যেখানে কৃষি আইনের বিরোধিতায় আন্দোলনের নামে ভারত বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্র হচ্ছে, সেখানকার কৃষকদের চাইতে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকের অর্থনৈতিক চরিত্র আলাদা। পাঞ্জাব হরিয়ানায় কৃষকের জমির গড় পরিমাণ অনেক বেশি, কৃষি থেকে প্রাপ্ত আয়ও অনেক বেশি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ৯৬ শতাংশই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী। তাঁরা নিজেদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাদ্য উৎপাদন করলেও, গড়পড়তা বার্ষিক আয় মোটে আটচল্লিশ হাজার টাকা, ভারতীয় কৃষকের গড় আয় আটাত্তর হাজার টাকার চাইতে ঢের কম। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকের আয় ওড়িশা এবং ঝাড়খণ্ডের চাইতে কম।
এই রাজ্যে ফসল কাটার পর ব্যবস্থাপনার প্রচুর অভাব আছে। ফসল বিক্রির জন্য পরিকাঠামোগত সুযোগও কম। এই অবস্থায় কৃষকের আয় দ্বিগুণ করা সম্ভব, যদি নতুন কৃষি আইন দ্রুত চালু করে ফসলের সুনিশ্চিত দাম পাইয়ে দেওয়া যায়। সেই সঙ্গে রাজ্যের কৃষি ও আনুষঙ্গিক বিভাগগুলিকে সুষ্ঠু ও সমন্বিতভাবে কাজ করানো যায়। ফসল, প্রাণীসম্পদ, মৎস্য ভিত্তিক প্রথাগত কৃষিকর্মের পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায়। আগামীদিনে হাজার হাজার ফার্মাস প্রোডিউসিং অর্গানাইজেশন তৈরি হলে কৃষকদের একত্রিত করে ফসলের দাম পেতে দর কষাকষি সম্ভব হবে। এফপিও তৈরি করিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার সেই কাজটিই করতে চলেছে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের দারিদ্র্য মোচন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন তখনই হবে, যখন ফসলের বাজার তৈরি করা যাবে, ফসলের দাম পাওয়ার ব্যবস্থা হবে, ফসল লাগানোর সময়েই চুক্তিচাষে কৃষক নিশ্চিত হয়ে যাবেন তিনি কতটা মূল্য পেতে পারেন। নতুন কৃষি আইনে সে সুযোগও রয়েছে।
এখন প্রশ্ন, কেউ কেউ কৃষি আইনের বিরোধিতা করছেন কেন? আবার কেনই–বা অনেকে বলছেন, এই আইন এ রাজ্যের চাষীর জন্য আশীর্বাদ? আসলে বিষয়টি দাঁড়িয়ে আছে দুটি মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের উপর, তিনি কৃষকের স্বার্থ দেখছেন, না মধ্যসত্ত্বভোগীদের স্বার্থের কথা ভাবছেন? কৃষকের জন্য তার মায়াকান্না, না দালালদের জন্য তার প্রেম? তিনি ক্ষুদ্র-প্রান্তিক চাষীর কথা ভাবছেন, না কি জোতদার শ্রেণির কৃষকের কথা ভাবছেন? তিনি দুই-এক বিঘা জমির মালিক এমন কৃষকের জন্য বলেন, না কি যাদের জমির পরিমাণ কয়েকশো বিঘা, সেই বড়লোক চাষীদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করছেন। যদি পশ্চিমবঙ্গের মতো হত দরিদ্র চাষীরা কথা না ভেবে কোনো রাজনৈতিক দল পশ্চিম ভারতের জোতদার শ্রেণির বলিষ্ঠ পক্ষ অবলম্বন করে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরোধিতা করার মোক্ষম সুযোগ খোঁজেন, তবে বলতে হবে, পশ্চিমবঙ্গে জোতদার জমিদারদের জমি কেড়ে নিয়ে ভূমি সংস্কারের চিন্তাভাবনা একেবারেই ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।
কৃষি আইনের বিরোধিতা করতে হলে এই আইনগুলি খুঁটিয়ে পড়তে হবে। নইলে মিথ্যার বেসাতি বন্ধ হবে না। অনেকে আইনগুলি আংশিক পড়েও অসংখ্য মিথ্যা বলতে পারেন। তার সম্পর্কে যে প্রবাদ বাক্যটি অনুসরণ করা যায়, তা হল, “সে কহে অধিক মিছে যে কহে বিস্তর।”
এই বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করার আগে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকসমাজ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। এ রাজ্যের বড় অংশের মানুষের জীবনপথ হচ্ছে কৃষিকর্ম। খাদ্যোৎপাদন ও জীবনচর্যায় কৃষিই তাদের আশা, চাষাবাদই তাদের ভরসা। জমির মালিকানা আছে এমন কৃষকের পাশাপাশি গ্রামের হাজার হাজার ভূমিহীন-শ্রমিক কৃষিকাজকে জীবন ও জীবিকার জন্য বেছে নিয়েছেন। এক হেক্টর বা সাড়ে সাত বিঘার কম জমি আছে এমন কৃষকের সংখ্যাই রাজ্যে সবথেকে বেশি, তারা রয়েছেন ৮২.১৬ শতাংশ। এই ৮২.১৬ শতাংশ কৃষকদের বলা হচ্ছে প্রান্তিকচাষী। রাজ্যের ৫২.৪৭ শতাংশ ব্যবহারযোগ্য জমি-জিরেতের মালিকানা তাদেরই হাতে। এই প্রন্তিক চাষীর ওপরে রয়েছে ক্ষুদ্রচাষী, তাদের মাথাপিছু জমির গড় পরিমাণ একটু বেশি, এক থেকে দুই হেক্টর। রাজ্যে ১৩.৭৬ শতাংশ কৃষক মোটের উপর ক্ষুদ্রচাষী। এই ক্ষুদ্র চাষীরা রাজ্যের মোট চাষযোগ্য কৃষিজমির ২৮.২৫ শতাংশের মালিক। সবমিলিয়ে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরাই ৯৫.৯২ শতাংশ, তারা মোট ৮১ শতাংশ কৃষিজমির মালিক।
২০১০-১১ সালের জনগণনা অনুসারে এ রাজ্যে ৭২ লক্ষ কৃষক পরিবার রয়েছে৷ পারিবারিক ভাগবাঁটোয়ারার জন্য ধীরে ধীরে তাদের মাথাপিছু জমির পরিমাণও কমছে এবং চাষ থেকে আয়ের পরিমাণও কমে যাচ্ছে। রাজ্যের শস্য নিবিড়তা ১৮৫ শতাংশ, অর্থাৎ রাজ্যে একটা জমিতে থেকে গড়পড়তায় দুটি ফসলের চাষও হয় না।
তার ওপর, রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের অন্তর্গত একটি বড় এলাকা খরাপ্রবণ। সেখানে ভূমিক্ষয় বড় সমস্যা। মাটির উর্বরা শক্তি একেবারেই কম। বৃষ্টিপাতও কম এবং তা অনিশ্চিত। অন্যদিকে সুন্দরবন একটি পশ্চাৎপদ ব-দ্বীপ এলাকা। সেখানে সতেজ ও বিশুদ্ধ জলে সেচ দেওয়া মুস্কিল। উত্তরের পার্বত্য ও তরাই অঞ্চলের মাটি ক্ষয়িষ্ণু এবং অম্লধর্মী। তার উৎপাদিকা শক্তি কম। সেচের সুবিধা অপ্রতুল। ফলে এইসব অঞ্চলে প্রতিকূলতার জন্য দশকের পর দশক কৃষিকাজে ব্যাঘাত ঘটছে। এই তিন অঞ্চলের অধিকাংশ কৃষককে খাদ্যের নিশ্চয়তা এবং জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা দেওয়া এক প্রবল সমস্যা।
তার ওপর কৃষিপণ্যের বাজার এবং বাজারের যাবতীয় প্রণালীর প্রতি রাজ্যের কৃষি বিপণন দপ্তরের পরিকল্পিত ভূমিকা নেই। তার ফলে চাষ করে ফসল ফলিয়ে একজন কৃষক খুব কমই রোজগার করেন। রাজ্যে সেইভাবে বাজারের সুযোগ গড়ে ওঠেনি বলেই গ্রীষ্মের মাসগুলিতে ভেণ্ডির পাইকারি দর কেজিতে মাত্র দু টাকা দাঁড়ায়, শীতের সময় ফুলকপি হয় এক টাকা। এই দামে বেচলে কৃষকের দুঃখ কখনও ঘুচবে না। এই দাম পেলে ফসল তোলার খরচও উঠবে না। ধান, গম, আলু, আনাজের মতো ফসলে বিঘা প্রতি খরচ দশ থেকে বিশ হাজার টাকা। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনায় তা শেষ হয়ে গেলে কয়েক মাস বাদে কৃষকের হাত শূণ্য হয়ে যায়। আর ফলন ভালো হলেও রক্ষা নেই, কৃষকের কপাল পোড়ে আর ফড়ের পোয়া বাড়ে। তারওপর রাসায়নিক চাষে খরচ বেশি। সার, কীটনাশক, আগাছানাশকের খরচ, সবকিছুই ধরতে হবে। উচ্চফলনশীল জাতের বীজ কেনার খরচ আছে। কিন্তু যদি ফলনের কথা চিন্তা করি, তবে প্রাথমিকভাবে উচ্চ ফলন দিলেও, সবমিলিয়ে চাষের লাভজনক আয় চাষী পান না। সবমিলিয়ে কৃষক ধীরে ধীরে দীন দরিদ্র হয়ে পড়ে।
এই রকম একটি পরিমণ্ডলে গত সেপ্টেম্বর মাসে কৃষি বিষয়ক তিনটি বিল লোকসভা ও রাজ্যসভায় পাশ হয়। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেয়ে তা আইনরূপে বলবৎ হয়েছে। আইনগুলি হচ্ছে —
১. কৃষি পণ্য ব্যবসা-বাণিজ্য (উৎসাহ ও প্রতিশ্রুতি) আইন বা FPTC Act
২. কৃষক (ক্ষমতায়ন ও রক্ষা) মূল্য নিশ্চিতকরণ এবং কৃষি পরিষেবা আইন বা FAPAF Act
৩. অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন বা ECA Act
এই আইনগুলির ফলে বর্তমান প্রথাগত বাজারের বাইরে বাধাহীনভাবে রাজ্যের যেকোনো জায়গায় এমন কী অন্যরাজ্যেও বিক্রি করা যাবে। কৃষকদের সরাসরি বিপণনে জড়িত হতে সাহায্য করবে এই আইন, মধ্যস্থতাকারীদের অবস্থানও দূর করবে। এই আইন ভারতের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে। কৃষি বিপণন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে পরিকাঠামোগত বেসরকারি বিনিয়োগের সম্ভাবনা বাড়বে। গ্রামে গ্রামে কোল্ড স্টোরেজ, গুদামঘর ইত্যাদি তৈরি হবে। আর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এপিএমসিগুলি বা Agricultural Produce Market Committee গুলি কৃষকদের আরও সুবিধার বন্দোবস্ত করতে বাধ্য হবে।
কৃষিপণ্য ব্যবসা-বাণিজ্য আইনে এমন একটি ব্যবস্থার বন্দোবস্ত হয়েছে যেখানে কৃষক ও ব্যবসায়ী কৃষিপণ্যের কেনাবেচা সংক্রান্ত সবরকম স্বাধীনতা ভোগ করবেন, আগে যেটা ছিল না। মাণ্ডিতে ফসল বিক্রি করতে গিয়ে যদি কৃষক মনে করেন তিনি প্রতারিত হচ্ছেন, যথাযথ দাম পাচ্ছেন না, তাহলে বিকল্প ব্যবস্থা তার জন্য খুলে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতার এক নতুন মার্কেটিং চ্যানেল তৈরি হবে। দক্ষ, স্বচ্ছ ও বাধাহীন এই প্রণালী। কৃষিপণ্যের অন্তর্রাজ্য ও আন্তর্রাজ্য বাণিজ্য সম্ভব হবে। দৃশ্যমান বাজারের বাইরে ই–মার্কেট তৈরি হবে। আইনের মূল লক্ষ্য হল, সারা দেশের জন্য সুসংহত ও অভিন্ন একটি বাজার গড়ে তোলা — ‘এক দেশ এক হাট’।
কেন্দ্রীয় সরকার চাইছেন না, কৃষক ও আমজনতার মধ্যে কাটমানি-খোর মধ্যসত্ত্বভোগীরা এঁটুলি পোকার মতো লাভের গুড় খেয়ে যাক। নতুন আইনে কৃষক ফসল থেকে বেশি দাম পাবেন, লাভবান হবেন। পাশাপাশি ফড়েরা না থাকায় সাধারণ মানুষও তুলনায় কমদামে ফসল কিনতে পেরে লাভবান হবেন। অর্থাৎ এটি যেমন কৃষক-বান্ধব আইন, তেমনই আম-জনতার সহায়ক আইন। তবে দালালদের সন্তুষ্টির আইন এটি নয়।
কৃষিতে লাভ হয় না বলে, যে কৃষক চাষ ছেড়ে দিচ্ছেন, এই আইন সেই কৃষককে জমি-জিরেতের অভিমুখী করে তুলবে। মাণ্ডি ব্যবস্থাও উঠে যাচ্ছে না। কেউ যদি মনে করেন, তিনি ট্যাক্স দিয়ে মাণ্ডিতেই ফসল বিক্রি করবেন, তার সুযোগ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে না। অর্থাৎ যারা বলছেন, মাণ্ডি উঠে যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়।
দ্বিতীয়ত, কৃষি সুরক্ষা আইন হল চাষের চুক্তি সংক্রান্ত একটি জাতীয় ফ্রেমওয়ার্ক। কৃষককে ক্ষমতাশালী করাই তার লক্ষ্য। কৃষি এক শিল্পের পর্যায়ে যাচ্ছে, একটি ভৌমশিল্প যেন। এখন থেকে কৃষক ব্যবসায় জড়িত হতে পারবেন। জড়িত হবেন ব্যবসায়ী ফার্মের সঙ্গে, প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানির সঙ্গে, পাইকারি বিক্রেতার সঙ্গে, কিংবা খুচরো ব্যবসায়ীর সঙ্গে। আবার চুক্তি চাষে বীজ বোনার আগেই চুক্তি হতে পারে, কিন্তু চুক্তির এক্তিয়ারটি আসছে ফসল পাকার পর, কেবলমাত্র উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য। এটি আদৌ জমির বন্ধক সংক্রান্ত কোনো চুক্তি নয়। কখনই জমি হাতছাড়া হবার সম্ভাবনা নেই। একেবারে ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন একটি পদ্ধতির কথা আছে। কৃষকের লাভজনক দাম পাবার কথা আছে। চাষের শুরুতেই কৃষক লাভের ব্যাপারে স্থিরচিত্ত হতে পারবেন এই আইনে।
তৃতীয়, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইনে বলা হয়েছে যে কেন্দ্রীয় সরকার কেবলমাত্র যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, সহসা ও মাত্রাতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতি তৈরি হলে তবেই খাদ্যশস্য, ডালশস্য, আলু, তৈলবীজ ও পেঁয়াজের মতো কৃষিপণ্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করবে। পচনশীল ও অ-পচনশীল কৃষি-উদ্যান ফসলের দাম কত শতাংশ বৃদ্ধি পেলে সরকার মজুতদারি নিয়ন্ত্রণ করবে এবং কীভাবে তা করবে, তা সুস্পষ্ট বলা আছে এই আইনে। কোনোভাবেই অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বেলাগাম হওয়া আইন এটি নয়। সিমেন্ট, ইস্পাতও একসময় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের আওতার ছিল। পরে সেই আইনের বাইরে চলে এসেছে, কিন্তু তাতে মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে যায়নি ইস্পাত ও সিমেন্ট।
১৯৫৫ সালে যখন কৃষি আইন লাগু হয় তখন আজকের মতো কৃষি উন্নয়নের পরিস্থিতি ছিল না। আজ দেশে কৃষি উৎপাদন ও তার হার অনেক বেড়েছে। দেশ আজ কৃষিতে সাবলম্বী। তাই ৬৫ বছর আগেকার কৃষি নীতি আজকের নীতি হতে পারে না। এই আইনের সংশোধনী সম্পর্কে সেন্ট্রাল ডিপার্টমেন্ট অফ কনজিউমার অ্যাফেয়ার্স লীনা নন্দন জানিয়েছিলেন, “Essential Commodities Act was conceptualised in the era of food shortage…we have moved from scarcity to food security.” নতুন আইনের ফলে রপ্তানি বাণিজ্য থেকে আয়ের সম্ভাবনা যেমন বাড়বে, তেমনই দেশে সংরক্ষণ ও শস্যাগার নির্মাণ-শিল্পের সুযোগ ব্যাপক বৃদ্ধি পাবে। ফসলের অপচয় রোধ করাও সম্ভব হবে।
সংসদে কৃষি আইন নিয়ে বিরোধীদের জবাবে কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এই বিল চাষীকে বীজ বোনার সময়েই ফসলের দামের গ্যারান্টি দেবে৷ বিক্রয় চুক্তি কেবলমাত্র উৎপাদনের উপর, তার সঙ্গে কৃষিজমির কোনো উল্লেখ নেই। কৃষক চুক্তি থেকে সরে আসতে পারে, ব্যবসায়ী পারবে না। কৃষক ও তার কৃষিজমি পুরোপুরি সুরক্ষিত। তিনি বিরোধীদের কাছে প্রশ্ন তুলেছেন, কোনোদিনই কি ফসলের ন্যুনতম সহায়ক মূল্য, আইনের অঙ্গ ছিল? কংগ্রেস তো ৫০ বছর শাসন করেছে। তারা কেন এতদিন তা আইনের অঙ্গীভূত করল না? বিরোধীরা কৃষিবিলকে রাজনৈতিক ইস্যু করেছে, যেহেতু এই বিলের বিরুদ্ধে সমালোচনার আর কোনো জায়গা নেই। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সবসময় ভারত সরকারের একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তই ছিল এবং আগামী দিনেও থাকবে। নতুন আইনে কৃষক দেশ জুড়ে যেকোনো কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারবেন। এই আইন কৃষককে পণ্য বিক্রির সুযোগ বাড়াতে সহায়তা দেবে। মান্ডি বা কৃষি-বাজারে যেভাবে কৃষকরা আর্থিকভাবে শোষিত হয়, মানসিকভাবে প্রতারিত হয়, তা থেকে মুক্তির সম্ভাবনা তৈরি করবে এই আইন৷
এই আইনের বিরোধী আন্দোলনকারীরা নাছোড়। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এই কট্টর বিরোধিতা কেনই–বা কেবলমাত্র পঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তর প্রদেশের মতো স্থানে জন্ম নিল! কেনই বা অবশিষ্ট ভারতে তার প্রভাব নেই? যে অঞ্চলের মানুষ আন্দোলন করলেন, সেই রাজ্যের কৃষকের গড় পারিবারিক আয় অন্য রাজ্যগুলি থেকে অনেক বেশি।
দামী গাড়ি ও এলাহি আয়োজন নিয়ে উপস্থিত হওয়া মানুষ আসলে কারা? তারা কতশত বিঘা জমির মালিকানা ভোগ করেন? তারা কোন মাণ্ডির আড়তদার? তারা কোন বাজার কমিটিতে জাঁকিয়ে বসে থাকা রাজনৈতিক দলের প্রতিভূ? এসব চালচিত্র খুঁটিয়ে দেখতে হবে। খুঁজতে হবে বৈদেশিক যোগাযোগের তথ্যতালাশ। তখনই আবিষ্কার হবে এক অভূতপূর্ব ষড়যন্ত্রের আখ্যান। তার আগে আমাদের উচিত হচ্ছে, এই বিষয়গুলি সকলের সঙ্গে চর্চা করা, মিথ্যাবাদীদের প্রতিহত করা। এই আইন রূপায়ণ হলে পশ্চিমবঙ্গের কৃষক সবচাইতে লাভবান হবেন। কারণ পশ্চিমবঙ্গে ফসলের বৈচিত্র্য আছে, আছে জাত বৈচিত্র্যও। সারা বিশ্বের কাছেই এর চাহিদা ও আদর। ভুললে চলবে না, এখানকার মাটি সোনা, তাতে ফলন ভালো, তাই আয় বাড়বে।
এই প্রেক্ষিতে জানিয়ে রাখা দরকার নতুন কৃষি আইন সম্পর্কে ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ ও স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের অভিমত, অনুভব ও প্রতিক্রিয়া কী। বিল সম্পর্কে গত বছর ২২ শে সেপ্টেম্বর ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের পর্যবেক্ষণ ছিল, এই বিল কৃষককে পণ্য বিক্রির সুযোগ বাড়াতে সহায়তা দেবে। মান্ডি বা কৃষি-বাজারে যেভাবে কৃষকেরা আর্থিকভাবে শোষিত হয়, মানসিকভাবে প্রতারিত হয়, তা থেকে মুক্তির সম্ভাবনা তৈরি করবে এই বিল। কিন্তু পাশাপাশি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, কৃষি পণ্য বেচাকেনায় লাভকারী মূল্য যে মিলবে, কৃষকের সঙ্গে যে ধোঁকাবাজি করা হবে না, সে বিষয়ে কোনো গ্যারান্টি এই কানুনের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে সমর্থন মূল্য বা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসের কথা নেই। কিষান সঙ্ঘের দাবী ছিল, যদি কৃষককে ঠিকঠাক দাম দিয়ে চাষে লাভ পাইয়ে দিতে হয়, তাতে কমপক্ষে ফসলের সমর্থন মূল্যে বেচাকেনার কানুন আনা উচিত। একটি আলাদা কানুন তৈরি করে দেশের যেকোনো ফসল সমর্থন মূল্যের কমদামে বিক্রি হবে না, সেই পথ সুনিশ্চিত করার আইন আনতে হবে। সরকারের ঘোষিত উদ্যোগ সফল করতে আর যে পরিবর্তনগুলি ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ চেয়েছে তা হল — কৃষি ব্যবসায়ীদের নিবন্ধীকরণ কেন্দ্রগুলি ব্যঙ্কের সিকিউরিটির সঙ্গে যুক্ত হতে হবে এবং সেই সংক্রান্ত জ্ঞাতব্য তথ্য সরকারি পোর্টালের মাধ্যমে উপলব্ধ হতে হবে৷ যাবতীয় বিবাদ নিরসনের জন্য স্বতন্ত্র কৃষি ন্যায়াধিকরণ স্থাপন করতে হবে। এই বিবাদ প্রত্যেক জেলার কৃষকদের জন্য আলাদাভাবে নিরসন করতে হবে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধনের সময় ভান্ডার সীমার উপরের সমস্ত বাধা সরিয়ে দিতে হবে। শুধু বিশেষ পরিস্থিতিতে এই নিয়ম চালু হবে।
গত ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২০ তে স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের ডিজিটাল রাষ্ট্রীয় সম্মেলনে প্রস্তাব গৃহীত হয় এই আইনের আওতায় কৃষকদের পারিশ্রমিক মূল্য নিশ্চিত করা হোক। মঞ্চ বিশ্বাস করে, নতুন আইন আনার ক্ষেত্রে সরকারের উদ্দেশ্য ভালো। তবে ত্রুটিগুলি চিহ্নিত করতে হবে, কাটিয়ে উঠতে হবে এবং নতুন বিল সম্পর্কে ভয় এবং সন্দেহ দূর করতে সংশোধনী আনতে হবে। মান্ডিতে বা তার বাইরে কেনাবেচার ক্ষেত্রে MSP গ্যারান্টিযুক্ত হোক, তার নিচে বিক্রি অবৈধ হোক। বেসরকারি ব্যবসায়ীদের কম দামে অভাবী বিক্রিতে কিনতে বাধা দেওয়া হোক। ফসল ক্ষেত থেকে উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থ প্রদান করা উচিত বা সরকারের অর্থ প্রদানের গ্যারান্টি দেওয়া উচিত। সংগ্রহকারী সংস্থা ও ব্যবসায়ীদের নথিভুক্তিকরণ বাধ্যতামূলক হোক। সরকার বলেছিল ২২ হাজার কৃষিমান্ডি হবে, তাও দ্রুত সম্পন্ন হোক। কৃষক হিসাবে সংজ্ঞার ক্ষেত্রে কেবল কৃষককেই অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, কৃষিতে নিযুক্ত কোম্পানিকে নয়। ‘যিনি নিজে বা ভাড়াটে শ্রমিকদের দ্বারা কৃষি উৎপাদনে নিযুক্ত’ তিনিই কৃষক পদবাচ্য হোক। আর চুক্তিতে প্রবেশের পর অর্থ প্রদানের বিষয়টি বীজ বপনের পর্যায় থেকেই হোক, তিন-চারটি কিস্তিতে হোক।
পরিশেষে বলতে হয়, সামগ্রিকভাবে এই দেশ এবং এই রাজ্য কৃষি জলবায়ুগত বৈচিত্র্যে ভরপুর। এই রাজ্যের ছয়টি কৃষি জলবায়ু অঞ্চলে সব ধরনের ফসল চাষের সুযোগ আছে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক যাতে ফার্মিং সিস্টেম অনুসরণ দ্বারা জলা-জমি-বাস্তুভূমি-জমির আল-কুটিরের চাল সব জায়গাকে ব্যবহার করে উপযুক্ত ফসল ফলিয়ে কৃষি উৎপাদন সংগঠন (FPO) তৈরির মাধ্যমে বিপণনের অন্যতর চ্যানেল ব্যবহার করে নিজেদের পণ্যবিক্রিতে দরকষাকষির জায়গায় আসতে পারেন, তা সুনিশ্চিত করতে পারবে নতুন কৃষি আইন। বাড়ির পাশের মান্ডিতে বাগিচায় চাষ করা পিপুল নিয়ে গেলে অবিক্রীত থাকে, কিন্তু নতুন আইনে ঝাড়খণ্ড থেকে আগ্রহী ব্যক্তি বা সংস্থাও কিনে নিতে পারবেন সেই কৃষকের ফসল। চাষ হয়ে উঠবে নিজের পছন্দসই ও নিজের জমির উপযোগী। যেমন আশ, তেমন চাষ।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী