রয়োজন অনুসারে দিই। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, আমার স্ত্রী একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ। এই অঞ্চলে নানারকম চর্মরোগ এবং অ্যালার্জির প্রকোপ মারাত্মক। বিশেষ করে এখানকার আবাসিক স্কুলগুলিতে।…দন্তেওয়াড়া জেলার জনসংখ্যা আড়াই লক্ষ। গত আড়াই বছরে আমরা এখানকার প্রায় ২৫,০০০ মানুষের চিকিৎসা করেছি। যার ফলে ইদানীং জনজাতি সম্প্রদায়ের বহু মানুষ নানা প্রয়োজনে আমাদের জেলা হেডকোয়ার্টারে আসছেন। স্বাস্থ্য শিবিরে আয়োজনের ফলে জনজাতি সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমাদের আত্মিক যোগাযোগ যে বেড়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু যে কোনও ভালো কাজেই বাধা থাকে। কখনও কখনও সেই বাধা পাহাড়ের মতে দুর্লঙ্ঘ্য হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রেও বাধা আছে। সব থেকে বড়ো বাধা স্থানীয় গ্রামবাসীদের ভয়। তাদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন স্বাস্থ্য শিবিরে গিয়ে চিকিৎসা করলে মাওবাদীরা তাদের পুলিশের চর বলে মনে করবে। অভিষেক জানেন সত্যি সত্যি এরকম কিছু হলে তার ফল হবে সাংঘাতিক। তাই তাকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হয়। কীরকম ব্যবস্থা? প্রথমে তারা গ্রামের কোনও প্রতিনিধি স্থানীয় ব্যক্তিকে বোঝান। তারপর সেই জনপ্রতিনিধি গ্রামের সাধারণ লোককে রাজি করান। অভিষেক বলেন, ‘ভয় পেয়ে ভালো কাজ করা বন্ধ করে দিলে চলবে না। তাহলে এতগুলো মানুষ সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। যার সুযোগ নেবে মাওবাদীরা।’
সন্দেহ নেই মাওবাদের বিরুদ্ধে এক অভিনব যুদ্ধে শামিল হয়েছেন ডাঃ অভিষেক পল্লব এবং তার স্ত্রী। প্রাণনাশের হুমকি শুনেছেন অনেকবার কিন্তু দমে যাননি। যথার্থ সৈনিকের মতোই অকুতোভয়ে এগিয়ে গেছেন। মাওবাদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক যুদ্ধের পাশাপাশি অভিষেকের এই যুদ্ধও জরুরি। প্রাতিষ্ঠানিক সেনা মাওবাদীদের গ্রাস থেকে দেশকে উদ্ধার করুক আর অভিষেক করুন মন জয়। কারণ মন জয় করে অভিমানীদের ফিরিয়ে আনতে না পারলে দেশ কখনও ঘর হবে না।