রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নীকরণে জোর দিয়ে মঙ্গলবার আর্থিক সংস্কারের পক্ষে জোরালো সওয়াল করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর স্পষ্ট কথা, ‘গভর্নমেন্ট হ্যাজ নো বিজনেস টু বি ইন বিজনেস’। অর্থাৎ ব্যবসা করা সরকারের কোনও কাজই নয়। প্রধানমন্ত্রীর কথায়, তাঁর সরকারের মন্ত্র একটাই মানিটাইজ করো বা মর্ডানাইজ করো। মানে সরকারি সম্পদের যোগ্য ব্যবহারের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা করো, কিংবা আধুনিকীকরণ করো। যাতে প্রতিষ্ঠান আধুনিক হয়ে উঠে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে পারে।
ইদানীং বামপন্থী এবং তৃণমূলপন্থীরা মোদী সরকারের বিরুদ্ধে আকছার স্লোগান তোলে, ‘সব বেচে দে!’। জাতীয় স্তরে বিলগ্নীকরণের নীতির বরাবর সমালোচনা করেছেন বামেরা। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজও বলেছেন, ওরা সেল, ভেল, রেল, বিএসএনএল—সব বেচে দিচ্ছে।
বিরোধীদের এই সমালোচনা যেমন একটা দিক, তেমন অন্য দিকটাও বিস্মৃত হয়নি অনেকেই। অতীতে অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং মনোমহন সিংহ—এই দুই নেতাই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নীকরণের পথে হেঁটেছিলেন। এই দুই সরকারেরই শরিক ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। মন্ত্রিসভায় বিলগ্নীকরণের সিদ্ধান্তের অংশীদার ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
এদিন সেই বিলগ্নীকরণের প্রসঙ্গেই দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “সরকার যখন কোনও ব্যবসায় যুক্ত হয়, তখন লোকসানই হয়। কারণ, সরকারের হাত পা অনেক নীতিতে বাঁধা থাকে। বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহস দেখাতে বা ঝুঁকি নিতে পারে না। তাই সরকারের দায়িত্ব ব্যবসা বাণিজ্য ও উদ্যোগকে সাহায্য করা, সেই সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলা। কিন্তু সরকারের ব্যবসা করা অপরিহার্য নয়।”
প্রধানমন্ত্রী এদিন বলেন, “তাই যে সম্পদ রয়েছে তা ব্যবহার করে আরও রাজস্ব আদায় ও বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত দেশের নাগরিকদের আরও ক্ষমতায়ণ ঘটাবে। কাজের সুযোগ বাড়বে।” তিনি জানিয়েছেন, “দেশে অন্তত ১০০-র বেশি সম্পদ রয়েছে যেগুলির কোনও ব্যবহার হয় না বা কম ব্যবহার হয়। এই সব সম্পদকে মানিটাইজ করে আড়াই লক্ষ কোটি টাকা আদায় হতে পারে। যে টাকা উন্নয়ন প্রকল্পে কাজে লাগাবে সরকার”।
দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সময় থেকে দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগ স্থাপন শুরু হয়। এদের মধ্যে বহু সংস্থা রুগণ হয়ে পড়েছে বা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এদিন বলেন, কেবল ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য অলাভজনক সংস্থাগুলিকে টাকা দিতে হচ্ছে। সেই টাকা করদাতাদের থেকে আসছে। সরকার কেন সাধারণ মানুষের উপর বোঝা বাড়াবে?
লকডাউন পরবর্তী সময়ে বেসরকারিকরণে অতিশয় জোর দিয়েছে মোদীর সরকার। অন্যন্য ক্ষেত্র ছাড়াও ব্যাঙ্কিং, বিমা, ইস্পাত, সার, পেট্রোলিয়াম, প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের মতো কৌশলগত ক্ষেত্রে বেসরকারি ও বিদেশি লগ্নির পরিসর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে মনে করছেন অনেকেই।
তবে পর্যবেক্ষকদের একাংশ ও বিরোধীদের দুটি প্রশ্ন রয়েছে। এক, বেসরকারিকরণ ও বিলগ্নীকরণের ক্ষেত্রে হাতেগোণা কিছু বাণিজ্যিক সংস্থার মুখ কেন বার বার দেখা যাচ্ছে! দেশের সম্পদ ও অর্থ মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে কেন কুক্ষিগত হবে? এবং দুই, বাজারে যখন মন্দা থাকে তখন জিনিসের দাম পাওয়া যায় না। এখনও মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশ। এর মধ্যে দেশের সম্পদ বিক্রি করলে তো কম দামই পাওয়া যাবে। তা হলে কি কাউকে সুবিধা পাইয়ে দিতেই এই সিদ্ধান্ত?
জবাবে অবশ্য সরকারের শীর্ষ আমলারা বলছেন, মন্দা ও কোভিড পরিস্থিতিতে সরকারকে সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক ব্যয় করতে হচ্ছে। উল্টে রাজস্ব আদায় আগের তুলনায় কম হচ্ছে। প্রশ্ন হল, অর্থের যোগান আসবে কোথা থেকে। সরকারকে তাই বিলগ্নীকরণের পথে হাঁটতেই হবে। সেই অর্থ পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হবে। যাতে কাজের সংস্থান হয়। মানুষের হাতে টাকা যায়। সেই টাকা তারা যাতে সংসার চালাতে খরচ করে। বাজারে চাহিদা তৈরি হয় এবং তা যোগান দিতে উৎপাদন বাড়ে। তবেই অর্থনীতির চাকা ঘুরবে।