কেউ মনে রাখেনি
কেউ মনে রাখেনা
একদিন দেখা গেল থিয়েটারে এসে নাচছেন।
"কী ব্যাপার, পাগল হয়ে গেলেন নাকি ?", সহ অভিনেতা অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় জিজ্ঞেস করলেন।
" হ্যাঁ, পাগল হয়ে গেছি। জান অজিত, চিরকাল ছেঁড়া ফতুয়া, ছেঁড়া গেঞ্জি এইসব পরে পার্ট করেছি।কিন্তু আজ দর্জি আমার মাপ নিয়েছে। "
ঠাট্টা করে অজিত বাবু বললেন, "কীসের মাপ, ল্যাঙোট "?
"না,না, পাঞ্জাবির। সত্যজিৎ বাবুর ঐ বইটা - পরশপাথর , তাতে নাকি আমি হিরো! তার জন্য আমার পাঞ্জাবির মাপ নিলে। সেইটা পরে আমি প্লে করব । "
এত আনন্দ করতে তাঁকে কেউ দেখেনি।
সামান্য একটা পাঞ্জাবি পেয়ে যাঁর এত আনন্দ, তাঁকে এতক্ষণে নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছেন । হ্যাঁ, তিনি অসামান্য অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী।
কম বয়সে পিতৃহীন হওয়ায় দারিদ্র্যের মধ্যেই বেড়ে ওঠার দিনগুলো কেটেছিল। প্রথাগত শিক্ষালাভের সঙ্গতি কোথায়? আশ্রয় পেলেন তাঁর জ্যাঠামশাইর কাছে। তিনি থিয়েটারে তবলা হারমোনিয়াম বাজাতেন। তাঁকে খাবার পৌঁছে দেওয়ার ভার ছিল বালক তুলসীর ওপর। সেই সুবাদে অভিনেতা অভিনেত্রীদের সংস্পর্শে এসে মনের মধ্যে অভিনয়ের ইচ্ছা তৈরী হয়। সাবলম্বী হওয়ার তাগিদে কম বয়স থেকেই বিচিত্র সব কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ঘড়ি সারাইয়ের দোকানে , সার্কাসের দলে, ছাপাখানায়, এমনকি মদের চাটের দোকানে এঁটো থালা গ্লাস ধোওয়ার কাজ করতেও দ্বিধা করেন নি। মনের মধ্যে কিন্তু অভিনয়ের ইচ্ছেটা ক্রমাগত জ্বালাচ্ছিল। অবশেষে জ্যাঠামশাইয়ের হাত ধরে 'স্টার' এর তৎকালীন কর্ণধার অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছে অভিনয় শিক্ষার হাতেখড়ি শুরু হলো।
মঞ্চ ও চলচ্চিত্র মিলিয়ে দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছরের অভিনয় জীবন। ধীরে ধীরে যশ খ্যাতি কিছুটা পেলেও আর্থিক স্বচ্ছলতা পাননি। মূলত পার্শ্বচরিত্র হিসেবেই অবহেলিত থেকে গেলেন। অবশ্য সাড়ে চুয়াত্তর ব্যতিক্রম। কিন্তু ছোট্ট নজরে না আসা সব চরিত্রেও অভিনয় গুণে দর্শকদের নজর কাড়তে ব্যর্থ হতেন না।
অভিনয় জগতে এতটা দীর্ঘ সময় কাটিয়েও মনের সততা, সরলতা, সদানন্দ ভাব হারিয়ে ফেলেননি তিনি। সহ অভিনেতাদের অনেকেই তাঁকে নিয়ে মজা করতেন। একবার ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে বললেন, "তুলসীদা, এন টি স্টুডিও থেকে তোমার নামে কলকার্ড এনেছিল। তোমায় খুঁজে না পেয়ে চলে গেল।" অনুপকুমার বললেন, "শ্যুটিংএর ডেটটা তো কালই বলল।" তাহলে কী হবে ? সবাই বোঝাল ,"কী আবার হবে ? আমরা বলে দিয়েছি তোমাকে জানিয়ে দেব। তুমি কাল সকালে স্টুডিওতে চলে যেও।"
পরদিন স্টুডিওয় গিয়ে শুনলেন যে কলকার্ড পাঠানো হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাঁর নামে নয়। সেখানে তাঁর কোন কাজ নেই। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। হাওড়া থেকে বাসভাড়া খরচা করে এতদূর এসে এই হেনস্থা । সবই বুঝতে পারলেন। জানতে পারলেন যে সেদিন ভক্তিমূলক একটি ছবিতে একটি নগর সংকীর্তনের বড়ো শট নেওয়া হবে। পরিচালককে মিনতি করে বললেন যা হোক একটা কিছু পার্ট দিতে। পরিচালক বললেন কীর্তনের দলে ভীড়ের মধ্যে একজন বৈষ্ণব সেজে তিনি থাকতে পারেন, ঐটুকুই । নিজের সম্মান রাখার জন্য এই অসম্মানের ভূমিকাতেই রাজী হয়ে গেলেন।
মেকআপ নিয়ে যখন স্টুডিওয় এলেন, তাঁকে দেখে পরিচালক মত বদলালেন। বললেন, "তুলসী, তুমি দলের সামনের সারিতে থাকবে।" পরিচালকের হিসেবে ছিল দেড় মিনিটের শট্, সেটা গিয়ে দাঁড়াল চার মিনিটে। কে বলবে ইনি কৌতুকশিল্পী ? হরিনামে বিভোর এক বৈষ্ণব, যার বুক ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে। গোটা শটে কোথাও তাঁকে বাদ দেওয়া গেল না, বরং তাঁরই ক্লোজ আপ নিতে হল। শট্ শেষে পরিচালক তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন।
"তুলসী, তুমি জাত শিল্পী। তোমার অভিনয়ের এই অংশটুকু আমার ছবিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেল।"
কিন্তু তিনি নিজের মূল্য নিজে বুঝতেন না। মাত্র কয়েকজনই তাঁকে তাঁর মূল্য বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। 1957 সালে তরুণ কুমারের প্রযোজনায় "অবাক পৃথিবী"তে তাঁর একটি ছোট চরিত্র, মুদী। একবেলার কাজ। টাকা দেওয়ার সময়ে তরুণ কুমার দাদাকে (উত্তম কুমার) জিজ্ঞেস করলেন তুলসীদাকে কত দেওয়া যায়? তখন তুলসীবাবু দিনপ্রতি কাজের জন্য 125 টাকা পেতেন। উত্তম কুমার বললেন তিনশো টাকা দিতে। তরুণ কুমার টাকা দিতে গেলে তুলসী চক্রবর্তী বললেন, এতো টাকা কেন ভাই , আমি তো এত টাকা নিই না। তরুণ কুমার বললেন, "আমি জানি না, দাদা আপনাকে এই টাকাই দিতে বলেছেন।" তুলসী বাবু সোজা চলে গেলেন উত্তমকুমারের কাছে।
“হ্যাঁরে, আমায় এত টাকা দিলি কেন ?”
উত্তম কুমার বললেন, “তুলসী চক্রবর্তী এক বেলা কাজ করতে রাজী হয়েছে, সেজন্য একটা পার ডে, আর কাজটা করে দিয়েছে, সেজন্য একটা পার ডে।”
তুলসী বাবু বিপন্নমুখে জিজ্ঞেস করলেন, “ও,তা এতে অন্যায় কিছু হবে না তো ?”
উত্তম কুমার বললেন, “অন্যায়ের কী আছে? বুড়োর প্রোডাকশন, বুড়ো দিচ্ছে।”
আশ্বস্ত হয়ে “জয়গুরু জয়গুরু হরিবোল
হরিবোল ” বলতে বলতে তিনি সানন্দে চলে গেলেন।
চলচ্চিত্রের পোস্টারে তাঁর নিজের মুখ দেখার আজীবন অপূর্ণ সাধ পূর্ণ হয়েছিল শেষ জীবনে পৌঁছে, যখন সত্যজিৎ রায়ের পরশ পাথর এর হোর্ডিংয়ে তাঁর মুখের ছবি জ্বল জ্বল করত। তিনি বিশ্বাসই করতে পারতেন না যে তাঁকে নায়ক করে কেউ ছবি করবে, তাও আবার সত্যজিৎ রায়ের মতো কেউ। সত্যজিৎ রায় রবি ঘোষকে বলেছিলেন, ” তুমি জান, তুলসী চক্রবর্তী কী লেভেলের আর্টিস্ট, এ দেশে তাঁর কী দাম হল বল।”
তাঁর অবিশ্বাস্য সরলতার জন্য এই আত্ম উদাসীন মানুষটি আজীবন প্রতারিত হয়েছেন, এমনকি মৃত্যুর আগেও।
তাঁর জন্মদিন ছিল 3rd মার্চ 🙏🙏
ঋণ : পরশুরাম (তুলসী চক্রবর্তী স্মরণ সংখ্যা)
Aniruddha Mukherji