স্বাধীনতার পর রাজ্যে প্রথমবার কাজ করলো হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক

ভোটের ফলঘোষণার দিন সকালে একটি টিভি চ্যানেলে এক ভোট-তাত্ত্বিক জ্ঞান বিলোচ্ছিলেন। দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ যখন বে-আব্রু হয়ে পড়েছে যে বামফ্রন্টের ভোটব্যাঙ্ক তলানিতে পৌঁছচ্ছে, বিজেপি তৃণমূলের সঙ্গে সমানে টক্কর দিচ্ছে তখন সেই তাত্ত্বিক তার ছদ্ম-নিরপেক্ষতার মূখোশ খুলে বলে দিলেন ‘মার্কসবাদী’ভারতীয় জনতা পার্টি তৃণমূলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়াই করছে। এরপর তৃণমূলের ফলাফলে বেজায় হতাশ তৃণমূলির আর তাদের বৌদ্ধিক মদতদাতা ‘শহুরে নকশাল’ একটা থিওরি প্রচার করার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে গেল বাম ভোট বিজেপি-তে আসতেই বিজেপির নাকি এই সাফল্য। সঙ্গে হাতে গরম পরিসংখ্যান গতবার অর্থাৎ ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট প্রাপ্তির হার ছিল প্রায় ১৭ শতাংশ, এবার ২৩ শতাংশ বেড়ে তা ৪০ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে ২০১৪-বামেরা পেয়েছিল প্রায় ৩০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট, এবার যা ২৩ শতাংশ কমে ৭ শতাংশে ঠেকেছে। অর্থাৎ বামেদের ২০১৪-র ২৩ শতাংশ ভোট ২০১৯-এ বিজেপির বাড়তি ২৩ শতাংশে পরিণত হয়েছে।
বাম-তাত্ত্বিকেরা এখন নতুন একটি থিয়োরির আমদানি করেছেন। সেটি হলো প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা। যার সরল মর্মার্থ হলো তৃণমূলের মুসলমান তোষণের পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপির হিন্দু তোষণ। ভারতবর্ষের আরও বিশেষ করে বাঙ্গলার দুর্ভাগ্য এদেশে সংখ্যাগুরুর দাবি-দাওয়া আদায় করতে রাজনৈতিকভাবে পথে নামতে হয়, তাতে কিছু জোটে, কিছু জোটেনা। কারণটাও খুব সহজ। মমতা ব্যানার্জি খুব সরলভাবে। স্বীকার করে নিয়েছেন যে গোরু দুধ দেয়, তার পদাঘাত সহ্য করা উচিত। এই দুধেল গাই হিসেবে মুসলমানদের রাজনৈতিক তোয়াজ করার শিক্ষা তিনি সিপিএমের কাছ থেকেই পেয়েছেন।
স্বাধীনতা-পূর্ব আমলে কমিউনিস্ট পার্টি ছিল মুসলিম লিগের দোসর। লিগের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তারা বলেছিল পাকিস্তান দাবি মানতে হবে, তবেই ভারত স্বাধীন হবে। এমনই দুর্ভাগ্য দেশের স্বাধীনতার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নিয়ে রাজনীতি করে স্থায়ী একটা ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করে নিয়েছিল বামেরা। উদ্বাস্তুরা বুঝতেও পারেনি, তারা বামেদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। বামেদের ‘বুর্জোয়া, ‘সামতান্ত্রিক দাসত্ব’ ইত্যাদি স্লোগান তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতিতে ভালো মানিয়েছিল ।কারণ একদিকে ছিল কিছু কংগ্রেসি ভোটব্যাঙ্ক, যারা অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট উন্নত; অন্যদিকে বামপন্থীদের ভোটব্যাঙ্ক, যার পুঁজি সর্বহারা, দরিদ্র, নিরন্ন মানুষ। প্রকৃতপক্ষে দারিদ্র্যই বামপন্থীদের রাজনৈতিক সম্বল। এগুলি সবই ৪৭-এর পরবর্তী সময়ের কথা। মুসলমান তোষণের চোরাস্রোত তখনও ছিল, কিন্তু দেশভাগের গভীর ক্ষত নিয়ে ভারতবর্ষে মুসলমান তোষণের অনুকূল পরিবেশ তখনও তৈরি হয়নি। মুসলমান দেশের বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’-এর বঞ্চনা, যদিও ভারতকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে সাংবিধানিক নির্মাণের রূপকার ইন্দিরা গান্ধী কিন্তু জওহরলাল নেহরু তার প্রায়োগিক দিকের বীভৎসতা বহু আগেই উন্মোচন করে দিয়েছিলেন, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আত্মাহুতি যার গভীরতম ক্ষত। ১৯৭৭ সালের বামফ্রন্ট যখন রাজ্যে ক্ষমতায় এল তখন রাজনীতির জল অনেকদূর গড়িয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়েছে। জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধীর সহযোগী থাকার কারণে আদি কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআই-এর হাল তখন শোচনীয়। নকশাল আন্দোলন, জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা বিরোধিতা (যদিও একমাত্র জ্যোতির্ময় বসু (জ্যোতি বসু নন) ছাড়া আর কোনো নেতাই গ্রেপ্তার হননি) ইত্যাদি কারণে চীনা আক্রমণের সমর্থনকারী মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি অর্থাৎ সিপিআই(এম) তখন বামফ্রন্টের নিয়ন্ত্রক হিসেবে রাজ্যের ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। প্রসঙ্গত, সিপিআই বামফ্রন্টে যুক্ত হয়েছে ১৯৮২ সালে। যাই হোক, ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানের খান সেনাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশিদের লড়াইয়ে ৪৭-এর দেশভাগের দগদগে ক্ষত কিছুটা নিরাময় হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা হিন্দুদের মনে।
‘৭৭-এ রাজ্যে ক্ষমতায় এসে এই সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করল বামফ্রন্ট। মুসলমানদের সুযোগ-সুবিধে দিয়ে, অনেকটা নাকের সামনে গাজর ঝুলিয়ে তা ধরার লক্ষ্যে দৌড় করানোর মতো, তাদের ভোটগুলিকে কুক্ষিগত করে ফেলল। তৈরি হলো এদেশের রাজনীতিতে, বিশেষ করে বাঙ্গলার রাজনীতিতে একটি নতুন শব্দ ‘মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক। আজ যাঁরা প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন, সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতি এই স্বাধীন বঙ্গে তারাই প্রথম এনেছিলেন ক্ষমতায় থাকবার সুরক্ষা কবচ হিসেবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ভুলিয়ে রাখা হয়েছিল সেকুলারিজমের মোহে।
অঙ্কের হিসেব বহুদিন পর্যন্ত ঠিকই ছিল, পাশার দান উল্টোল না সিঙ্গুর নয়, মুসলমান প্রধান নন্দীগ্রাম আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। রাজ্যে সিপিএম-বিরোধী একমাত্র মুখ হিসেবে মমতা দীর্ঘদিন ধরে বিশেষ করে ১৯৮৪ সালে সাংসদ হওয়া থেকেই মান্যতা পেয়ে এসেছেন। কিন্তু কোনওদিনই খুব এঁটে উঠতে পারেননি কারণ তার পাশে মুসলমানরা ছিল না। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পর ইমাম, মুয়াজ্জিন, পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকি সিদিকুল্লা, সাংবাদিক ইমরানের মতো মুসলমান সমাজের কেষ্টবিষ্টুদের হাত মাথায় নিয়ে মমতার রাজ্যাভিষেক। তথাগত রায়ের ভাষায় সিপিএমের মেধাবী ছাত্রী এরপর তার গুরুকেও টপকে যান। উগ্র মুসলমান তোষণ একদিকে দেগঙ্গা, বাদুড়িয়া, ডায়মন্ডহারবারের মতো সংখ্যালঘু অধ্যুষিত স্থানে হিন্দুদের অবস্থা শোচনীয় করে তোলে, অন্যদিকে খাগড়াগড়, মেটিয়াবুরুজের মতো এলাকার ঘটনায় জেহাদিরাও যে এরাজ্যে প্রশাসনিক মদত পাচ্ছে তা বেআহব্রু হয়ে পড়ে।
সিপিএম বুদ্ধি করে যে সম্প্রদায়কে তাদের নির্বাচন জেতার তুরুপের তাস করেছিল, মমতার একইপন্থা কিন্তু নির্বুদ্ধিতা, সেকুলারিজম-এর। মুখোশের আড়ালে কদর্য মুখটাকে হিন্দুদের সামনে তুলে ধরল। এবং স্বাধীনোত্তর ভারতে কখনও যা হয়নি, এবার ঠিক সেটাই হলো। হিন্দুরাও অধিকার সচেতন হয়ে তাদের ব্লকভোট তৈরি হলো। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা তাদের অধিকার রক্ষা আন্দোলনে শামিল হলেন এরাজ্যে, বিজেপির হাত ধরে। এই সময় মুসলমানরা আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরল তৃণমূলকে। মালদা, মুর্শিদাবাদের মতোমুসলমান সংখ্যাগুরু জেলাগুলির দিকে তাকালেই তা প্রমাণ হবে। একদা কংগ্রেসি গড়, তৃণমূলের কিছু সংগঠন না থাকলেও আজ তা তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে, মুসলমানদের সৌজন্যে।
পাশাপাশি মুসলমানদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হিন্দুরাও যে একত্রিত হচ্ছেন তার প্রমাণ দিয়ে রেখেছে মালদা জেলার দুটি আসন। উত্তর মালদায় বিজেপি জিতেছে, দক্ষিণ মালদা অল্পের জন্য হাতছাড়া হয়েছে। মূলত প্রয়াত কংগ্রেস নেতা গনিখান চৌধুরীর ব্যক্তিগত ক্যারিশমাও তাতে কাজ করেছে। ঠিক যেমনটি হয়েছে বহরমপুরে, সেখানে কংগ্রেস নেতার অধীর রঞ্জন চৌধুরী ব্যক্তি ইমেজ কাজ করেছে। মুর্শিদাবাদ জেলার মুর্শিদাবাদ ও জঙ্গিপুর লোকসভা আসনের বিজেপি প্রার্থীরা এলাকার জনপ্রিয় মুসলমান হলেও নিজের সমাজের অধিকাংশ মানুষের কাছে কল্কে পাননি, মমতার তোষণ নীতির পরিণামে।
হতেই পারে যে, সব মুসলমান বিশেষ করে তিন তালাকের শোচনীয় পরিণামের স্বীকার মুসলমান মহিলারা এবার তৃণমূলের পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু তৃণমূলের প্রাপ্ত ৪৩ শতাংশ ভোটের সিংহভাগই যে মুসলমান সমাজের আর রাজ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলমান ভোটের যে নির্দিষ্ট অংশ ভোট দিয়েছে, তারও সিংহভাগ মমতার ঝুলিতেই গিয়েছে। এছাড়া সেই বিশেষ একটি সম্প্রদায় যারা হিন্দুর পরিচয়ে ‘সেকুলার’ সেজে হিন্দুসমাজকে দীর্ঘদিন পথভ্রষ্ট করেছেন, যারা দীর্ঘদিন বাম ছিলেন, বর্তমানে অতি-বাম হয়ে তৃণমূল হয়েছেন, ‘বিজেপিকে রুখতে তৃণমূল চাই’স্লোগানে রাজ্যটাকে ব্যতিব্যস্ত করে, তারাও মমতাদেবীর ভোটঝাঁপি ভরেছেন।
তাই কার্যক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে সিপিএমেরই একদা দুই বিশ্বস্ত দোসর, স্বাধীনতার আগে থেকেই, মুসলমান সম্প্রদায় ও তথাকথিত হিন্দু-নামধারী ‘সেকুলার’ সমাজ এবার মমতা ব্যানার্জিকে ৪২-এ ৪২-এর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।
কিন্তু এই দুধেল গাইয়ের লাথি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সহ্য করলেও, রাজ্যের বহু বছরের শোষিত, বঞ্চিত হিন্দুরা সহ্য করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁদের এককাট্টা ৪০ শতাংশ ভোট বিজেপি পেয়েছে, হিন্দুদের ভরসাযোগ্যতার চিহ্নস্বরূপ। মমতা এই পরিস্থিতির আঁচ পেয়েছিলেন, তাই রামনবমী জন্মাষ্টমীতে হিন্দুদের মন জয়ের কিছু চেষ্টা হয়েছিল। যদিও ভবি ভোলে না। একদিকে রোহিঙ্গা, আর অনুপ্রবেশকারীদের মাধ্যমে তিনি ভারতীয়দের পেটের ভাত কাড়বেন, থাকার জায়গা কাড়বেন আর হিন্দুদের ভোট পাবেন—এটা হয় না। হয় না বলেই বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের ভাষায় ‘তুলনামূলক সাম্প্রদায়িকতা কিংবা তৃণমূলি বুদ্ধিজীবীদের ভাষায় ‘মেরুকরণ। আর হিন্দুরা বলেন, ‘দেশপ্রেমিকদের একজোট হওয়া।
একথা ঠিক যে গ্রাম বাঙ্গলার মানুষ মুসলমান মৌলবাদের ভয়াবহতানিয়ে যেভাবে সচেতন, ভুক্তভোগী হওয়ার কারণেই, শহরের মানুষ ততটা নন। তার সেটা নন বলেই তৃণমূল এবার তাদের অস্তিত্বটুকু বজায় রেখেছে। ‘সেকুলারিজম’-এর ভূত গ্রামবাঙ্গলার মানুষের ঘাড় থেকে নেমেছে, শহরের মানুষও ২০২১-এর জন্য তৈরি হচ্ছেন এদের ঝেড়ে ফেলতে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কান পাতলে সেকুলারিজমের ঠিকাদারদের ফোসফোসানি শোনা যাচ্ছে।
অভিমন্যু গুহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.