দ্বিতীয় অধ্যায়
সরস্বতী পূজা অনধ্যায়শ্চ গৌড়াচারঃ।
বর্ষক্রিয়াকৌমুদীতে উল্লিখিত হয়েছে যে গৌড়দেশে মাঘমাসের শুক্লা পঞ্চমীর দিন দেবী সরস্বতীর উপাসনা করা হয়। ওই দিন ছাত্র, শিক্ষক এবং যিনি পন্ডিত নন তিনিও দেবীকে আপন আপন পুঁথি , কলম ইত্যাদি প্রদান করে দেবীর আরাধনা করেন। ওইদিন পড়তে নেই।
মাঘী পঞ্চমী ব্যতীত আরো নানা তিথিতে বিদ্যাদেবীর ষোড়শোপচারে আরাধনা করার কথা শাস্ত্রে আছে। কৃষ্ণযজুর্বেদে বলা হয়েছে , নবমী তিথিতে সরস্বতী দেবীকে উৎসর্গ করা বিধি। শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে , পূর্বকালে পূর্ণিমা তিথিতে সরস্বতী দেবীর নিকট অঞ্জলি দেওয়া হতো। বর্ষক্রিয়াকৌমুদী ব্রহ্মপুরাণ বচন উদ্ধৃত করে উপদেশ করেছে –
চতুর্থী বরদা শুক্লা তস্যাং গৌরী সুপূজিতা।
সৌভাগ্যমতুল্যং কুর্যাৎ পঞ্চম্যাং শ্রীরপি শ্রিয়ম্।।
মাঘী শুক্লা চতুর্থীতে গৌরী পূজার বিধি। ওই তিথিতে গৌরী পূজা করে অতুল সৌভাগ্য লাভ হয়। মাঘী পঞ্চমীর দিন শ্রী বিদ্যার পূজা করতে হয়। শ্রী বিদ্যা সরস্বতী , তিনি জ্ঞান, প্রজ্ঞা , বিদ্যা ,বুদ্ধির দেবী। তিনি অন্ধকার থেকে আলোকের পথে নিয়ে যান। অসতো মা সদ্গময়। তমসো মা জ্যোতির্গময়। মৃত্যোর্মামৃতং গময়। তবে বঙ্গের বাইরে বহু কোন কোন জায়গায় , আশ্বিনের শুক্লা অষ্টমীতে দেবী সরস্বতীর আরাধনা করা হয়। শাস্ত্রে আশ্বিনে সরস্বতী পূজার বিধি আছে। রুদ্রজামলে বলা হয়েছে –
মূল ঋক্ষে সুরাধীশ পূজনীয়া সরস্বতী।
পূজয়েৎ প্রত্যহং দেব যাবদবৈষ্ণবমৃক্ষকম্।।
নাধ্যাপয়েন্ন চ লিখেন্নাধীরীত কদাচন।
পুস্তকে স্থাপিতে দেব বিদ্যাকামো দ্বিজোত্তমঃ।।
অশ্বিনের শুক্লপক্ষে মূলা নক্ষত্রে সরস্বতীকে আহবান করিয়া শ্রবণা নক্ষত্রে বিসর্জন দিতে হয়।
আশ্বিনস্য সিতে পক্ষে মেধাকামঃ সরস্বতীম্।
মূলেনাবাহয়েন্দেবীং শ্রবণেন বিসর্জনম্।।
মূলাদ্যপাদে চাহবানং শ্রবণান্তে বিসর্জনম্।।
তাছাড়া মাঘ মাসে শুক্লা পঞ্চমীরদিন স্কন্দ এবং ইন্দ্র পুত্রী দেবসেনার শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। সেই উৎসবের স্মারক হিসাবেও এই মাঘী শুক্লা পঞ্চমীকে শ্রী পঞ্চমী বলা হয়।
অতীতে সরস্বতী পূজা হতো দুরকমের – দেবীর প্রতিমা নির্মাণ করে , অথবা পুঁথি, পত্র, দোয়াত , শরের কলম, অন্যান্য সারস্বত প্রতিনিধি সুমুখে পূজাদি করে হোম যজ্ঞাদি করা হতো। পুরোহিত বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ করে পূজা করতেন।
সরস্বতী পূজায় শীতের থেকে বাহির হয়ে এসে যা কিছু নতুন ধূসরতা সরিয়ে নবীনের সূচনা করে তা উৎসর্গ করা হয়। কেন হয় তা পূর্ব পর্বে শেষভাগে আমি ব্যাখ্যা করেছি। দেবী শ্বেত বর্ণা। তিনি শান্তি নির্মলতার দেবীও বটে। যেথায় অশান্তি সেথায় তিনি চঞ্চলা। তাঁকে পুরো পেতে গেলে আগে আপন অভ্যন্তরকে পবিত্র নির্মল করতে হয়।
শুক্ল বর্ণ মানে সাদা হল ভাল গুণের প্রতীক। পবিত্র গীতার চতুর্দশ অধ্যায়ের শ্লোকে আছে, ‘তত্র সত্ত্বং নির্মলাত্বাৎ’ অর্থাৎ সত্ত্ব, তমো ও রজোগুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ অতি পবিত্র গুণ। স্বচ্ছতার প্রতীক, নির্মলতার প্রতীক। আবার ওই অধ্যায়ের ১৭ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে- ‘সত্ত্বাৎ সংজায়তে জ্ঞানং’ অর্থাৎ সত্ত্বগুণে জ্ঞান লাভ হয়। তাই জ্ঞানময়ী সর্বশুক্লা দেবী শ্রী শ্রী সরস্বতী জ্ঞানে গুণান্বিত বলে তার গায়ের রঙ শুক্লবর্ণ অর্থাৎ দোষহীনা। পবিত্রতার মূর্তি আর জ্ঞানদান করেন বলে তিনি জ্ঞানদায়িনী।
পূজায় তাই থাকে শ্বেত উপাচারের ব্যবস্থা থাকে। সাদা চন্দন , সাদা ধান, সাদা ফুল। খোয়াক্ষীর, মাখন, দই , খৈ, তিলে খাজা, নারকেল কুল থাকে নৈবেদ্য। দেবীর পূজায় কাঞ্চন ফুল আবশ্যক।
মাঘ মাসের পঞ্চমীতে দেবীর আগমনের সঙ্গে নবীন বসন্তের আবাহন করা হয়। ওইদিন বঙ্গের বাহিরে নানা স্থানে প্রথম হোলিগান গাওয়া হয়। তাই দেবীকে অভ্র , আবীর এবং নতুন বাসন্তী গাঁদাফুলে পূজা করা হয়।
শ্রীধরাশ্বমুখৌ পার্শ্বদ্বয়ে বাগীশ্বরী ক্রিয়া ।
কীর্তিরলক্ষ্মীস্তথা সৃষ্টির্বিদ্যা শান্তিশ্চ মাতরঃ।।
তিনিই ব্রহ্মস্বরূপীনি বাগেশ্বরী বীণাপাণি। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে স্পষ্ট করে উল্লিখিত হয়েছে যে বাক্যই সরস্বতী। শতপথ ব্রাহ্মণেও উল্লেখ আছে – বাগ্বৈ সরস্বতী। তিনিই বাক্ শক্তি। তিনি অন্তরীক্ষ এবং অভ্যন্তরের বাক্।
অম্ভৃণ ঋষির কন্যার নামও বাক্ ছিল। তিনিই ব্রহ্মবাদিনী ছিলেন। তিনিই দেবী সুক্ত রচনা করেন। আদিত্য ঋগ্বেদের বাগনভৃণী ঋকে তাঁর ব্রহ্মদর্শনের কথা ব্যক্ত হয়েছে। অম্ভৃণীকে আদিত্য শুক্লযজুর্বেদ শিক্ষা দান করেন। বাক্ অম্ভৃণীর নিকট শিক্ষা লাভ করেন।
অহং রুদ্রেভিরিত্যষ্টর্চ্চস্য সূক্তস্য বাগম্ভৃণী ঋষিঃ সচ্চিদানন্দাত্মকঃ সর্ব্বগতঃ শ্রীআদিশক্তির্দেবতা ত্রিষ্টুপ্ছন্দো দ্বিতীয়া জগতী শ্রীজগদম্বাপ্রীত্যর্থে সপ্তশতীপাঠান্তে জপে বিনিয়োগঃ।
অহং রুদ্রেভি’ ইত্যাদি আট মন্ত্রবিশিষ্ট ঋগ্বেদীয় দেবীসূক্তের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি বাক্, যিনি মহর্ষি অম্ভৃণের কন্যা; এই সূক্তের দেবতা পরব্রহ্মময়ী আদ্যাশক্তি; সূক্তের দ্বিতীয় মন্ত্রটি জগতী ছন্দে ও অবশিষ্টাংশ ত্রিষ্টুপ ছন্দে নিবব্ধ। শ্রীজগদম্বার প্রীতির নিমিত্ত সপ্তশতী চণ্ডীগ্রন্থ পাঠান্তে দেবীসূক্তম্ পাঠ করা হয়।
ওঁ অহং রুদ্রেভির্ব্বসুভিশ্চরাম্যহমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিনোভা।।
আমি (একাদশ) রুদ্র ও (অষ্ট) বসুরূপে বিচরণ করি; আমি (দ্বাদশ) আদিত্য ও বিশ্বদেবগণের রূপে বিচরণ করি; আমি মিত্র ও বরুণকে ধারণ করছি; আমি ইন্দ্র ও অগ্নিকে ধারণ করছি; আমিই ধারণ করছি অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে।।
বাগ্ বৈ সরস্বতী …. মা ব্রহ্মময়ীই সরস্বতী। তিনিই ব্রহ্ম রূপে আমাদের কন্ঠে, হৃদয়ে, মস্তিকে বিরাজ করেন। সেই জন্যই বলা হয় –
ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম্।
ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্মসমাধিনা।।’
যে যজ্ঞে অর্পণ (অর্থাৎ যে সকল পাত্র দ্বারা যজ্ঞাদিতে বস্তু অর্পিত হয়) ব্রহ্ম, ঘৃতাদিও ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মরুপ কর্তার দ্বারা ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে আহুতি প্রদানরুপ ক্রিয়াও ব্রহ্ম, – এরূপ যজ্ঞকারী যে ব্যক্তির ব্রহ্মেই কর্ম-সমাধি হয়েছে, তাঁর উপযুক্ত কর্মের ফল প্রাপ্তিও ব্রহ্মই হয়। দেবীর কৃপা পেতে হয়ে উদাত্ত কন্ঠে তাঁকে ডাকবেন। সেই বাক্য উচ্চারণই হল দেবীর উপাসনা। বাক্যেরই নামান্তর বাণী , ভারতী , সরস্বতী। তিনি ধেনুর দুগ্ধের ন্যায় অভীষ্ট আলোক দান করেন।
বাচং ধেনুমুপাসীত….
স্বাহাকার , স্বধাকার , বষটকার, হস্তকার এই চারিটির মধ্যে যেটির উপাসনা করা হয় , তদ্রুপ ফল লাভ হয়। দেবী সরস্বতী ইড়াও বটে। তিনি একাদশ আপ্রীদেবতার মধ্যে অন্যতম। তিনি ভরত জাতির কুলদেবী। ভরত জাতি যজ্ঞপরায়ণ জাতি ছিলেন। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে –
শ্রেষ্ঠং যবিষ্ঠ ভারতাগ্নে দ্যুমন্তমা ভর।
ভরতরা যজ্ঞশীল ছিলেন তা ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, শতপথ ব্রাহ্মণ , তৈত্তিরীয় আরণ্যক ,পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ তা স্পষ্ট করে বলেছেন। দেবশ্রবা এবং দেববাত নামক দুই রাজাও সরস্বতী , আপয়া, দূষদ্বতীতীরে বাস করতেন। যেহেতু ভরতরা দেবী সরস্বতী নদীর তীরে যঞ্জ করতেন এবং তাঁদের কুলদেবী সরস্বতী ছিলেন তাই দেবী ভারতী নামেও পরিচিতা ছিলেন।
আ নো যজ্ঞং ভারতী তূরমেতু ইড়ামনুন্বদিহ চেতয়ন্তী।
তিস্রো দেবীর্বর্হিরেদং স্যোনং সরস্বতী স্বপসঃ সদস্তু।।
দেবী ভারতী শীঘ্র আমাদের যঞ্জে আগমন করুন। যেমন মনুষ্য আগমন করেন , তেমনি হে দেবী ইড়া আগমন করুন। ঋগ্বেদে সরস্বতী সুক্ত ব্যতীত আরো ৪০ টি মন্ত্রে দেবী সরস্বতীর স্তুতি আছে। সেখানে দেবী সরস্বতী ইড়া ও ভারতী নামেও অভিহিত হয়েছেন। তিনি ত্রয়ী , অগ্নির শিখা।
ইড়াদিশব্দাভিধেয়াঃ বহ্নি – মর্তয়স্তিস্রঃ…
সেই অখন্ড জম্বুদ্বীপ তথা ভারতের দেবী ব্রহ্মময়ী মা সরস্বতী , যাঁর তীরে গড়ে উঠেছিল এক সুসভ্য সভ্যতা তিনি আজও আমাদের নিকট পূজিতা। মা ব্রহ্মময়ী নানা সময় নানা রূপ ধারণ করেছেন এবং বৈদিক হতে লৌকিক নানা উপায় তিনি পূজিতা হয়ে আসছেন।
তিনি একক , তিনি মহেশ্বর ,ব্রহ্মা , বিষ্ণুর প্রত্যেকের সঙ্গে ত্রিধা হয়ে অবস্থান করেন। তিনি শ্বেতপদ্মাসনা।
পদ্মং লক্ষ্ম্য্য সরস্বত্যা ওঁ কারঞ্চ ত্রিবর্ণকম্…
জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর বাহন রাজহংস। কারণ হাঁস অসারকে ফেলে সার গ্রহণ করে। দুধ ও জলের মিশ্রণ থেকে জল ফেলে শুধু দুধটুকু গ্রহণ করে কিংবা কাদায় মিশ্রিত স্থান থেকে তার খাদ্য খুঁজে নিতে পারে। মায়ের সঙ্গে পূজিত হয়ে শিক্ষা দিচ্ছে, সবাই যেন অসার/ ভেজাল/ অকল্যাণকরকে পরিহার করে নিত্য পরমাত্মাকে গ্রহণ করে এবং পারমার্থিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
বীণার জীবন ছন্দময়। বীণার ঝংকারে উঠে আসে ধ্বনি বা নাদ। বিদ্যার দেবী সরস্বতীর ভক্তরা সাধনার দ্বারা সিদ্ধিলাভ করলে বীণার ধ্বনি শুনতে পায়। বীণার সুর অত্যন্ত মধুর। তাই বিদ্যার্থীদেরও মুখ নিঃসৃত বাক্যও যেন মধুর ও সঙ্গীতময় হয়। সেই কারণেই মায়ের হাতে বীণা। তাই দেবী সরস্বতীর আরেক নাম ‘বীণাপাণি’।
বিদ্যার্থীদের লক্ষ্য জ্ঞান অন্বেষণ। আর জ্ঞান ও বিদ্যার অন্বেষণের জন্য জ্ঞানের ভান্ডার ‘বেদ’ তার হাতে রয়েছে। সেই বেদই বিদ্যা। তিনি আমাদের আশীর্বাদ করছেন আমাদের জীবনকে শুভ্র ও পবিত্র করতে।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঋণ স্বীকার : ১. ঋগ্বেদ্
২. মার্কণ্ডেয় পুরান
৩. শ্রী শ্রী চণ্ডী
৪. সরস্বতী তত্ত্ব
৫. সরস্বতী সভ্যতার ইতিহাস