পূর্বতন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন কেনেডি যতই বলুন যে পরাজয় বাস্তবে
একটি অনাথ শিশু মাত্র, তার পিতৃত্ব বা মাতৃত্বে কেউই আগ্রহী নয়। তবুও এই
অনাথ কিন্তু একজন অতি উর্বর পিতা হবার ক্ষমতাধর। পরাজয় জন্ম দেয় ব্যাপক
দোষারোপের। ২০১৪ ও ২০১৯-এ পর পর কংগ্রেস দলের লোকসভায় দুটি পরাজয়ে
যাবতীয় দোষের ভাণ্ডার নেহরু-গান্ধী পরিবারের দরজায় গিয়েই জমা হচ্ছে। এই
অবস্থায় দৈবক্রমে মঙ্গলগ্রহের কোনো অধিবাসী যদি ২৩ মে-র পর আমাদের এখানে
এসে পড়েন তিনি দেখবেন— একটি শতাব্দী প্রাচীন দল যা ভারত ইতিহাসের নির্মাণে
উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল সেই দলটিকে একটি অসৎ ও কুচক্রী পরিবার কেমন
কুক্ষিগত করে ফেলেছেন।বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না আমার ধারণা কংগ্রেস
কর্মীরা চাকরবৃত্তিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তারা জানেন যে তাদের শৃঙ্খলে
বেঁধে রাখা হয়েছে। কিন্তু তাঁরা ইতিমধ্যে শৃঙ্খলটিকেই ভালোবাসতে শিখে
ফেলেছেন। গান্ধী পরিবার যে তাদের শেকল দিয়ে বেঁধে দাস বানিয়ে রেখেছে
এটাকে তারা অত্যাচার নয়, বরং এক ধরনের সৌজন্য বলে মনে করে। এই পরিস্থিতিটি
আমাকে পুরনো দিনের ধ্রুপদী চলচ্চিত্র ভি শান্তারামের ‘দো আঁখে বারো হাত’
-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। ছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্র এক জেলর। যে ভূমিকায়
নেমেছিলেন শান্তারাম স্বয়ং। এই আদর্শবাদী জেলর ভদ্রলোক ৬ জন দুর্ধর্ষ
কয়েদিকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আনার চেষ্টায় তাদের খোলা জেলে রেখেছিলেন।
তিনি ভেবেছিলেন কায়িক পরিশ্রম, খেলাধুলো ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের মধ্যে
ন্যায়পরায়ণতা ও স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত হতে পারে। কিন্তু কায়িক পরিশ্রম
ও ন্যায়পরায়ণতার বিষয়টা মেনে নিলেও স্বাধীন জীবনের ব্যাপারটা কয়েদিদের
আদৌ হজম হচ্ছিল না। এই কয়েদিরা ইতিপূর্বে দীর্ঘদিন জেল খেটেছিল। তারা
বন্দিদশাতে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থাতেই বেশি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। এখন পরিবর্তিত
পরিস্থিতিতে চেন-খোলা অবস্থায় তারা রাতে কিছুতেই ঘুমোতে পারছিল না। তারা
গোপনে নিজেদের চেন দিয়ে বেঁধে ঘুমোতে শুরু করল। ঠিক এই প্রতি তুলনাটিই মনে
আসে নেহরু-গান্ধী পরিবারের শৃঙ্খলাবদ্ধ অনুরাগীদের দেখে। বরাবর এই তথাকথিত
প্রথম পরিবারটির নির্দেশে মাঠে ঘাটে চরতে অভ্যস্ত এই শ্রেণী অন্য কোনো
মেষপালকের অধীনে চলতে অস্বোয়াস্তি বোধ করে।
এই সূত্রে প্রবীণ কংগ্রেসি
পি চিদাম্বরম সম্প্রতি অত্যন্ত আবেগ প্রবণ হয়ে রাহুল গান্ধীকে ইস্তফা
দেওয়া থেকে নিরস্ত করতে লেগে পড়েছিলেন। অনেকের মনে পড়বে ১৫ বছর আগে ২০০৪
সালে যখন সোনিয়া গান্ধী ঘোষণা করেছিলেন তিনি প্রধানমন্ত্রী পদ গ্রহণ করতে
চান না (তার বহু কারণ ছিল সে সব অন্য প্রসঙ্গ) তখন বহু প্রবীণ পার্টিকর্মী
নাকি কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাঁরা তাঁকে মত বদলাবার
ভিক্ষা চেয়েছিলেন। তারা কল্পনাও করতে পারছিলেন না কী করে পরিবারের বাইরের
কেউ সর্বোচ্চ আসনে বসতে পারে। এখানে বলা নিশ্চিত প্রয়োজন যে একথা মোটেই
ঠিক নয় যে অতীতে পরিবারের বাইরে থেকে আসা কোনো অ-গান্ধী কংগ্রেস সভাপতি বা
প্রধানমন্ত্রী দেশকে সঠিক নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
লালবাহাদুর
শাস্ত্রী তাঁর নাতিদীর্ঘ সময়সীমায় জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে
যথেষ্ট পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। আর নরসিমহা রাও তো ছিলেন বিশাল এক
নেতা। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের চোখে এঁরা আদৌ তা ছিলেন না। তাদের মতে তো
কেবলমাত্র গান্ধী পদবিধারীই একমাত্র সর্বোচ্চ পদের সত্ত্বাধিকারী।
সব
থেকে অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে। এই ধরনের চিন্তাধারা দলের মধ্যে যথেষ্ট
উচ্চশিক্ষিত ও কুশলী সদস্যরাও সমানভাবে অনুসরণ করেন। চাকরবৃত্তির প্রতি
তাদের এমনই মোহ যে তাঁরা তাঁদের থেকে বহু অংশে কম পারদর্শী ও অভিজ্ঞতায়
বহুলাংশে নীচের স্তরে রয়েছেন এমন লোকেদের আদেশ মাথা পেতে পালন করেন যদি
সেই ব্যক্তির নামের শেষে গান্ধী পদবিটা ঝুলে থাকে। এই বিকৃত আকর্ষণ এমন
একটা স্তরে এসে পৌঁছেছে যে মানুষের মধ্যে বিশেষ করে রাজনীতি ক্ষেত্রে ওপরে
ওঠার ইচ্ছেটাকেও নষ্ট করে দিয়েছে। শুধু তাই নয় এঁরা আজ দূর কল্পনাতেও
ভাবতে পারেন না যে তারা কোনো দিন উঁচু পদে পৌঁছবেন। তাদের কাছে এটা ধ্রুব
সত্য যে দেশের গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি পরিচালনার একমাত্র অধিকার গান্ধীদের।
সাম্প্রতিক
নির্বাচনে দলের বর্তমান নেতৃত্ব যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে তা আজ দিনের
আলোর মতো স্পষ্ট। দেশের কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল সহ ১৮টি রাজ্যে কংগ্রেস দল ১টি
আসনও পায়নি। বাস্তবে কয়েকমাস আগে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও
ছুটকো ছাটকা কয়েকটা জায়গায় সফল হওয়া ছাড়া দল সারা ভারতে মুখ থুবড়ে
পড়েছে।
এত কিছুর পরেও কংগ্রেসি নেতারা নেহরু-গান্ধী পরিবারের বাইরে আর
কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। তারা ভাবছেন প্রিয়ঙ্কা বটরাকে আর একটু আগে আনলে কি
ভালো হতো? নাকি তাকেই সরাসরি পরিবারের প্রথম উত্তরাধিকারী বলে ফতোয়া
দিয়ে দিলেই কেল্লা ফতে হতো?
অবশ্য ভারতে এই পরিবারতান্ত্রিক শাসন নিয়ে
শুধু কংগ্রেসকে দোষ দেওয়াটা ঠিক নয়। প্রায় প্রত্যেকটি দলই এখানে এক
একটি পারিবারিক উদ্যোগ। উলটো দিকে এর অন্যথা খুঁজতে গেলে আবার একদিকে অতি
ক্ষুদ্র আর একদিকে অতিকায় দুটি মেরু দেখা যাবে। এক বামপন্থী দলগুলি
অন্যদিকে বিশাল ভারতীয় জনতা পার্টি। ইতিমধ্যে বর্ষীয়ান বিজেপি নেতাদের
পুত্র কন্যারা অনেকেই রাজনীতি ক্ষেত্রেও নজর কেড়েছেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে
কেউই কেবল বংশ কৌলিন্যের গুণে দলের সর্বোচ্চ পদে পৌঁছননি। বামপন্থীদের
ক্ষেত্রেও কথাটা খাটে তা সে তাদের আদর্শের মধ্যে যতই ভুল ত্রুটি থাকুক না
কেন। আদর্শ ভিত্তিক দল হলেই সেখানে সর্বদাই ব্যক্তির চেয়ে দলের আদর্শই
শিরোধার্য করা হয়।
সব কিছু মেনে নিলেও দেশের প্রাচীনতম দলের সমর্থকদের
এমন অপরিবর্তনীয় ভাবে চিরকালীন দাসত্ববাদের অঙ্গীকার করে যাওয়াটা কেমন
যেন আধিভৌতিক মনে হয়। তাদের আচরণের মধ্যে একটি নতুন তত্ত্বমাথাচাড়া দেয়।
যেমন একজন মানুষের মধ্যে যদি কোনো মুক্ত চিন্তক বেঁচে থাকেন, যদি প্রচলিত
ধ্যানধারণার বিরোধী কোনো বিপ্লবী বেঁচে থাকেন তাহলে তাদের মধ্যে একটি
ভৃত্যও অবশ্যই টিকে থাকবেন। এখন বাস্তব পরিস্থিতি ও মতামতের স্বাধীনতা
কতদূর প্রকাশিত হতে পারে এমন একটা আপাত নিরপেক্ষ পরিস্থিতির ওপরই নির্ভর
করবে মুক্তমনা ক্ষমতা ভোগ করার অধিকার পাবে নাকি বিক্ষুব্ধ মতাধিকারী সেই
অধিকার পাবে নাকি আদতে সেই ভৃত্য মানসিকতার সমর্থকের ওপরই ক্ষমতা ন্যস্ত
হবে। হ্যা, কংগ্রেস দলে নেহরুর পর থেকে শেষ তথা প্রধান পঙতিতে থাকা ভৃত্য
ঘরানার মানুষের ক্ষেত্রেই ক্ষমতার শিকে ছিঁড়বে।
দলের অভ্যন্তরীণ আবহ ও
পরম্পরার চাপ কংগ্রেস দলকে দীর্ঘদিন ধরেই নেহরু গান্ধী পরিবারের এক ধরনের
মহিলা-ভৃত্যের ভূমিকায় নামিয়ে এনেছে। অন্যদিক থেকে এই প্রথা দেশের গৈরিক
দলটিকে কিন্তু অন্যভাবে প্রভাবিত করেছে। বিজেপিতে বংশবাদের মারাত্মক
ইনফেকশন দাঁত ফোটাতে পারেনি। কিন্তু দলীয় প্রধানের কাছে নতজানু হওয়ার
সংস্কৃতি সব দলেই দিব্যি বলবৎ আছে। ১৯৮৫ সালে চালু হওয়া দলত্যাগ বিরোধী
আইন দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তাদের দলীয় প্রধানদের কাছে নিতান্তই
নতমস্তক করে রেখেছে। বাদানুবাদের জায়গা দখল করেছে নির্ভেজাল আনুগত্য।
এর
পরিণতি হয়তো সকলেরই নজরে পড়েছে। নেহরুর অনেক অনুরাগী ছিল। ইন্দিরার ছিল
স্তাবক বাহিনী। নরেন্দ্র মোদীর রয়েছে বিশাল ভক্তের দল। একটু সময় লাগলেও
বাজপেয়ী-আদবানী জমানায় তৈরি হয়েছিল একটি ‘হাই কম্যান্ড’।
যাইহোক,
কংগ্রেস নেতারা কায়মনোবাক্যে নিজেদেরকে ভৃত্যবৃত্তির কাজে নিযুক্ত
রেখেছেন। সবদেশেরই গল্প। কথার আছে— একজন বন্দিনীকে ঝকঝকে অস্ত্রধারী এক বীর
সৈনিক এসে তার বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গেল। কিন্তু হায়! এমন কোনও
বীর কি পৃথিবীতে জন্মেছেন যে এমন এক বন্দিনীকে শৃঙ্খলমুক্ত করবে যে
বন্দিনী নিজের শৃঙ্খলকে ভালোবেসে ফেলেছে।
রবিশঙ্কর কাপুর
(লেখক টাইমস পত্রিকার কলামিস্ট)
2019-06-23