লোকসভা ভোটের ফলাফল তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে চরম অশনি সংকেত, একথা
পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর থেকেই গোটা রাজ্য জুড়ে শুরু হয়ে গেছে হিংসাত্মক
রাজনৈতিক হানাহানি। প্রায় সর্বত্রই তৃণমূল কংগ্রেসের একচেটিয়া আক্রমণ
রাজ্যের জেলায় জেলায় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে মানুষের স্বাভাবিক জীবন
যাপনে বাধা সৃষ্টি করছে। ঘরে ঘরে যুবক এবং তরুণদের টেনে বের করে হয়
পিটিয়ে, না হয় পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে যারা হচ্ছে। রেহাই
মিলছে না মা-বোনেদেরও। বাধা দিতে এলে তাদের ওপরও পড়ছে উপযুপরি চপারের
আঘাত। গ্রামবাঙ্গলার আনাচে কানাচে লুকিয়ে রয়েছে। অত্যাচারী সুপারি
কিলাররা। কখনো বাইক বাহিনীর দুরন্ত রক্ত জল করা হুংকার, কখনও বা মোটা মোটা
বাঁশের আগায় তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকা লাগিয়ে ঘরে ঘরে ঢুকে শাসানি। কখনও
প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখানো তো কখনোবা মা-বোনেদের ইজ্জত লুটে নেওয়ার চরম
হুংকার। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চাপা সন্ত্রাসের সূত্রপাত
করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই। কখনও পার্কস্ট্রিটের
সুজেট-ধর্ষণের ঘটনায়, কখনও বা কামদুনির ‘নির্ভয়া’ধর্ষণের ঘটনায়, কখনও
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, কখনো বা পশ্চিম মেদিনীপুরে একটার পর একটা ঘটনায়
যেভাবে তিনি সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তা
নজিরবিহীন। ‘২০১৯ বিজেপি ফিনিশ’ স্লোগান তুলে সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে
নিজেই ফিনিশ হয়ে যাবার পর যেদিন প্রকাশ্য সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করলেন,
“রাজ্যের জন্য একটু বেশিই কাজ করা হয়ে গেছে। এবার আর বদলের রাজনীতি নয়,
দরকারে বদলার রাজনীতিই করব’, সেদিন থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের হার্মাদ বাহিনী
ঝাপিয়ে পড়েছে। মানুষের ওপর। যেখানে যেখানে হেরেছে। শাসক দল সেই সমস্ত
এলাকার মানুষের ওপর আছড়ে পড়েছে সশস্ত্র আক্রমণ। এবং এই সমস্ত আক্রমণে
সাহায্যকারী হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছে রাজ্য পুলিশকে প্রত্যক্ষ ভাবে। কারণ
পুলিশের নাকের ডগাতেই খুন হলেও পুলিশ চেয়ারে বসে হাওয়া খেয়েছে— যে
প্রমাণ বার বার উঠে এসেছে। অতি সম্প্রতি সন্দেশখালিতে দুজন তরতাজা যুবক খুন
হয়ে যাওয়ার পরেও ছবিটা বদলায়নি। এমনকী দলীয় কর্মীদেরও শানিত আক্রমণের
শরিক হতে ইন্ধন যোগাচ্ছেন খুখ্যমন্ত্রী। লোকসভা ভোটের পর দলীয় পর্যালোচনা।
সভায় দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করলেন দলীয় কর্মী মোক্তার হোসেনকে।
কারণ ওই মোক্তার হোসেন হুগলীর বিজেপি। প্রার্থী লকেট চ্যাটার্জিকে
নির্বাচনী বুথে ঢুকতে না দিয়ে গণতান্ত্রিক নজির সৃষ্টি করেছেন। বীরভূমের
বীর রাজনীতিবিদ অনুব্রত মণ্ডলকে দিয়ে বলানো হচ্ছে— যদি কেউ ভাবে ঝামেলা
করব, মস্তানি করব, তাহলে রাজি আছি। যদি ভেবে নেন তৃণমূল ঘরে বসে। আছে তাহলে
মুখের স্বর্গে বাস করছেন। মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক শীর্ষকর্তার চেয়ারে
বসে। নিদের্শ দিচ্ছেন— ‘বিজয় মিছিল করা যাবে না’। ভোটের আগে
প্রধানমন্ত্রীকেও সভা করতে দিতে বাধা দিয়েছেন নানা ভাবে। ভোটের পরে নয়া
ফরমান বিজয় মিছিল করা যাবে না। সন্দেশখালিতে দুটি মৃত যুবকের দেহ লোপাট
করার চেষ্টা করেছে। পুলিশ। শেষ পর্যন্ত বিজেপি নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে মৃতদের
পরিজনরা দেহ সকার করতে পেরেছেন। মুখ্যমন্ত্রী কোনও বিবৃতি দেননি। তাঁর
ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্র থেকে হিন্দু
ভোটারদের তাড়িয়ে দিয়ে একচেটিয়া ছাপ্পা ভোটে জিতেছেন— এই ধ্রুব সত্যটা
মানুষ দেখেছে চোখের সামনে। হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের ভিডিয়ো সোশ্যাল
মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। তার যাবতীয় দুর্নীতি এবং পাশাপাশি সংসদ অধিবেশনে
অপদার্থ ভূমিকা গোটা ভারতবর্ষের মানুষ উপভোগ’করেছেন থুতু ফেলে। অথচ সেই
ভাইপোকে আগের চেয়ে বেশি করে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন মঞ্চ থেকে মঞ্চে।
মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন—তিনি মুসলমানদের তোষণ করেন। বলছেন,
“যে গোরু দুধ দেয়, সেই গোরুর লাথিও খেতে হয়। অর্থাৎ ভোট পাচ্ছেন।
সংখ্যালঘুদের। তারা অপমান করলে, তিনি অপমানিত হতেও রাজি।
কী চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী? গৃহযুদ্ধ?
প্রকৃতপক্ষে
পশ্চিমবঙ্গ এখন গৃহযুদ্ধের পথেই হাঁটছে বলে মনে হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর
মতিগতি এবং হাবভাব পরিষ্কার বিজেপি বিরোধিতার নাম করে তিনি এখন শুধু
হিন্দু-মুসলমান বিভাজনকেই তীব্র করে তুলছেন না, গোটা বঙ্গকে রাজনৈতিকভাবে
বিভাজন করে এক ধবংসাত্মক খেলা খেলছেন। গোটা রাজ্যে আগুন জ্বেলে দাবানল
সৃষ্টি করতে চাইছেন। তিনি বুঝে গেছেন—এ রাজ্যে তার এবং তার পরিবারের
ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তিনি বুঝে গেছেন— তৃণমূল কংগ্রেস নামক যে দলটির তিনি জন্ম
দিয়েছিলেন সেটি অচিরেইশ্মশানযাত্রা করবে নয়তো দলের বিচক্ষণ নেতৃত্বের
করায়ত্ত হবে। এমতাবস্থায়, তার লক্ষ্য একটাই— বিজেপি রাজ্যের ক্ষমতায়
আসীন হবার আগে সোনার লঙ্কাকে ছারখার করে দেওয়া এবং একটি ধ্বংসস্থূপ বিজেপি
নেতৃত্বের হাতে তুলে দেওয়া। কেন্দ্র তথা মোদী বিরোধিতাকে চরমে নিয়ে যেতে
তিনি নীতি আয়োগের বৈঠকে গেলেন না। রাজ্যের কোনো বক্তব্যই কেন্দ্রের কানে
তোলা গেল না। কোনও দাবি করা হলো না।
আসলে মমতা ঢুকে গেছেন এক অন্ধ
কানাগলিতে। যেটা কৃষ্ণগহ্বরের মতোই নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের জগৎ। দলের
ল্যাম্পপোস্ট হিসেবে চিহ্নিত অন্য নেতারাও বুঝতে পারছেন— মমতা শুধু
রাজ্যস্তরেই গৃহযুদ্ধের সূচনা করছেন না, নিজের তৈরি দলটাকেও টুকরো টুকরো
করে ফেলার পথে এগোচ্ছেন। সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত
রায়দের মতো পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদরা জানেন, ওই কানাগলি থেকে বেরোবার পথ
কোনটা। কিন্তু কথা শুনবে কে? মুখ্যমন্ত্রী নিজেই যে সবজান্তা ভুইফোড়। অতএব
কালবোশেখির ঝড় তোলার আগে থমথমে আবহাওয়ার মতো নির্বাক হয়ে আছেন ওই সব
নেতৃবর্গ। এমনকী রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র হাড়ে হাড়ে বুঝছেন,
পশ্চিমবঙ্গ হাঁটছে এক চরম। পরিণতির দিকে যা কালি মাখাবে তার মতো দক্ষ এক
প্রশাসনিক কর্তার মুখেও। ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে অতি দ্রুত প্রাসঙ্গিকতা
হারাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ, বাঙ্গালি। দায়। একজনেরই তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এক ভয়াবহ অভিশাপ
তিনি কেউটের মতো মারণ ছোবল দিতে প্রস্তুত। বাঙ্গলা এবং বাঙ্গালিকে নিয়ে এত
ব্যঙ্গ, সোশ্যাল মিডিয়ায় এত ট্রোল হতে দেখা গিয়েছে কখনও? কখনও দেখেছেন
কোনও মুখ্যমন্ত্রীকে ব্যঙ্গের তীব্রতায় টয়লেট সংস্কৃতিতে নামিয়ে আনা
হয়েছে? দেউলিয়া হয়ে গেছেন মমতা। দেউলিয়া হয়ে গেছে বাঙ্গলা।
বাঙ্গালিকেও যাতে দেউলিয়া হতে না হয়, তাই বিজেপি-র হাত ধরে বাঁচতে চাইছে
বাঙ্গালি। রেহাই পেতে চাইছে নিজেদের কৃতকর্মের পাপভোগ থেকে। কারণ এই
বাঙ্গালিই তো ভালোবেসে ক্ষমতায় এনেছিল ‘সততার প্রতিমূর্তি’-কে!
মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়ই সম্মান কেড়েছেন। কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার রাজীব
কুমারের, পুলিশকর্তা অর্ণব ঘোষের। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলাবাজির
রাজনীতির জন্যই শাসকদলের কর্মীদের হাতে বেধড়ক মার খেয়ে হাতপাতালের
শয্যায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন সন্দেশখালির বিডিয়ো কৌশিক ভট্টাচার্য।
ইটের ঘায়ে পুলিশের মাথা ফাটছে, লাঠির ঘায়ে মহিলা পুলিশের পা ভাঙছে। ফলত,
সারা রাজ্যে নজরানা নেওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাজার হাজার
ভাই-ভাইপোদের পুলিশও আর প্রোটেকশন দেবে না। এখন গৃহযুদ্ধের শিকার তৃণমূল
কংগ্রেস কর্মীর মা-বোন-ভাইদেরও মুখোমুখি হতে চাইছেন না মুখ্যমন্ত্রী। কারণ
তারাই প্রশ্ন তুলছেন পুলিশের সামনেই বিরোধী পক্ষ বা দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে
মরতে হলো কেন তাঁদের স্বামী, দাদা বা বাবাকে।
মমতার ব্র্যান্ড ইমেজ
ফিনিশ। চারশো কোটি, হ্যা চারশো কোটি টাকা নজরানা নিয়ে প্রশান্ত কিশোর এক
বোধহীন অস্থির মস্তিষ্কের অসভ্যতাকে কোন ফেভি-কুইক দিয়ে জুড়বেন? পচে
গেছেন মমতা। গোটা শরীরে গ্যাংগ্রিন। কত আর ছাঁটবেন প্রশান্ত ? গোটাটাই ফেলে
দিতে হবে ভাগাড়ে।
বাঙ্গলার মানুষ হাত ধরবে নতুন বিকল্প এবং একমাত্র
বিকল্প বিজেপির। এটাই সত্য। এটাই বাস্তব। এটাই ভবিতব্য। প্রশান্ত ভূষণও
বুঝে যাবেন শীঘ্রই।
সুজিত রায়
2019-06-24