লবন সত্যাগ্রহ ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ

১৯৩০ সালের ১২ মার্চ ডান্ডি পদযাত্রা বা লবন সত্যাগ্রহ শুরু হয়। এই সত্যাগ্রহ ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। লবণ পদযাত্রা ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশদের একচেটিয়া লবণ নীতির বিরুদ্ধে একটি অহিংস করপ্রদান-বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা হয়। ১৯২০-২২ সালের অসহযোগ আন্দোলনের পর লবণ সত্যাগ্রহই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠিত ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস “পূর্ণ স্বরাজ” প্রস্তাব গ্রহণ করার অব্যবহিত পরেই এই সত্যাগ্রহের সূচনা ঘটে। মহাত্মা গান্ধী আমেদাবাদের কাছে তার সবরমতী আশ্রম থেকে ডান্ডি পদযাত্রা শুরু করে ২৪ দিনে ২৪০ মাইল (৩৯০ কিলোমিটার) পথ পায়ে হেঁটে ডান্ডি গ্রামে এসে বিনা-করে সমুদ্রের জল থেকে লবণ প্রস্তুত করেন। বিরাট সংখ্যক ভারতীয় তার সঙ্গে ডান্ডিতে আসেন। ১৯৩০ সালের ৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৬টার সময় গান্ধীজি লবণ আইন ভেঙে প্রথম লবণ প্রস্তুত করেছিলেন। সেই সঙ্গে তার লক্ষাধিক অনুগামীও লবণ আইন ভেঙে ভারতে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করলেন। এই আন্দোলনের ফলে ভারতের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ব্রিটিশদের মনোভাব অনেকটাই বদলে যায়।
আইন অমান্য আন্দোলন হলো ১৯৩০ সালে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নেতৃত্বে শুরু হওয়া একটি ব্রিটিশ সরকার বিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনের পটভূমি ছিলো সাইমন কমিশন।


নেহরু রিপোর্ট কার্যকর করতে ব্রিটিশ সরকারের সহায়তার অভাব ও দেশের সর্বত্র ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভ ও অসন্তোষজনক আইন অমান্য আন্দোলন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা ভারতীয় অর্থনীতিকে অচল করে। এবং ব্যবসায়ী, কৃষক, মজুর সকলেই চরম দুর্দশার মধ্যে পড়ে। এসময়ে সর্বত্র কৃষক এবং শ্রমিকদের ট্রেড-ইউনিয়ন কংগ্রেস স্থাপিত হয়। ট্রেড-ইউনিয়নগুলির নেতৃত্বে সর্বত্র সরকারি নীতি ও কর্মপদ্ধতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হতে থাকে। সব মিলিয়ে ভারতবর্ষের মনে অস্থিরতা পরিলক্ষিত হয় এবং ব্রিটিশ সরকার দমনমূলক নীতি প্রয়োগ করে বিক্ষোভ দমনে সচেষ্ট হন। এই পরিস্থিতিতে ১৯৩০ সালের ১৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় কংগ্রস সবরমতী আশ্রমে ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং করে ও গান্ধিজির সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে অহিংস আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং এই আন্দোলনের যাবতীয় দায়িত্ব গান্ধিজির ওপর অর্পণ করে। গান্ধিজি প্রথমেই ঠিক করেছিলেন লবণ সত্যাগ্রহের দ্বারা আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করবেন।

১৯৩২-১৯৩৪ সালের গান্ধি-আরউইন চুক্তির শর্তকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা ব্যর্থ হলে গান্ধিজি ১৯৩১ সালের ২৮শে ডিসেম্বর ভারতে ফিরে এসে দেখলেন গান্ধি-আরউইন চুক্তি লঙ্ঘন করে ব্রিটিশ সরকার দেশজুড়ে দমনমূলক নীতি অনুসরণ করে স্বৈরাচারী শাসন চালাচ্ছেন। উত্তরপ্রদেশে খাজনা বন্ধ আন্দোলন করার সময় পুরুষোত্তমদাস ট্যান্ডন, ভজহরি মাহাতো, জওহরলাল নেহরু, আবদুল গফফর খান ও তার বড়ভাই সহ লালকোর্তা বাহিনীর বহু কর্মী এবং আরও অনেকে গ্রেফতার হন। এই পরিস্থিতিতে ১৯৩২ সালের ৩ জানুয়ারি গান্ধিজি লবন সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দেন। ৪ঠা জানুয়ারি গান্ধীজিকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয়। কংগ্রেসকে বেআইনি সংগঠন রূপে নিষিদ্ধ করা হয় এবং কংগ্রেসের যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। জনসাধারণের ওপর সরকারি নির্যাতন ও দমনমূলক আইন যথেচ্ছভাবে প্রযুক্ত হতে থাকে। সংবাদপত্র সমূহের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণাদেশ বলবৎ হয়। গান্ধি-আরউইন চুক্তি আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে এই চুক্তি ভেঙ্গে দিয়ে আবার আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয় । এবার বাংলা, উত্তরপ্রদেশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। পরবতীতে গান্ধিজি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে অস্পৃশ্য মানুষের স্বার্থে হরিজন আন্দোলনের প্রতি মনোনিবেশ করেন। তিনি ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিখিল ভারত অস্পৃশ্যতা বিরোধী লিগ গঠন করেন। ১৯৩৩ সালের জানুয়ারি মাসে হরিজন পত্রিকা প্রকাশিত গান্ধিজির এক বক্তব্যেব কারণে ক্ষুব্ধ বর্ণহিন্দুরা পুনায় গান্ধিজির বাড়ি লক্ষ করে বোমা নিক্ষেপ করে। ভেস্তে যায় ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের আইনসভার মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত বিল। অনেকে গান্ধিজির আইন অমান্য আন্দোলন ছেড়ে সরকারপক্ষে যোগ দেয়।
১৯৩২ সালের নভেম্বর মাসে লন্ডনে তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস পূর্বের মতই ওই বৈঠকে যোগদান করেনি। অন্যান্য দল ও সম্প্রদায়ের অল্প কিছু সংখ্যক প্রতিনিধি এই বৈঠকে যোগদান করেছিলেন। তারা ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রে কয়েকটি প্রগতিশীল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চাইলে সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে। তবে এই বৈঠক এবং পরবর্তী আলোচনা সমূহের ফলশ্রুতি হিসাবে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসনআইন বিধিবদ্ধ হয়।

আইন অমান্য আন্দোলন ভারত জাতিকে সর্বপ্রকার ত্যাগস্বীকার করতে প্রস্তুত করে তোলে। কংগ্রেস যে ভারতের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে এই সত্যটিও প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আন্দোলন বিশ্ববাসীর কাছে ভারতে ব্রিটিশরাজের অত্যাচারী রূপটি প্রকাশিত করে । এবং ভারতের স্বাধীনতার সমস্যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঘরোয়া সমস্যা নয় এটি একটি আন্তর্জাতিক বিষয় এটাও বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে।

আইন অমান্য আন্দোলন কোনো কাংক্ষিত অর্জন ছাড়াই শেষ হয়। এই আন্দোলন ভারতের জন্য স্ব-রাজ বা পূর্ণ স্বাধীনতা কোনোটাই অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। ভারতীয় সংবিধান তৈরির ক্ষেত্রে আইন অমান্য আন্দোলন বাস্তবক্ষেত্রে কোনো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেনি এবং ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। এমন অবস্থায় আইন অমান্য আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। এই আন্দোলন অসংখ্য ভারতবাসীর মধ্যে এক প্রকার রাজনৈতিক চেতনার সঞ্চার করে। কিন্তু এই আন্দোলন ভারতের প্রধান দুটি সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনে ব্যর্থ হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.