কৃষিকাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও রাসায়নিক কীটনাশক : একটি প্রতিবেদন
আজকের দিনে রাসায়নিক সার ও রাসায়নিক কীটনাশক ছাড়া চাষবাসের কথা ভাবতে গেলেই কৃষকদের মাথায় একরাশ দুশ্চিন্তার উদ্রেক হয়। ওনাদের কে বোঝানো সম্ভব হয় না যে এই রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়াই চাষবাসে এককালে ভারতবর্ষ বিশ্বে সবচেয়ে উন্নত ছিল।
রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হওয়ার পিছনে একটা বিশেষ কারণ আছে যেটা আমার ধারণা 98% শতাংশ লোকে জানেন না। বন্ধু গন একটু পিছিয়ে গিয়ে ইতিহাসের দিকে নজর ঘোরালে এর উত্তর পাওয়া সম্ভব। আসুন সেটা জেনে নেওয়া যাক আগে:-
ঠিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর সময় মানে ঐ 1939 সাল নাগাদ ইউরোপ এবং আমেরিকায় প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের মারনাস্ত্র তৈরীর জন্য ( রাসায়নিক বোমা, গোলা, বারুদ ও বোমা ) প্রচুর কারখানা গজিয়ে ওঠে । এই কারখানার তৈরী হতো উপরিউক্ত মারনাস্ত্র তৈরীর র মেটিরিয়াল হিসেবে প্রচুর কেমিক্যাল। যেমন প্যারাথিয়ান, বেঞ্জিন হেক্সাক্লোরাইড , ক্লোরোপাইরিফস, মনো ক্রোটোফস, ডাইক্রোমেট , অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট প্রভৃতি। পাঁচ বছর ধরে গোলা বারুদের বিক্রিবাটা ভালোই ছিল কিন্তু যুদ্ধ শেষ হবার পরে এই কারখানা গুলোর উপযোগিতা কমে যায়। এদিকে প্রচুর পরিমাণে র মেটিরিয়াল তখনো মজুত হয়ে আছে। শুরু হলো এক নতুন খেলা।
পৃথিবীর বুকে ঐ বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকের “র” মেটিরিয়াল এবং রাসায়নিকে নতুন রূপে পেশ করা হল রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক হিসেবে।মার্কেটে এলো ইউরিয়া, ডিএপি, সুপার ফসফেট, ডিডিটি এবং আরো বেশ কিছু কীটনাশক।
ভারতবর্ষ ও এর প্রকোপ থেকে বাঁচলো না , 1945 সালে ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে ভারতে প্রথম রাসায়নিক সার তৈরীর প্রস্তাব পাস হয়, এবং 1951 সালে অধুনা ঝাড়খন্ডে প্রথম কারখানা চালু হলো ইউরিয়া তৈরীর। সবুজ বিপ্লবের নাম করে শুরু হলো মানবসভ্যতার ইতিহাসের একটা ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা। একের পর এক কারখানা গড়ে উঠতে লাগলো ভারতবর্ষের বুকে শুধু ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ তৈরী করার। …. নচিকেতার একটা গান মনে পড়ছে বন্ধুরা ? শুধু বিষ .. শুধু বিষ দাও !!!!!
আমেরিকান এবং ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো ধীরে ধীরে এই রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ক্ষতিকারক প্রভাব যতো বেশি বুঝতে শুরু করলো ততো বেশি করে ভারতে এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই কারখানা বসাতে শুরু করলো নিজেদের দেশে বন্ধ করে দিয়ে। গালভরা নাম দিলো কৃষিতে মডার্ন টেকনোলজির ব্যবহার করে সবুজ বিপ্লবের পথে এগিয়ে চলতে সাহায্য করছি। তা সেটা ঠিক কেমন সাহায্য ? আসুন একটা উদাহরণ দিই: বন্ধুরা ভোপালের গ্যাস দুর্ঘটনার কথা মনে আছে ???
হ্যাঁ ইউনিয়ন কার্বাইড নামের কোম্পানি 1984 সালে নিজের দেশে উৎপাদন বন্ধ করে ভোপালের ঘন বসতি পূর্ণ এলাকায় চালু করে 777 নামক কীটনাশক তৈরীর কারখানা। কিন্তু ঐ কারখানার গ্যাস চেম্বার ফেটে যাওয়ায় একরাতে ঐ ক্ষতিকর গ্যাসের প্রভাবে মারা যায় 17000 লোক, একলাখের উপর লোকে বিকলাঙ্গ হয়ে যায় , এমনকি এখনো পর্যন্ত ঐ এলাকায় নর্মালের থেকে বেশী সংখ্যক বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়। ভয়াবহতা টা বুঝতে পারছেন ?
আজকের দিনে ভারতবর্ষের বুকে প্রতিবছর 90 মেট্রিক টনের বেশি পাউডার ফর্মে বিষ উৎপাদন হচ্ছে আর এক কোটি লিটারের উপর লিকুইড ফর্মে বিষ উৎপাদন হচ্ছে….. কাদের জন্য ? কিসের জন্য ? আজ্ঞে হ্যাঁ ভারতের কৃষকের জন্য এবং ভারতের কৃষিজমির জন্য। আমি আপনি সুরক্ষিত কি ?
এবার আসুন একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার জানি একটা সমীক্ষা বলছে এই যে পরিমাণ সার ও বিষ উৎপাদন হচ্ছে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য , প্রয়োগ করা সার ও বিষের 4-10% আসলে গাছের কাজে লাগে বাকি সব মাটিতে মিশছে। পরিনাম কি ? মাটিতে বসবাস কারী লক্ষ লক্ষ জীবাণু ও কেঁচো মারা যাচ্ছে এবং ফসলের মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন অল্প অল্প করে বিষ আমাদের শরীরে ঢুকছে। ভারতে যতো পরিমাণ এই বিষ উৎপাদন হয় তাকে ভারতের জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে দাঁড়ায় প্রায় 200 মিলি বিষ ( বছরে)। হ্যাঁ আমরা প্রত্যেকেই নিজের অজান্তেই এই পরিমাণ বিষ পান করছি বছরে অঙ্কের হিসেবে।
আরো একটা দিক এই বিষ প্রয়োগের সময় ভারতীয় চাষীরাও দারুন ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, বিষ স্প্রে করতে গিয়ে কতো চাষী মারা যাচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই , এই প্রসঙ্গে একটা সংবাদ পত্রের হেডিং মনে পড়ছে , ” স্বাস্থ্যের কারণে 7000 দরিদ্র”। আরো একটা তথ্য দিই ভারতের সব রাজ্যের মধ্যে পাঞ্জাবে সবথেকে বেশি রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার হয় , পাঞ্জাবের ভাতিন্ডা , লুধিয়ানা , অমৃতসর এলাকায় সবথেকে বেশি এবং উল্লেখযোগ্য ভাবে এই এলাকায় ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও সবথেকে বেশি। অমৃতসর থেকে রাজস্থানের বিকানীর অবধি একটা ট্রেন চালু আছে যার নাম ক্যান্সার এক্সপ্রেস। আর ভারতবর্ষের বুকে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস , হার্টের অসুখের রোগীদের বিপুল সংখ্যক বৃদ্ধির দ্বিতীয় কারণ খোঁজার দরকার নেই বন্ধুগন।
তো এই যে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার এর আর কি এফেক্ট আছে ? আছে বন্ধু আছে, কোম্পানি আরো একটা ফ্রী উপহার রেখেছে আপনার জন্য ( ট্রেনে , বাসে হকারদের মুখে শুনেছেন তো ? )…. দিন কে দিন আপনার জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। সবুজ বিপ্লবের নামে সারা কীটনাশক ব্যবহার করা জমি গুলো দিন কে দিন পতিত জমিতে পরিনত হচ্ছে , পাঞ্জাব , হরিয়ানা , উত্তর প্রদেশ , মহারাষ্ট্রের হাজার হাজার বিঘা জমি পতিত জমিতে পরিনত হচ্ছে। এখানেই শেষ ? না বন্ধু কোম্পানির অফার এখানেই শেষ নয়…. যতো বেশি রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বাড়বে ততো বেশি জমিতে জলের সেচ বেশি দিতে হবে। একবছর একটু বৃষ্টি কম হলে চাষী দের মৃত্যু মিছিল মনে পড়ছে নিশ্চয়ই !! এখানেই শেষ ?? …. আজ্ঞে না স্যার , কোম্পানির আরো অফার আছে…. প্রকৃতি কে না বুঝলে প্রকৃতি বড়ো নিষ্ঠুর। প্রতিবছর নিত্য নতুন পোকা মাকড় জন্ম নিচ্ছে, পেস্টিসাইডের মোকাবিলা করতে ঐ সব পোকামাকড়ের জিন গত পরিবর্তন ঘটছে তাই ওদের কে মারতে আরো বেশি মাত্রায় বিষ প্রয়োগ করতে হচ্ছে ( বাড়িতে আরো অ্যাডভান্সড ডবল পাওয়ারের মসকুইটো লিকুইডেটারের কথা মনে পড়ছে ? ) , সুতরাং উৎপাদন একই রাখতে চাষের খরচ দিন কে দিন বাড়ছে।
আরে ভাই অ্যাতো ক্ষন ধরে খালি নেগেটিভ শুনিয়ে শুনিয়ে ভয় ধরিয়ে দিলে তো ভাই …. এই নেক্সাস থেকে মুক্তি পাওয়ার কি কোনো উপায় আছে ? …. হ্যাঁ বন্ধুরা আছে , আমাদের পাশের রাজ্য সিকিম এটা করে দেখিয়েছে। আসুন সবাই মিলে সিকিম কে ফলো করি একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য।