কলেজের বাইরে থেকে গিয়ে মূর্তি ভাঙা সম্ভব নয়

বিদ্যাসাগর কলেজের মূর্তি ভাঙার ঘটনা। বিশ্লেষণ করতে হলে কলেজের অবস্থানগত চিত্রটি আগে পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে। কলেজটির দুটি প্রবেশ পথ, একটি শঙ্কর ঘোষ লেনে, দ্বিতীয়টি বিধান সরণির উপর। প্রথমটি মেন ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচিত এবং দ্বিতীয়টি হস্টেল ক্যাম্পাস। বিধান সরণির এই ক্যাম্পাসের পাশেই রয়েছে কলকাতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’হস্টেল। এই দুই ক্যাম্পাসই পিছনের দিক থেকে সংযুক্ত বা এরকমও বলা যেতে পারে কলেজ বিল্ডিংটিশঙ্কর ঘোষ লেনে শুরু হয়ে বিধান সরণিতে এসে শেষ হয়েছে। গত ১৪ মে মূর্তি ভাঙার যে লজ্জাজনক ঘটনাটি ঘটেছে সেটি কলেজের বিধান সরণি ক্যাম্পাসে। ঘটনার পর তৃণমূল ও বিজেপি পরস্পরের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে। আমরা সেই দিকে না গিয়ে কিছু সম্ভবনা নিয়ে আলোচনা করব।
বিদ্যাসাগর কলেজের বিধান সরণি ক্যাম্পাসে ঢুকতে হলে প্রথমে একটি লোহার গেট পেরোতে হয়। সেখানে সামনের বাকি জায়গাটা লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। এই লোহার গেটটি সাধারণত বন্ধই থাকে। কেবলমাত্র শিক্ষক ও কলেজের অন্য কর্মীদেরই কলেজে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় এই গেট দিয়ে। ছাত্র-ছাত্রীদের ঢোকার জন্য ব্যবহার হয় শঙ্কর ঘোষ লেনের গেট। বিধান সরণি ক্যাম্পাসের লোহার গেটটি পেরোলেই কলেজ বিল্ডিং। বিল্ডিংয়ের সামনের দিকে তিনটি কাঠের দরজা (ছবি দেখলে বোঝা যাবে)। যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হয় মাঝের দরজাটি, যেখানে কাঠের পাল্লার পাশাপাশি লোহার কোলাপসিবল রয়েছে। বাকি দুটি দরজা বন্ধ থাকে, কস্মিনকালেও খোলা হয় না। সেই মাঝের দরজা দিয়ে কলেজ বিল্ডিংয়ে ঢুকলে একটা বড়ো ঘরে ডানদিকে বিদ্যাসাগরের আবক্ষ সাদা মূর্তি ডেক্সের উপর কাচের ঘেরাটোপে রয়েছে।
ঘটনার পরের দিন যে ভিডিয়োগুলি সামনে এসেছে তাতে একটিতে দেখা যাচ্ছে বিল্ডিংয়ের বাইরে রেলিং দিয়ে ঘেরা জায়গায় দুষ্কৃতীরা মূর্তির কিছু অংশ মাটিতে আছড়ে ভাঙছে। সেই সময় মাঝের যাতায়াতের মূল দরজাটি কিন্তু বন্ধ ছিল, এবং আশ্চর্যজনকভাবে খোলা রয়েছে পাশের একটি দরজা। যেটি সব সময় বন্ধ থাকে এবং তা কোনওভাবেই খোলা থাকার কথা নয়। এবার প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি ভেতর থেকেই দরজাটি খোলা হয়েছে? কারণ, সামনের দরজা ছাড়াও ওই বিল্ডিংয়ে ঢোকা যায় একেবারে পিছনের লাইব্রেরি দিয়ে। বাইরে থেকে গিয়ে কারো পক্ষে সেখান দিয়ে বিল্ডিংয়ে ঢোকা সম্ভব নয়। কারণ গোলকধাঁধাময় এই প্রাচীন কলেজে ছাত্ররাই অনেক সময় পরীক্ষার হল খুঁজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। তৃণমূল কংগ্রেসের দেখানোভিডিয়ো ফুটেজ অনুযায়ী যদি ধরেও নেওয়া যায় যে বহিরাগতরা বাইরের লোহার গেট ভেঙে কলেজ ক্যাম্পাসে। ঢুকেছে তাহলেও কিন্তু তাদের পক্ষে বিল্ডিয়ের ভিতরে ঢুকে বিদ্যাসাগরের মূর্তি পর্যন্ত পৌঁছানো কোনো ভাবেই সম্ভব নয়।
এবার আসি অন্য কিছু প্রসঙ্গে। সংবাদমাধ্যমের সেই মুহূর্তের খবর অনুযায়ী বিজেপির শান্তিপূর্ণ মিছিলে প্রথমে কলেজের ভিতর থেকেই ইট, বোতল ছোঁড়া হয়। এখন প্রশ্ন হলো, রাজনীতির লাভ তোলার জন্য কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা সঙ্গত ? বিজেপির মতো একটি সর্বভারতীয় সংগঠনের সভাপতির রোড শো’তে কালো পতাকা কেউ দেখাতেই পারে, কিন্তু ইট-পাটকেল নিয়ে আক্রমণ কেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, বিদ্যাসাগর কলেজের সান্ধ্যকালীন পঠনপাঠন হয় শঙ্কর ঘোষ লেনের ক্যাম্পাসে। তাহলে সন্ধ্যে সাতটার পরও বিধান সরণি ক্যাম্পাসে কারা ছিল? বিকেল পাঁচটায় কলেজ ছুটি হওয়ার পরেও অনেক সময় শিক্ষক-শিক্ষিকারা থেকে যান। কিন্তু তাঁরা নিশ্চয় মিছিলকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোঁড়েননি। এর সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে আরেকটি প্রশ্ন, কলেজ বিল্ডিংয়ের গায়েই গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা। শিক্ষক-শিক্ষিকারা কলেজে থাকলে সেখানে নিশ্চয় তাদের গাড়িও ছিল। তাহলে গাড়ি ভাঙচুরের কোনো ঘটনা এখনও সামনে এলো না কেন? বাইরের আক্রমণকারীদের সহজ লক্ষ্য হতে পারত সেই গাড়িগুলি। ঘটনার পরেই বহু বিজেপি কর্মী আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বিজেপিই যদি আক্রমণকারী হয় তাহলে তৃণমূলের কেউ আহত হলো না কেন? তৃণমূল ছাত্র পরিষদের যে ছাত্রদের আহত বলে দেখানো হয়েছে তাদের মধ্যে তৃণমূল ছাত্রনেতা তীর্থপ্রতীম সাহা ইতিমধ্যে স্বীকার করে নিয়েছেন তার হাতে চোট লেগেছিল চার দিন আগে। অভিষেক মিশ্র নামে আরও এক প্রাক্তন ছাত্র তাঁর স্ত্রী স্বর্ণালী-সহ আহত হওয়ার যে দাবি করেছেন তাদের কথার মধ্যেও অসঙ্গতি রয়েছে। অভিষেক মিশ্র ও স্বর্ণালী দাবি করেছেন তাঁরা কলেজে মার্কশিট তুলতে এসেছিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য হলো কলেজের নিয়ম বেলা তিনটের পর থেকে অফিস ছুটির আগে পর্যন্ত প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের সার্টিফিকেট, মার্কশিট দেওয়া হয়। তাহলে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত তারা কলেজে কী করছিলেন?
কলেজের অনেক শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী দাবি করেছেন যে, বহিরাগতরাই মূর্তি ভেঙেছে। কিন্তু তাঁদের বয়ান ও সেখানকার বাস্তবতার মধ্যে বিস্তর ফারাক। যে ঘরে বিদ্যাসাগরের মূর্তি রয়েছে সেই ঘরের সঙ্গে বাকি ঘরের যোগ লম্বা একটা করিডোরের মাধ্যমে। অর্থাৎ সেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে ঘরে কী হচ্ছে তা কোনো ভাবেই দেখা সম্ভব নয়। তাঁদের দাবি গণ্ডগোল শুরু হতেই তারা সিড়ি দিয়ে উপরে পালিয়ে যান। একই দাবি করেছেন কেয়ারটেকারও। তাহলে মূর্তি কে ভাঙলো তা তাঁরা দেখলেন কীভাবে? প্রথম যে ভিডিয়োটি প্রকাশ হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে কয়েকজন ভাঙা মূর্তির কিছু অংশ বিল্ডিংয়ের বাইরে এনে আছড় মারছে। এখানে প্রশ্ন হলো, যে ঘরে মূর্তি থাকে সেই ঘরটি যথেষ্টবড়ো, বাইরের লোকেদের ভিতরে ঢুকে মূর্তি ভাঙাই যদি উদ্দেশ্য হয় তাহলে তারা সেই কাজটি ভেতরেই করতে পারত, বাইরে কেন? সেই ভিডিয়োতেই আরও একজন বিতর্কিত চরিত্র আবির্ভাব হয়েছে। হলুদ পঞ্জাবি পরিহিত এক যুবক। ঘটনার সময় সেই যুবককে ভাঙচুর করতে দেখা গেছে, আবার পরে তাকেই দেখা গেছে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে। সেই যুবক কে?
এত প্রশ্ন, ঘটনার মধ্যে এত অসঙ্গতি পুরো ব্যাপারটাকেই একরকম ধোঁয়াশায় পরিণত করেছে। এখন সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন ওই ঘরে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলেও ঘটনার ভিডিয়ো ফুটেজ এখনও প্রকাশ হচ্ছে না কেন? তাহলে কী দোষীদের আড়াল করা হচ্ছে? বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন রকমের যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তবে এখনও পর্যন্ত একটি বিষয় নিশ্চিত বাইরে থেকে গিয়ে কারো পক্ষে কলেজের ভিতরে ঢুকে মূর্তি ভাঙা কোনও ভাবেই সম্ভব নয়।
সুকল্যাণ রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.