মোদী সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি ও আমার প্রত্যাশা

ভেবেছিলাম, নির্বাচনে এতোবড় পরাজয়ের পর ক’টা মাস বিরোধীরা চুপচাপ থাকবে। কিন্তু তা হল না। আর সেই সুযোগ করে দিল ভারত সরকার নিজেই। জাতীয় শিক্ষানীতিতে অ-হিন্দিভাষী রাজ্যে হিন্দি শেখানোর কথা বলে। আর যায় কোথায়। রে রে করে মাঠে নেমে পড়ল সবাই।সরকার তৎক্ষণাৎ ওই কথাটা জাতীয় শিক্ষানীতি থেকে সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আগামী ক’মাস এই নিয়েই বিরোধীরা বাজার গরম করে রাখবে।
এখানে কিন্তু সমস্যাটাকে এড়িয়ে যাওয়া হল। সত্যিই কি হওয়া উচিত ছিল জাতীয় ভাষা শিক্ষানীতি?
শশী থারুর বলেছেন, হিন্দিভাষীদের তো আর অন্য কোনো ভাষা শিখতে হয় না, যত কষ্ট শুধু আমাদেরই! এই যুক্তিটাকে ধরেই কিন্তু সমস্যাটার সমাধান করা যায়। আচ্ছা, তৃতীয় ভাষাটাকে সবার জন্য ঐচ্ছিক রাখা যায় না? সেখানে অ-হিন্দিভাষীরা যেমন হিন্দি শিখবে (এখানে হিন্দি মানে, সংস্কৃতনিষ্ঠ হিন্দি), হিন্দিভাষীরা সেরকম হিন্দি বাদে অন্য কোনো একটা ভাষা শিখবে। উত্তরপ্রদেশের ছাত্ররা শিখবে তামিল, মধ্যপ্রদেশে শেখানো হবে কন্নড়। আর । সবটাই ঐচ্ছিক। পাশ নম্বরের থেকে বেশি। পেলে তা যোগ হবে, পাশের নীচে নম্বর পেলে (বা কেউ যদি ঐচ্ছিক ভাষা না নেয়) কিছু যোগ হবে না। তাহলেই তো ক্ষোভের । কারণের নিরাকরণ হয়ে গেল, তাই না? সবার জন্য সমান নিয়ম।
স্বাধীনতার প্রাক্কালে হিন্দির বদলে সংস্কৃতকে জাতীয় ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা হয়েছিল, যার মূলে ছিলেন। বাংলার মহাপুরুষরা, বিশেষ করে পন্ডিত লক্ষীকান্ত মৈত্র। সেই প্রচেষ্টা মাত্র এক ভোটে হেরে যায়। সেটাকে কি আবার ফিরিয়ে আনা যায় ? সংস্কৃত হলো পৃথিবীর একমাত্র বিজ্ঞানসম্মত ভাষা, যার গভীরতার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে প্রায় সব ভারতীয় রাজ্যই শ্রদ্ধাশীল। সংস্কৃতকে নিজের নিজের মাতৃভাষার মাতৃ স্বরদপা বলে মানে সব রাজ্যই (তামিলনাড়ু বাদে)। তাই সংস্কৃত ভাষার প্রসারে কেউ বেশি বাধা দেবে না। কিন্তু সেই সংস্কৃত শিক্ষা হতে হবে যুগোপযোগী। কঠিন ধাতুরপ শব্দরূপ বাদ দিয়ে সংস্কৃতের রসালো দিকটার আস্বাদন দিতে হবে বিদ্যার্থীদের। এই বিষয়ে ভারত সংস্কৃত পরিষদ অনেক কাজ করেছে। তাদের দশ দিন ও কুড়ি দিনের সংস্কৃত কোর্স দেশে জনপ্রিয়। সেইভিত্তির ওপর সিলেবাস রচনা করতে হবে। আমাদের সভ্যতার হাজার হাজার বছরের উপলব্ধি সঞ্চিত আছে সংস্কৃত ভাষায় রচিত বইগুলোতে। সেগুলো নিয়ে কে গবেষণা করবে? যদি ভারতের বিদ্যার্থীরা সংস্কৃত ভাষাটাই না জানে?
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার আছে। সেই ইংরেজ আমল থেকেই ভুল ইতিহাস পড়ানো হচ্ছে আমাদের। এই প্রবণতা স্বাধীনতার পরে কমেনি, বরং বেড়েছে। একটি বিশেষ ন্যারেটিভকে সমর্থন করার জন্য বিশেষ বিশেষ ঘটনাকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে তো মনগড়া ইতিহাসও লেখা হয়েছে। এর জায়গায় বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস নিয়ে আসতে হবে। ইতিহাস পড়ানোর দুটো ভাগ থাকতে হবে, (১) সত্য ঘটনা ও (২) তার ব্যাখ্যা। একটা উদাহরণ দিই।
স্বাতন্ত্র্যবীর সাভারকরের জীবনী লিখতে গিয়ে তাঁর মুচলেকা দিয়ে আন্দামান থেকে বেরিয়ে আসার ঘটনাটাকে চেপে গেলে চলবে না। সেটা যেমনটা ঘটেছিল, ঠিক তেমনটাই লিখতে হবে। তারপর বলতে হবে :
কেউ কেউ বলেন, এটা তার ইংরেজ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণের প্রমাণ।কিন্তু এর বিরুদ্ধেও মত রয়েছে। তিনি যদি মুচলেকা না দিতেন, তাহলে তাকে আন্দামানেই মেরে ফেলা হতো। তার বদলে তিনি মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে এসে আবার দেশের কাজে লেগেছিলেন। এই সময় দেশের যুবকদের তিনি ইংরেজ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বলেছিলেন। সেই যুবকরাই কিন্তু সুযোগ বুঝে নৌ-বিদ্রোহ করেছিল। যার পরিণতিতে শেষপর্যন্ত ভারত স্বাধীন হয়। এইভাবে উভয় পক্ষের মতামত একজায়গায় দিলে বিদ্যার্থী তার মধ্যে থেকে ঠিকটাকেই বেছে নেবে।
ছোটবেলায় ইতিহাস পড়তে ভালো লাগত না। ইতিহাস মানেই সাল-তারিখ মুখস্থ করা, আর ইতিহাস মানেই পরাজয়ের ইতিহাস। প্রথম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত প্রচলিত পথে ইতিহাস না পড়িয়ে মহামানবদের জীবনীর মাধ্যমে ইতিহাস পড়ানো উচিত। আর সেই ইতিহাস হওয়া উচিত সমগ্র ভারতের ইতিহাস। বিবেকানন্দ থেকে শিবাজী, হরিহর বুক থেকে লাচিৎ বরফকুন, সবার কথাই সমান গুরুত্ব দিয়ে জানতে হবে ভারতের শিশুদের।
প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানচর্চার কথাও জানতে হবে ভারতের শিশুদের। কিন্তু এই বিষয়ে একটা ভুল আমরা প্রায়শই করে। থাকি। গণেশ হলো প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারির প্রমাণ’বা পুস্পক রথ সত্যিই ছিল’ এসব কথা বললে লোক হাসে। প্রতিপক্ষদের সুবিধা হয়ে যায়, আমাদের দুচ্ছাই করতে। এর বদলে এখানেও বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে। পুস্পক রথের কথা প্রথমেই না বলে বলতে হবে শ্রীলংকায় রাবণের প্রাসাদের ধ্বংশাবশেষ সিংহগিরি (সিগিরিয়া)-র কথা। সে প্রাসাদ এখনো আছে। ছ’শ ফুট উঁচু এক খাড়াই প্রস্তরস্তম্ভের মাথার ওপর কয়েক টন ইট, মার্বেল ও গ্রানাইটের স্ল্যাব দিয়ে প্রাসাদ বানানো হল কী করে? কোনো সিড়ি ছাড়া কীভাবেই বা প্রাসাদের বাসিন্দারা প্রতিদিন প্রাসাদ থেকে উঠত নামত? এই প্রসঙ্গটাকে নিয়ে এসে তারপর বলা যেতে পারে রামায়ণে উল্লিখিত পুস্পক নামক এক শঙ্কু আকৃতির বিমানের কথা, যার জ্বালানি ছিল পারদ। এই পরিপ্রেক্ষিতে বললে পুস্পক রথের সম্ভাবনার কথা কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। প্রাচীন ভারতের বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষ নিয়ে বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গবেষণা করছে, তাদের থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে কিন্তু যাই আমরা পড়াই না কেন, তা বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ হতে হবে।
পাশ্চাত্য দেশে দেখেছি, বিদ্যালয় শিক্ষার পর অধিকাংশ বিদ্যার্থীই কারিগরী শিক্ষার দিকে যায়। আমাদের দেশে কারিগরী শিক্ষার প্রচলন বাড়াতে হবে। প্রথম পর্যায়ে প্রতিটি জেলায়, পরে প্রতিটি মহকুমায় কারিগরী শিক্ষার মহাবিদ্যালয় চাই। সেখানে কামার -কু মোর – সোনার থেকে ইলেক্ট্রিশিয়ান-কম্পিউটার মেরামতি— প্রয়োজনমতো সবরকম শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা চাই। এর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা এমন হওয়া দরকার, যাতে দেশের মানুষের প্রত্যক্ষ উপকার হয়। কানাইয়া কুমারের মতো অসংখ্য বিদ্যার্থী আমরা তৈরি করেছি গরিব জনগণের ট্যাক্সের টাকায়, যারা দেশের কোনো কাজে আসেনি। এই ব্যাপারটাকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে, আর সেটা করতে হবে মহাবিদ্যালয় স্তর থেকেই। শিক্ষাকে বাস্তবমুখী করতে হবে।
মহাবিদ্যালয় থেকেই যাতে বিদ্যার্থীরা নতুন নতুন আইডিয়ার রূপায়ণে ও ব্যবসা শুরু করতে উৎসাহী হয়, শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনটি হতে হবে। এ যুগটা আর পুঁজিবাদের যুগ নয়। এখন পুঁজি নয়, আইডিয়াই ব্যবসার সাফল্যের মূল। ভালো আইডিয়া থাকলে, সেই আইডিয়াকে রূপায়ণ করার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলে মুদ্রা লোন পাওয়া কঠিন নয়। কেরানি শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে আগামী প্রজন্মকে উদ্ভাবন-মূলক শিক্ষার দিকে যেতে হবে।
সবশেষে বলি, এটা দেখা গেছে, যেখানে সঙ্ঘের শাখা আছে, যেখানে ব্যায়ামের আখড়া বা মার্শাল আর্টের স্কুল আছে, সে মহল্লায় মস্তানরা একটু সমঝে থাকে। বিদ্যার্থীদের মধ্যে মার্শাল আর্টের চর্চা ও পাড়ার মস্তানদের দাপট হলো বিপরীত আনুপাতিক। দেশ জুড়ে অপরাধের বাড়বাড়ন্ত দমন করার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি, বিদ্যার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে মার্শাল আর্ট শেখানো। বিশেষ করে ছাত্রীদের। মেয়েদের আত্মরক্ষায় সমর্থ করে তোলা জাতির দায়িত্ব।
সংক্ষিপ্ত করে বলতে গেলে, মোদী সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতির থেকে আমার চারটি প্রত্যাশা। প্রথমত, হিন্দিভাষী ও অ-হিন্দিভাষীদের মধ্যে ভাষাশিক্ষার সমান সুযোগ। সরল সংস্কৃত শিক্ষার প্রচলন। দ্বিতীয়ত, বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ইতিহাস, যা শিশু-কিশোর বয়সের উপযোগী। যা বিদ্যার্থীদের মনে দেশের গৌরব ও অখণ্ডতার ভাব জাগায়। প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চা সম্বন্ধে বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান এই সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত হোক। তৃতীয়ত, কারিগরী শিক্ষার প্রসার। জনমুখী, উদ্ভাবন-মূলক ও ব্যবসামুখী হোক মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা। চতুর্থত, বাধ্যতামূলক মার্শাল আর্ট শিক্ষা। দেশের মেয়েদের আত্মরক্ষায় সমর্থ করে তোলা। আশা করব, মোদীজি এই বিষয়গুলো ভেবে দেখবেন। শিক্ষা ব্যবস্থার দু’শো বছরের এই জগদ্দল পাথরটাকে সরিয়ে কিশলয়ের উদগমের পথ করে দেবেন। মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়, এ আশা তো তিনিই জাগিয়েছেন, তাই না?
প্রবাল চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.