২৮ মার্চ ১৮৯৭ দক্ষিণ কলকাতায় কলেরা দেখা দিয়েছে। ১২ জুন ১৮৯৭ বাংলার সর্বত্র প্রবল ভূমিকম্প— মৃত ১৩৫ জন। কলকাতায় স্কুলের ছাত্রীরা ভয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। ৩০ জুন টালা অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯ জন নিহত ও আহত। ২০ অগস্ট পিজি হাসপাতালে স্যর রোনাল্ড রস আবিষ্কার করলেন ম্যালেরিয়া রোগের কারণ এনোফিলিস মশা। ১৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার হাওড়া মিউনিসিপ্যালিটিকে প্লেগ প্রতিরক্ষার্থে ২২,০০০ টাকা দিলেন।
বলে রাখা ভাল একই বছরে (২০ ফেব্রুয়ারি) স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্ববিজয় করে দেশে ফিরলেন। তবে শরীর ভাল নয়। আমেরিকার ডাক্তাররা যা বুঝতে পারেননি, কলম্বোর ডাক্তাররা তাঁর ডায়াবিটিস ধরে ফেলেছেন। শিয়ালদহ রেল স্টেশনে বিশ হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন সেই শুক্রবারে ঘরের ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে। শহরের বৃহত্তম নাগরিক সংবর্ধনায় স্বামীজি বললেন, উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত… কলকাতার যুবকগণ ওঠো, জাগো, কারণ শুভমুহূর্ত এসেছে।
অনেক বড়বড় ব্যাপার ঘটে গেল আমাদের এই শহরে, তার মধ্যে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা এবং মানসকন্যা নিবেদিতার কলকাতায় আগমন, কলকাতা বন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা করলেন স্বামীজি ২৮ জানুয়ারি ১৮৯৮। তার কয়েকদিন পরেই মঠ আলমবাজার থেকে বেলুড়ে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে স্থানান্তরিত হল। ১১ মার্চ স্টার থিয়েটারে মার্গারেটকে এদেশের সুধীজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ— নিবেদিতা বললেন ইউরোপে ভারতীয় আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রভাব সম্পর্কে। কয়েকদিন পরেই ডাক্তারদের পরামর্শে ভগ্নস্বাস্থ্য স্বামীজি দার্জিলিং গেলেন বিশ্রাম নিতে (৩০ মার্চ ১৮৯৮)।
‘ইতিহাসের দিনলিপি’ বলছে এপ্রিলের শেষভাগে ‘কলকাতায় প্লেগের প্রকোপ’। মহামারির সংবাদে বিচলিত হয়ে স্বামীজি কলকাতায় ফিরে এলেন (৩ মে) এবং পরের দিন থেকে “নিবেদিতার সঙ্গে সেবাব্রতে নিযুক্ত হলেন।” তার আগের দিন ৩ নং ওয়ার্ডের করদাতাদের সভা, আলোচ্য বিষয়— প্লেগ প্রতিরোধ। পরিস্থিতি যখন জটিল, তখন পৌরসভার সাফাইকর্মীদের ধর্মঘট, তবে ৬ মে তাঁরা কাজে যোগ দিলেন এবং সরকারের ঘোষণা— কলকাতার প্লেগ “প্রায় আয়ত্বে”।
কিন্তু ১৩ মে ১৮৯৮ কলকাতায় আবার প্লেগ শুরু হওয়ার রিপোর্ট— প্লেগের আতঙ্কে কলকাতা জনশূন্য— সমস্ত রঙ্গমঞ্চ বন্ধ— স্টার বন্ধ থাকে ৪০ দিন। ২০ মে পরিস্থিতি জটিল, প্লেগে আতঙ্কিত সাফাই কর্মীরা আবার ধর্মঘট করল। ২৮ মে বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সে পুলিশ কমিশনার মিস্টার জেমসের উপস্থিতিতে প্লেগ নিয়ে বিশেষ আলোচনা। জুলাই মাসের রিপোর্ট লাটসায়েব স্যর জন উডবার্ন বিভিন্ন প্লেগ হাসপাতাল পরিদর্শন করছেন এবং ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের এক সভায় বললেন, প্লেগকে বিদায় জানাবার সময় এসেছে।
এই সময়েই অমৃতবাজার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ‘প্লেগ প্রহসন’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে— “মৃত্যুবিভীষিকা নিয়ে রঙ্গ করার বাঙালি-মানস এতে প্রতিফলিত হয়েছে।” ১৮ অক্টোবর উত্তর ভারত থেকে আকস্মিকভাবে বেলুড়ে ফিরলেন স্বামী বিবেকানন্দ, শরীর ভাল নয়, তাঁর চিকিৎসক ডাঃ আরএন দত্তের চেম্বারে।
৯ ডিসেম্বর ১৮৯৮ বেলুড় মঠের উদ্বোধন— শ্রীরামকৃষ্ণের চিতাভস্ম মাথায় করে নিয়ে এলেন নতুন মঠে স্বামীজি। পরের মাসেই লর্ড কার্জন বড়লাটের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। সময় ভাল নয়, ৭ মার্চের (১৮৯৯) রিপোর্ট কলকাতায় আবার প্লেগ শুরু হয়েছে। “এদিনে মৃত ৯৫ জন।”
একটু ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে আমরা দেখি মঠমিশনের সেবাকার্যের প্রথম পুরুষ স্বামী অখণ্ডানন্দের মহুলা, মুর্শিদাবাদ থেকে চিঠি (২৪ জুন ১৮৯৭), “স্বামীজি এককালীন ১০০ টাকা দিয়াছেন… আমরা প্রতিদিন প্রাতে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের বয়োক্রম অনুযায়ী চাউল বিতরণ করিয়া থাকি। চাউলের দর এখানে প্রায় পাঁচ টাকা মণ বিক্রয় হইতেছে।… ১৫ই মে হইতে আজ পর্যন্ত প্রায় দেড় মণ চাউল বিতরিত হইতেছে।” তার পর স্বামীজির উল্লেখ, তাঁর আদেশে বন্ধুবান্ধবদের জানানো হচ্ছে তাঁরা যদি কিছু আর্থিক সাহায্য করেন, তা হলে “আমরা দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবা করিতে কখনই আলস্য করিব না।” অখণ্ডানন্দের আর একটি চিঠি (জুন ১৮৯৮)— “এই আশ্রমে ৮টি অনাথ বালক আছে,… দিন গেলে ৬ সের চালের খরচ… আমি এখানেও কিছু ভিক্ষা করিয়া সংগ্রহ করিতেছি, আপনি যদি এ সময়ে কিছু সাহায্য করেন ত বড়ই উপহার হয়।”
মহামারি নিয়ে বিবেকানন্দের দুশ্চিন্তা সম্বন্ধে স্বামী অখণ্ডানন্দ কিছু তথ্য দিয়ে গিয়েছেন। সে ১৮৯৮ সালের কথা। “স্বামীজির সঙ্গে দার্জিলিং-এ আছি। সকালে দেখি— একেবারে গম্ভীর। সারাদিন কিছু খেলেননা, চুপচাপ। ডাক্তার ডেকে আনা হলো, কিন্তু রোগ নিরুপণ করা গেলো না। একটা বালিশে মাথা গুঁজে রইলেন সারাদিন। তারপর শুনলাম কলকাতায় প্লেগ— তিনভাগ লোক শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে— শুনে অবধি এই। সেই সময় স্বামীজি বলেছিলেন, সর্বস্ব বিক্রি করেও এদের উপকার করতে হবে। আমরা যে গাছতলার ফকির, সেইখানেই থাকব।”
অখণ্ডানন্দ লিখছেন, “দেশের দুঃখ কষ্টের কথা বলতে বলতে স্বামীজি কেমন হয়ে যেতেন। আমি তখন তাঁকে জিগ্যেস করতাম, ভাই কেন দেশ জাগছে না? তার উত্তরে তিনি বলতেন, ভাই, এ যে পতিত জাত, এদের লক্ষণই এই।”
কলকাতায় প্লেগের ব্যাপারে রামকৃষ্ণ মিশনের ভূমিকা সম্পর্কে আমরা স্বামী অব্জজানন্দ লিখিত ‘স্বামীজির পদপ্রান্তে’ বইটির উপর নির্ভর করব। এই বইটি আমার হাতের গোড়ায় রয়েছে।
প্লেগের সঙ্গে যুদ্ধে একেবারে সামনে স্বামীজির প্রিয় শিষ্য স্বামী সদানন্দ। সদানন্দের জন্ম ৬ জানুয়ারি ১৮৬৫ কলকাতার গড়পারে। তিন বছর বয়সে তাঁর পরিবার কাশীর কাছে জৌনপুরে চলে যান। বাংলা অপেক্ষা তিনি হিন্দি ভাল জানতেন। এঁর দাদা অধরচন্দ্র গুপ্তও সন্ন্যাসী। হাতরাশ স্টেশনে স্বামী বিবেকান্দের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ সম্পর্কে অনেকেই জানেন। আমিও বিভিন্ন সূত্রে শুনেছি, সদানন্দ বরাবরই একটু বেপরোয়া এবং দুঃসাহসসম্পন্ন।
প্লেগ প্রসঙ্গে ফেরা যাক। কলকাতায় ফিরে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগান বাড়িতে সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী ও অনুগামীদের নিয়ে স্বামীজি এক সভা করেন এবং বলেন, “দেখো, আমরা সকলে ভগবানের পবিত্র নাম নিয়ে এখানে মিলিত হয়েছি। মরণভয় তুচ্ছ করে এই সব প্লেগ রোগীদের সেবা আমাদের করতে হবে। এদের সেবা করতে, ওষুধ দিতে, চিকিৎসা করতে আমাদের নতুন মঠের জমিও যদি বিক্রি করে দিতে হয়, আমাদের যদি জীবন বিসর্জনও দিতে হয়, আমরা প্রস্তুত।”
রামকৃষ্ণ মিশনের ইতিহাসে বলা হচ্ছে, মহুলায় দুর্ভিক্ষ ত্রাণ কার্যের শুরু ১৫ মে ১৮৯৭, তার পর দেওঘর এবং দিনাজপুর। এর পর মহুলার অনাথ আশ্রম। এর পরেই কলকাতার প্লেগসেবা, ১৮৯৮ থেকে ১৯০০। তার পর ভাগলপুর । প্লেগের জন্য যে কমিটি নিযুক্ত হল, তার অফিসার ইন চিফ স্বামী সদানন্দ, প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি বিদেশ থেকে নবাগতা সিস্টার নিবেদিতা। এঁদের সহায়ক স্বামী শিবানন্দ, স্বামী আত্মানন্দ এবং স্বামী নিত্যানন্দ।
১৮৯৮ মে মাসে কলকাতায় প্রথম প্লেগের আবির্ভাব। এই সময় জনসংযোগের জন্য স্বামীজি রামকৃষ্ণ মিশনের এক আবেদনপত্র বাংলা এবং হিন্দিতে তৈরি করেছিলেন। কলকাতার ঘরে ঘরে প্রচারিত এই হ্যান্ডবিল আজও পাঠযোগ্য।
কলকাতার প্লেগে রামকৃষ্ণ মিশনের ভূমিকা সম্বন্ধে কোনও বিস্তারিত আলোচনা দেখেছি বলে মনে হয় না। একটা কথা ঘুরে ফিরে এসেছে— ‘Late relief is no relief’। ত্রাণ কার্যে বিলম্বে হাজির হলে তার কোনও মূল্য নেই। প্লেগের ক্ষেত্রে সন্ন্যাসীরা ঠিক সময়েই শুরু করেছিলেন, কিন্তু প্রথম পর্যায়ে মহামারির প্রকোপ ঝিমিয়ে পড়লেও তা আবার প্রবল হয়ে উঠল ১৮৯৯ সালে এবং ইতিহাস বলছে, গুড ফ্রাইডে ৩১ মার্চ আবার মিশনের সেবাকার্য শুরু হল। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী বিদেশিনী নিবেদিতাকেও ঝাঁটা হাতে পথ পরিষ্কার করতে দেখা গেল।
স্বামী অব্জজানন্দ লিখেছেন, “কলিকাতা নগরীর বস্তিতে বস্তিতে স্তূপিকৃত জঞ্জাল পরিষ্কার করিবার মতন যথেষ্ট সংখ্যক ঝাড়ুদার তখন কলিকাতায় ছিল না— যাহারা ছিল তাহারাও ভয়ে পলায়নপর। স্বামী সদানন্দ ঝাড়ু হাতে শহরের অলিগলিতে আবর্জনা পরিষ্কার করিয়া ফিরিয়াছেন… দুর্গন্ধময় ক্লেদপূর্ণ জঞ্জাল দিনের পর দিন অম্লান বদনে সাফ করিয়াছেন।” পচা নর্দমা বা দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা দেখে প্রফেশনাল সাফাইকর্মী যখন নাকে মুখে কাপড় চাপিয়ে দূরে সরে যেতো, সন্ন্যাসী সদানন্দ প্রসন্নচিত্তে তখন তাদের হাত থেকে ঝুড়ি কোদাল কেড়ে নিয়ে এগিয়ে যেতেন। “সদানন্দ সকলকেই এমনকি ক্লিন শরীর মেথরকেও পরম সমাদর করিয়া আলিঙ্গন দিতেন। কোনো প্লেগরোগী অসহায় অবস্থায় কোথাও আছে শুনলেই, মূর্তিমান সেবার ন্যায় সদানন্দ তাহার শয্যাপার্শে ছুটিয়া যাইতেন— তাহাকে পূর্ণ নিরাময় না করা পর্যন্ত আহার নিদ্রা ত্যাগ করিয়া সেবায় মগ্ন হইতেন।”
সবাই এখন স্বীকার করেন যে মঠ মিশনের সেবাকার্যের ইতিহাসে সদানন্দ ‘চিরস্মরণীয়’। শুনেছি, সন্ন্যাস গ্রহণকালে সদানন্দ স্বামীজিকে বলেছিলেন, “স্বামীজি, যদি আমার পতন হয়?” স্বামীজি তৎক্ষণাৎ বলেছিলেন, “হাজার পতন হোক কিছু এসে যায় না। আমারই সে দায়িত্ব, আমিই তোমাকে বেছেছি। তুমি আমাকে বাছোনি।”
১৮৯৯ তে কলকাতায় প্লেগের কিছু বিবরণ হাতের গোড়ায় রয়েছে।
১৭ এপ্রিল ১৮৯৯— ইমামবাগ লেনে সিইএসসির বিদ্যুৎ কলকাতায় এল।
২৬ এপ্রিল— কলকাতায় প্লেগ চলছে, এদিন ১৪ জন আক্রান্ত হয়, মৃত ১৭ জন।
৪ জুন— বাগবাজারে শ্রী শ্রী মায়ের আশীর্বাদ নিতে এলেন বিবেকানন্দ, বিদেশ যাত্রার আগে।
৭ জুন— দু’ জন প্লেগ রোগী পাওয়া গিয়েছে। মৃত্যু নেই।
১৩ জুন— ১৩ জন প্লেগে আক্রান্ত।
৪ জুলাই- ৮ নং ওয়ার্ডে একজন প্লেগ রোগী পাওয়া গিয়েছে।
২০ জুলাই— বড়বাজার অঞ্চলে একজন প্লেগ আক্রান্ত, একজন মৃত।
২ আগস্ট— প্লেগ রোগী ভর্তি হল আটজন এবং মৃত ন’জন।
৬ সেপ্টেম্বর— পাঁচজন নতুন রোগী, মৃত পাঁচ জন।
১৪ সেপ্টেম্বর— তিনজনের মৃত্যু সংবাদ, নতুন রোগী নেই।
১৭ সেপ্টেম্বর— প্লেগে দু’জন মৃত, দু’জন রোগী ভর্তি।
অক্টোবরে প্লেগের প্রকোপ যেন বাড়ছে— বেশ কিছু মৃত্যুর রিপোর্ট রয়েছে, ৩১ তারিখে পাঁচ জন নতুন ভর্তি, পাঁচ জন মৃত। পরের মাসে ২০ তারিখের রিপোর্ট, প্রকোপ বাড়ছে, ভর্তি ও মৃত দুই ১১ করে। ডিসেম্বরেও প্লেগ চলছে, ৫ তারিখেই মৃত ৭ জন, নতুন ভর্তি ৭ জন।
নতুন বছরের (১৯০০) গোড়ায় স্মলপক্সের দাপট— শুরু হল সবাইকে স্মলপক্সের টিকে দেওয়া— কমিশনার থেকে পাহারাওয়ালা পর্যন্ত। মার্চ মাসের রিপোর্ট: প্লেগ চলছেই। ৮ মার্চ ১১৮ জন নতুন ভর্তি হয়। নতুন বছরে প্লেগ-মৃতের সংখ্যা ৯৭। ১৩ মার্চের প্রতিবেদন— ‘‘প্লেগের পরিসংখ্যান মারাত্মক। ১২৭ জন নতুন ভর্তি হয়েছে। মৃত ১২ জন।’’ ২২ মার্চ লর্ড উডবার্ন প্লেগ-বিধ্বস্ত বিহার দেখতে বেরুলেন, মাসের শেষে কলকাতার রিপোর্ট: ‘এখন পর্যন্ত এ বছরে কলকাতায় মৃত ১০৭ জন।’ তবু মাসের শেষে বড়লাট সদলে শিমলা যাত্রা করলেন।
৬ এপ্রিল ১৯০০ কলকাতায় মারা গেলেন ১০৯ জন, কাগজের রিপোর্ট— এ বছরে মৃত ৩৮৭ জন। মাসের শেষে (২৮ এপ্রিল) অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হল স্বামী সদানন্দের বিস্তারিত রিপোর্ট। এই রিপোর্ট পাঠের সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে এই সময় সংবাদ প্রতিবেদন— ‘প্লেগে মৃত্যুর হার কমছে।’ তবে স্বস্তির উপায় নেই— সরকারের বিবৃতি (১৩ জুলাই) সারা বাংলায় ‘মারাত্মক ধরনের ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে পড়েছে।’ কিন্তু পরের মাসেও কলকাতায় প্লেগের মৃত্যু অব্যাহত। প্রতিদিন গড়ে এক জন মারা যাচ্ছেন। নভেম্বরের তিন তারিখের রিপোর্ট নতুন রুগী ১৮ জন, প্লেগে মৃত ২০ জন।
নভেম্বর ১৯০০— আনন্দ সংবাদ। ৮ তারিখে সব পত্রপত্রিকা জানাচ্ছে, ‘‘গত দশ দিন কলকাতায় নতুন প্লেগরুগী পাওয়া যায়নি।’’
মঠ মিশনের খবর কমতি নয়। ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯০১ বেলুড় মঠের ট্রাস্ট ডিড রেজিস্টারি হল এবং তিন দিন পরে ট্রাস্টি বোর্ডের প্রথম অধিবেশনে স্বামী ব্রহ্মানন্দ দু’বছরের জন্য সভাপতি মনোনীত হলেন।
আমাদের প্রিয় কলকাতা তখন বিপদমুক্ত হয়নি, তার প্রমাণ ১লা জুলাই শহরে আবার দু’টি প্লেগ রোগী পাওয়া গেল। কিন্তু এর পরে কাগজে প্লেগের খবর তেমন চোখে পড়েনি, বোধ হয় চার্নক নগরী প্লেগ মুক্ত হল। ছ’ মাস পরে অপ্রকাশিত বড় খবর, এমকে গাঁধী, কংগ্রেস অধিবেশন চলাকালে বেলুড় মঠে যান কিন্তু বিবেকানন্দ মঠে না থাকায় দেখা হয়নি।
সন্ন্যাসীরা সদানন্দের নেতৃত্বে মহানগরীর সব চেয়ে দুঃখের দিনে জীবন-মৃত্যুকে কী ভাবে পায়ের ভৃত্য করেছিলেন তা আজও আমাদের জানা নেই। স্বামী দেবেন্দ্রানন্দ ছোট্ট একটি বইয়ে প্রত্যক্ষদর্শী কুমুদবন্ধু সেনের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ‘‘অতি প্রত্যুষে মেথর জমাদার জোগাড় করিয়া তিনি (সদানন্দ) আমাকে ডাকিলেন। কাঠমার বাগানের বস্তি মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটে। বাইরে মুদিখানা, খাবারের দোকান ইত্যাদি। ভিতরের দৃশ্য ভয়াবহ দুর্গন্ধময় আর দারিদ্র শ্রমজীবীদের দারুণ দারিদ্রের চিহ্ন পরিলক্ষিত হইয়াছিল। যেদিকে উৎকট দুর্গন্ধ, গুপ্ত মহারাজ সেইখানে আমাকে ডাকিয়া লইলেন।’’ বস্তির সংলগ্ন খালি জমিতে স্তূপাকার আবর্জনা, পাশেই দোতলা-তিনতলা বাড়ি। গুপ্ত মহারাজ ক্রোধ প্রকাশ করে হিন্দিতে বললেন, ‘‘দেখেছ ভদ্রসমাজের কাণ্ড। এইসব রোগের বীজ এই গরীবদের বাসস্থানে ফেলে মহামারীর বীজ ছড়াচ্ছে। প্লেগ, বসন্ত, কলেরা যতকিছু ব্যারাম এই আবর্জনা পচে হয়।’’
এই সময় সাফাই কর্মীরা জঞ্জাল পরিষ্কার করতে অসম্মতি জানায়। মাথায় কাপড় বেঁধে সন্নাসী সদানন্দ বললেন, ‘বেশ ভাইয়া, তোমরা বসে বসে দেখ, আমি সাফাই করছি।’ তাঁকে সাফাই করতে দেখে কর্মীরা বললেন, ‘বাবাজি-মহারাজ, আমাদের ক্ষমা করুন, আমরা সব পরিষ্কার করছি।’
শ্রমজীবীদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ সদানন্দ সেদিন যুবক কুমুদবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘দেখেছ, ভদ্রলোকদের চেয়ে এদের প্রাণ কত তাজা।… এসো আমরা দাঁড়িয়ে থাকি কেন, রোগজীবাণুনাশক ওষুধগুলি বালতিতে গুলে ছড়িয়ে দিই।’
প্লেগ সম্পর্কে আবেদনপত্রটি স্বামীজির নির্দেশে দু’ দিন ধরে সিস্টার নিবেদিতা প্রথমে ইংরেজিতে তৈরি করেছিলেন, তার পর এই ঘোষণাপত্রটি বাংলা ও হিন্দিতে অনূদিত হয়। এ খবর আমরা পাচ্ছি প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণার নিবেদিতার জীবন কথা থেকে। এই লেখায় বলা হচ্ছে, প্লেগের সব ব্যবস্থা পাকা করে সদানন্দ ও নিবেদিতাকে নিয়ে স্বামীজি আলমোড়া যাত্রা করেছিলেন, ১১ মে ১৮৯৮।
করোনা আক্রমণের কথা ভাবলে, স্বভাবতই মন বহু যুগ আগের প্লেগাক্রান্ত কলকাতায় চলে যায়। তবে মনে হয় দু’লক্ষ মানুষের শহরে প্লেগের প্রকোপ ছিল আরও ভয়ঙ্কর। আরও সর্বনাশা। সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ মানবসেবার যে মন্ত্র উচ্চারণ করলেন তা-ও দুঃসাহসিক। নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে মৃত্যুমুখর কলকাতায় রামকৃষ্ণ মঠমিশনকে এক অনন্য বিশিষ্টতা দান করল ভারতসভায় এবং বিশ্বসভায়।