আজাদি কা মতলব কেয়া?

১৯৯০’এর ১৯শে জানুয়ারি একদিনে ঘটে নি।

তার আগের বছর থেকেই ফারুখ আবদুল্লা সরকার সেখানকার কুখ্যাত জঙ্গীদের জেল থেকে ছাড়তে শুরু করে। অন্তত ৭০ জন জঙ্গী ১৯৮৯’এর জুলাই থেকে নভেম্বরের মধ্যে জেল থেকে ছাড়া পায়।

কাশ্মীরী পণ্ডিতদের নিহত হওয়াটা তখন যেন শুধুই সময়ের অপেক্ষা। এবারে গোটা কাশ্মীর জুড়ে বেছে বেছে নামজাদা পন্ডিতদে’র চিহ্নিত করে হত্যালীলা আরম্ভ হল।   

বিজেপি নেতা এবং প্রখ্যাত সমাজসেবী শ্রী টিকালাল টাপলো’কে প্রকাশ্য দিবালোকে নিম্ন শ্রীনগরে হত্যা করা হল। গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হলেন জাস্টিস নিলাকান্ত গাঞ্জো। ঘন্টার পর ঘন্টা তার সেই শবদেহ রাস্তায় পড়ে রইল। দক্ষিণ কাশ্মীরের অনন্তনাগে এডভোকেট প্রেমনাথ ভাট’কে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাবে মারা হল। আরও যে কত মানুষ এইভাবে নিহত হলেন কে জানে?    

১৯৯০’এর ৪ঠা জানুয়ারি, …. হিজবুল মুজাহিদিন-এর আফতাব একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে ঘোষনা করলেন, – সমস্ত হিন্দুদের কাশ্মীর ছাড়তে হবে। আল-সাফা বলে অন্য একটি সংবাদপত্রেও একই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হল। ক্রমশঃ পন্ডিতদের ঘরের দরজায় দরজায় কাশ্মীর ছাড়ার নোটিশ লটকানোর প্রক্রিয়া শুরু হল।   

তখন উপত্যকা জুড়ে শুধু একটাই আওয়াজ, …. “পণ্ডিত মুক্ত কাশ্মীর”। লক্ষ লক্ষ কাশ্মীরী মুসলমান তখন টগবগ করে ফুটছে। রাস্তায় রাস্তায় এবং উপত্যকা জুড়ে এমন মিছিল আর স্লোগান, … এই কাশ্মীর আগে কখনও দেখেনি। কাশ্মীরের সমস্ত মসজিদ একসঙ্গে ঘোষনা করল যে, কাশ্মীর’কে পাকিস্তান বানাতেই হবে। মুজাহিদিন’দের উজ্জীবিত করে, এমন সব গান সর্বত্র বারবার বাজতে থাকে।         

“জাগো জাগো সুভা হুই;
রুশ নে বাজী হারি হ্যাঁয়,
হিন্দ পর লারজান তারে হ্যাঁয়,
আব কাশ্মীর কি বারি হ্যাঁয়” …।। 

(“ওঠো, জাগো, রাশিয়ার পতন হয়েছে। ভারতও চলেছে সেই পথেই, সময় এসেছে কাশ্মীর’কে স্বাধীন করার” …. ।।)
 
“হাম কেয়া চাহতে …?
স্বাধীনতা” … ।
(আমরা স্বাধীনতা চাই …।।) 

“আজাদি কা মতলব কেয়া?
লা ইল্লাহ ই লাল্লাহ … 
(স্বাধীনতা’র অর্থ লা ইল্লাহ ই লাল্লাহ…।)

“আগর কাশ্মীর মে রেহেনা হোগা, আল্লাহ-উ-আকবার কেহেনা হোগা।
(কাশ্মীরে থাকতে হলে আল্লাহ-উ-আকবার বলতে হবে।) 

“এ জালিমো, এ কাফিরো, কাশ্মীর হামারা ও ছোড় দো”…।
(ওরে পাষন্ড, ওরে কাফের আমাদের কাশ্মীর ছেড়ে পালা…।)

“ইঁহা কেয়া চলেগা …?
– নিজাম-ই-মুস্তাফা…” 
( আমরা চাই এই কাশ্মীর পাকিস্তান হোক, যেখানে পণ্ডিতরা না থাকলেও থাকবে তাদের মেয়েরা …।। )

….নিশ্চিত আসন্ন মৃত্যুও কাশ্মীরী পন্ডিত’দের ততটা ভয় দেখাতে পারে নি, যতটা তারা আতঙ্কিত হলেন এই শেষ স্লোগানটির মর্মার্থ অনুধাবন করতে পেরে। 

এবং তাদের বার্তাটি ছিল সুস্পষ্টঃ “ রালিভ, গালিভ ইয়া চালিভ” …  (এসো আমাদের সঙ্গে, মরো … কিংবা মুক্ত হও…।)

অতয়েব নিজেদের সম্মান ও জীবন বাঁচাতে, তখন হাতের কাছে যে যা পেলেন তাই নিয়েই বেশীরভাগ পন্ডিত-ই তাদের বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে পড়িমরি করে পালাতে শুরু করলেন। যেনতেন প্রকারেন সেখান থেকে পালাবার জন্য তাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। ট্রাক-লরির ক্যানভাসের ছাউনীর আড়ালে, বাস কিংবা ভাড়ার ট্যাক্সিতে চড়ে শুরু হল পণ্ডিতদের ঘর ছেড়ে পালানোর নির্মম কাহিনী। শুরু হল কাতারে কাতারে হিন্দুর উপত্যকা ত্যাগের রক্তাক্ত ইতিহাস।         

সরকার, গোয়েন্দাবাহিনী, সেকুলার মানুষজন, দেশ রক্ষকদের বিবেক … সবাই রইলেন নিরুত্তর! একটি শব্দ ভুলেও কেউ উচ্চারণ করলেন না।

সেই বীভৎস অত্যাচারের নমুনা জানতে চান? চোখ ফুঁড়ে দেওয়া, যৌনাঙ্গ ছিন্নভিন্ন করা থেকে শুরু করে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে শরীর পুড়িয়ে দেওয়া কিংবা টুকরো টুকরো করে কেটে উপত্যকা জুড়ে কাশ্মীরী পন্ডিত’দের হত্যা শুরু হল।  

বিখ্যাত কাশ্মীরী শিক্ষাবিদ, সর্বানন্দ কাউল প্রেমী প্রতিদিন যেখানে তিলক পরতেন, কপালের ঠিক সেই অংশে হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠুকে তাঁকে হত্যা করা হল।

বি কে গাঞ্জোকে তার বাড়ীতে খুন করে সেই রক্ত মাখানো ভাত খেতে নির্দেশ দেওয়া হয় তাঁর সদ্যবিধবা পত্নী’কে।  


নার্স শ্রীমতী সরলা ভাট’কে গনধর্ষন করে তাঁর উলঙ্গ  মৃতদেহটিকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলা হয়।

মাট্টানের রবীন্দর পন্ডিতা’র শবদেহের উপর আততায়ীরা আনন্দে নৃত্য করে।

সোপিয়ানে শ্রী ব্রিজলাল ও ছোটি’র মৃতদেহকে জীপের সঙ্গে বেঁধে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। 

বন্দীপুরার স্কুলশিক্ষিকা শ্রীমতী গিরজা টিক্কো’ও নৃশংস ভাবে মৃত্যুবরণ করার আগে কাশ্মীরীদের হাতে গণধর্ষনের শিকার হন।
  


বিট্টা কারাটে নামের এক কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী ২০ জনেরও বেশি পন্ডিত হত্যা করলেও তার মধ্যে কোন তাপ-উত্তাপ পরিলক্ষিত হয় না। শুধু তাই নয়, তাকে অত্যন্ত গর্বের সঙ্গেই এই কথা সর্বত্র বলে বেড়াতে দেখা যায়।

জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট-ই (JKLF) ছিল ১৯৯০’এর সেই ব্যাপক ও অভিশপ্ত হিন্দু গণহত্যার জন্য অধিকাংশে দায়ী। কাশ্মীরের হাজার হাজার পন্ডিতেরা সেদিন নিহত হয়েছিলেন। হয়েছিলেন পাশবিক ভাবে ধর্ষিতা বা অত্যাচারিতা…।।
     


এইভাবেই শুরু হওয়া কাশ্মীর হিন্দুশূন্য হবার প্রক্রিয়া ধারাবাহিকভাবে চলতেই লাগল এবং ১৯৯১’এর মধ্যেই অধিকাংশ পন্ডিত উপত্যকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলেন।   

সন্ত্রাসবাদী এবং কাশ্মিরী মুসলমানেদের একটি বৃহৎ অংশ কাশ্মীরের অমুসলিম জনগোষ্ঠী’কে উচ্ছেদ করার পাশাপাশি লাগাতার তাদের মঠ, মন্দির তথা দেবস্থান অপবিত্র ও লুঠপাট করে, তাতে অগ্নি সংযোগ করতেও কুন্ঠিত হয় না। হাজার হাজার পণ্ডিতদের বাড়ি-ঘর এবং শ’য়ে শ’য়ে মন্দিরে আগুন লাগিয়ে সম্পূর্ন ধ্বংস করে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ধীরে ধীরে সেই সমস্ত ভূ-সম্পত্তি গ্রাস করে নেওয়া হয়। এই সবকিছুই ঘটে একটি বিবিধসংস্কৃতি সম্পন্ন ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষের বুকে! কিন্তু ভারতীয় সেকুলারদের কি আদৌ সেইদিকে তাকাবার কোন অবকাশ ছিল?         

তবে এখানেই সব শেষ নয়। পাকিস্তানের মদতপুষ্ট জঙ্গিদের তখনও কিছু কাজ হয়তো অবশিষ্ট ছিল। তাদের খুনের অতৃপ্ত বাসনা সম্ভবত তখনও সম্পূর্ন নিবৃত্ত হয় নি। তাদের আরও প্রচুর সংখ্যায় হিন্দু পন্ডিতকে হত্যা করা প্রয়োজনীয় ছিল। তাই পরবর্তীকালে হিন্দু জনগোষ্ঠী’র এই অসহায় মানুষগুলো আরও সাত-সাতটা ব্যাপক গণহত্যার সম্মুখীন হয়েছেন। পাষণ্ডের দল এমনকি দু’মাসের শিশুকে অবধি ছাড়ে নি। পন্ডিত’দের সবক’টি গ্রাম-ই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। কাশ্মীরের বুক থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে তাদের নাম ও নিশানা।

কিন্তু না, সেইজন্য একফোঁটা চোখের জলও কারো ঝরে নি। কেউ ফেরৎ দেন নি কোন পুরস্কার, বেরোয় নি কোন প্রতিবাদী মিছিল। সমগ্র একটি জাতীর উপরে এমন দানবীয় হত্যার নিন্দা করে কোন ফিল্মস্টার মিডিয়ার নিউজ বুমে কোন বাইট-ও দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নি।           

আর, আজও যদি আমরা পিছন ফিরে তাকাই, দেখব একজন ব্যক্তিকেও এর জন্য দোষী সব্যস্ত করা হয় নি। ভয়াবহ এই হত্যালীলার একটি কুচক্রী’র-ও কোনও সাজা হয় নি, যেখানে রক্তাক্ত হয়েছে হাজারেরও বেশি অসহায় নিরাপরাধ কাশ্মিরী পন্ডিতের প্রান …!!

এর জবাব চাইবার সময় কি এখনও আসেনি বন্ধু …??

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.