নভেম্বরেই সতর্ক করেছিলেন বিজ্ঞানীরা, তবু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্র!

ব্রিটেনের অভিজ্ঞতা দেখে গত নভেম্বরেই বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, ভারতে করোনা সংক্রমণের আরও মারাত্মক দ্বিতীয় ধাক্কা আসতে চলেছে। বিরোধীদের অভিযোগ, ওই সতর্কবার্তা সত্ত্বেও পরিকাঠামোগত উন্নতির দিকে কেন্দ্রের মনোযোগ না-দেওয়ার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে দেশবাসীকে। দেশের প্রায় প্রতিটি হাসপাতালে স্থানাভাব, অক্সিজেনের অভাব, জীবনদায়ী ওষুধের ঘাটতি। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন ও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিব রাজেশ ভূষণের পদত্যাগ দাবি করেছেন কংগ্রেস নেতা
পি চিদম্বরম।

করোনার বিরুদ্ধে লড়াই কার্যত শূন্য থেকে শুরু করলেও নরেন্দ্র মোদী সরকারের হাতে এক বছরের বেশি সময় ছিল। কিন্তু ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বা গোষ্ঠী সংক্রমণের উপরে সরকারের ভরসা এবং অতিরিক্ত প্রতিষেধক-নির্ভরতার কারণে পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে চলে গিয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তাঁরা বলছেন, গত নভেম্বর থেকে যখন সংক্রমণের হার কমতে শুরু করেছিল, তখন জনতা যেমন কোভিড সতর্কবিধি মেনে চলা ছেড়ে দেয়, তেমনই গা-ছাড়া মনোভাব দেখা যায় স্বাস্থ্য মন্ত্রকেও। অথচ গত বছর আইসিএমআর-এর সেরো সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, দেশের জনসংখ্যার প্রতি পাঁচ জনে এক জন কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। অর্থাৎ বাকি চার জনের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা তখনই ছিল। আইসিএমআরের এক বিজ্ঞানীর মতে, ওই গবেষণা থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, দেশের ১৩৪ কোটি মানুষের মধ্যে
প্রায় একশো কোটির দ্বিতীয় ধাক্কায় করোনা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সরকারের উচিত ছিল, সেই কথা ভেবে চিকিৎসা পরিকাঠামোকে প্রস্তুত করে তোলা।

এর পাশাপাশি, স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও গত নভেম্বরে নিজেদের রিপোর্টে কেন্দ্রকে একাধিক সুপারিশ করেছিল। হাসপাতালগুলিতে অক্সিজেনযুক্ত শয্যা, আইসিইউ শয্যা, ভেন্টিলেটরের সংখ্যা বাড়ানোর উপরে জোর দেওয়া হয়েছিল। সে জন্য স্বাস্থ্য খাতে জিডিপি-র প্রায় ২.৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়েছিল। বড় হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলিতে নিজস্ব অক্সিজেন প্লান্ট গড়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কংগ্রেস নেতা রণদীপ সুরজেওয়ালার অভিযোগ, এ সব কিছুই মানেনি কেন্দ্র। ফলে অক্সিজেনের অভাবে মানুষকে মরতে হচ্ছে। আজ কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম বলেন, ‘‘সরকার কি এত দিন পরে জেগে উঠল? মানুষ আত্মীয়দের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হাতে-পায়ে ধরছেন, অনেকে পিঠে করে অক্সিজেনের সিলিন্ডার বয়ে আনছেন। এই অপদার্থতার জন্য কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিবের কি পদত্যাগ করা উচিত নয়?’’

গত বছর দেশে করোনার সংক্রমণ কমে আসার পরে বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠীর বৈঠকও কমে যায়। এই বছরের গোড়ায় বিজ্ঞানীদের করোনা সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের একটি মাত্র বৈঠক হয়েছে। এর পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, সরকারের কোভিড সংক্রান্ত পরামর্শদাতা গোষ্ঠীর অনেকেই ‘হার্ড ইমিউনিটি’ নীতির পক্ষে ছিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, এ ধরনের সংক্রমণ জনগোষ্ঠীতে ছড়িয়ে না-পড়া পর্যন্ত তা সাধারণ রোগে পরিণত হবে না। তাই প্রবীণদের প্রতিষেধকের আওতায় আনা হোক, যাতে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু কমে যায়। অন্য দিকে অপেক্ষাকৃত তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিজের গতিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে উঠুক, এমন ভাবা হয়েছিল। এই নীতি কিন্তু সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল ব্রিটেন ও সুইডেনে। তা সত্ত্বেও একই নীতিতে ভরসা রেখেছিল সরকার।

এর সঙ্গে রয়েছে টিকা নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতির অভাব। অনেকেই মনে করছেন, ভাঁড়ারে যথেষ্ট প্রতিষেধক না-থাকা সত্ত্বেও বিদেশে প্রচুর টিকা রফতানির ফলে দেশে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। উপরন্তু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দু’টি মাত্র সংস্থার ভরসায় ভারতের মতো দেশে টিকাকরণ শুরুর পরিকল্পনা যথেষ্ট ঝুঁকির ছিল। ফলে এখন যথেষ্ট পরীক্ষামূলক প্রয়োগ না-করেই বিদেশি প্রতিষেধককে ছাড়পত্র দিতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক কর্তার আক্ষেপ, গত ১৫ জানুয়ারি দেশে গণ-টিকাকরণ শুরু হয়েছে। আর কোভিড রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে। অর্থাৎ হাতে এক মাসও পাওয়া যায়নি। অনেকেই দ্বিতীয় ডোজ় পাওয়ার আগে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁর মতে, করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা যদি কয়েক মাস পরে শুরু হত, পরিকল্পনা অনুযায়ী তার আগে যদি প্রথম তিরিশ কোটি দেশবাসীকে টিকার দু’টি ডোজ় দেওয়া সম্ভব হত, তা হলে সংক্রমণের চিত্র এতটা খারাপ হত না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.