আমরা বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন মনে রেখেছি। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে রাষ্ট্রসঙ্ঘের স্বীকৃতিও পেয়েছে। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে যাঁরা শহিদ হয়েছিলেন, তাদের অবশ্যই শ্রদ্ধা জানাই, প্রণাম জানাই। যদিও পূর্ব পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে যিনি প্রথম সরব হয়েছিলেন, তার নাম ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তার নাম অনেকেই ভুলে গেছেন। এই মানুষটি বাংলাভাষার সম্মান। রক্ষার্থে পশ্চিম পাকিস্তানের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলাভাষার জন্য সোচ্চার হয়েছিলেন। এই অপরাধে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে পাক সরকার জেলবন্দি করে এবং পুত্রসমেত তাকে হত্যা করে। ধীরেন্দ্রনাথকে যেমন বাঙ্গালি ভুলে গেছে, তেমনি ভুলে। গেছে শিলচরে শহিদ হওয়া সেই এগারজন বাংলাভাষী । মানুষের কথা যাঁরা মাতৃভাষার জন্য পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিলেন ১৯৬১ সালের ঊনিশে মে।
১৯৬০ সালে অক্টোবরে অসমের বিধানসভায় তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বি.পি. চালিহা একটি আইনের প্রস্তাব রাখেন। অক্টোবর মাসেই প্রস্তাবটি আইনের রূপ পায়। ওই আইনটির দ্বারা অসমীয় ভাষাকে অসম প্রদেশের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অসমের বরাক ভ্যালির কাছাড়, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জ এই তিনটি জেলার অধিকাংশ মানুষ তখনও বাংলাভাষী, আজও তাই। তা সত্ত্বেও অসম সরকার অসমীয় ভাষাকে একমাত্র প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৫৬ সালে যে States Reorganization Act পাশ করানো হয়। পার্লামেন্টে, তাতে পরিষ্কার বলা আছে যে, যদি কোনও প্রদেশে শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ একটি বিশেষ ভাষায় কথা বলে, তাহলেই শুধু ওই প্রদেশটি Single-lingual বা । একভাষী প্রদেশ হিসেবে গণ্য হবে। অসমের পরিস্থিতি ছিল। এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তা সত্ত্বেও অসম সরকার এটা করেছে। দেশের আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে।
নিউটনের তত্ত্ব অনুযায়ী প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান। এবং বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়া হয়। স্বাভাবিক ভাবেই সরকারের ওই হঠকারী। সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ সমগ্র বাংলাভাষী বরাক। ভ্যালিতে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। এটা মেনে নিতে বাঙ্গালি রাজি ছিল না, তাই প্রতিবাদের। ঝড় ওঠে। তখন কাছাড় জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল তিনটি মহকুমা বা ব্লক, যথাক্রমে করিমগঞ্জ, শিলচর হাইলাকান্দি। করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি আশির দশকে ডিস্ট্রিক্টের মর্যাদা পেয়েছিল। এটা অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ।
‘কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ ১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গঠিত হয়। এই পরিষদ আন্দোলন শুরু করে। সভাসমিতি, র্যালি, পদযাত্রা ইত্যাদির মাধ্যমে জনমত। গঠনের কাজ পুরোদমে চালিয়ে যায়। এটা ছিল বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রাম, বাঙ্গালির ন্যায্য দাবির, ন্যায্য অধিকার রক্ষার সংগ্রাম। বাঙ্গালির এই আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ। গণতান্ত্রিক, শান্তিপ্রিয় এবং অবশ্যই নিরস্ত্র সংগ্রাম।
গণসংগ্রাম পরিষদের সর্বসম্মত নেতা ছিলেন রথীন্দ্রনাথ সেন। তিনি ঘোষণা করেন যে তাদের দাবি না মানলে ঊনিশে মে বারো ঘণ্টার একটি বন্ধ (তখন বলা হতো ‘হরতাল) করা হবে। তাদের দাবি ন্যায়সঙ্গত শুধু নয়, আইনসঙ্গতও বটে। বাংলাভাষাকে । যথার্থ স্বীকৃতি দিতে হবে, অসমীয় ভাষা থাকুক, সেই সঙ্গে বাংলা ভাষাকেও অন্যতম প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে গণ্য করতে হবে।
ঊনিশে মে পরিষদ যাতে কিছু করতে না পারে, তাই অসম সরকার আগের দিন থেকেই ব্যাপক ধরপাকড় চালাতে থাকে। জনে জনে। জিজ্ঞাসাবাদ, বাঙ্গালিদের থানায় নিয়ে গিয়ে জেরায় জেরায় জেরবার করা। এক কথায় চরম অগণতান্ত্রিক কাজকর্ম সরকার শুরু করে দেয়। শুধুই বাংলা। ভাষাকে স্বীকৃতি দেবে না বলে। গ্রেপ্তার হন পরিষদের নেতা রথীন্দ্রনাথ সেন, নলিনীকান্ত দাস এবং আরও নেতৃস্থানীয় কয়েকজন।
ঊনিশ তারিখ সকাল থেকেই সরকার যেন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে নেয়। সকাল সকাল দেখা গেল পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। শুধু পুলিশ ? প্যারামিলিটারি ফোর্স নেমে গেল। রাস্তায় রাস্তায় টহল দিতে শুরু করল বরাক উপত্যকা জুড়ে। সমস্ত যান-চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রেলের ‘চাক্কা জ্যামের’ পরিকল্পনা ছিল। আন্দোলনকারীদের। সেই অনুযায়ী তারা সকাল সকাল শিলচর স্টেশনে গিয়ে সত্যাগ্রহ শুরু করে। ইঞ্জিনের । সামনে তারা বসে পড়ে। রেল অবরোধ শুরু হয়ে যায়। আন্দোলনকারীদের । ছিল জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য প্রতিজ্ঞা তারা নিজেদের প্রাণের কথা ভাবেনি। ‘বাংলা ভাষাকে অসম্মানিত হতে দেব ’, এই ছিল তাদের মনের কথা, প্রাণের কথা। পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস অবাধে চলল, কিন্তু আন্দোলনকারীদের দমানো গেল না। তারা ছিল বাংলাভাষার সহাসী-সৈনিক, অদম্য ছিল তাদের প্রাণশক্তি।
পুলিশ এরপর মরিয়া হয়ে জালিয়ানওয়ালাবাগের রাস্তা নেয়। সম্ভবত জেনারেল ডায়ারের মতো ওই পুলিশদের নেতৃত্বে কেউ ছিল, তাই বিনা প্ররোচনায় কতগুলি নিরস্ত্র বাঙ্গালি আন্দোলনকারীর শরীর তা করে গুলি চালাতে শুরু করে। রক্তে ভেসে যায় শিলচর রেলস্টেশন, রেলপথ। ওই বিবেকহীন, মনুষ্যত্বহীন সরকারের পদলেহনকারী পুলিশ সেদিন গুলি ছুঁড়তে দ্বিধা করেনি। ঝাকে ঝাকে গুলি এসে লাগে। আন্দোলনকারীদের শরীরে। ঘটনাস্থলেই নিহত হয় নয়জন। পরে। আরও দুইজন। মোট এগারোজন শহিদ হয় বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য। এই শহিদের মধ্যে একটি ছাত্রীও ছিল, যার বয়স ছিল ষোলো। নাম কমলা। ভট্টচার্য। বাংলাভাষার জন্য ভারতের প্রথম মহিলা শহিদ কমলা। তার নাম আমরা কজন জানি ? সেদিন আর যাঁরা শহিদ হন, তাদের নাম যথাক্রমে শচীন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব, সুকমল পুরকায়স্থ, কানাইলাল নিয়োগী, হিতেশ বিশ্বাস, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, কুমুদ দাস, সুনীল সরকার ও তরণী দেবনাথ।
তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। জওহরলাল নেহরু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। বাঙ্গালি কোনওদিনই জওহরলাল নেহরুর কাছ থেকে যথোচিত মর্যাদা পায়নি। বাঙ্গালির আত্মবলিদানের স্বীকৃতি, বাঙ্গালির প্রতিভার স্বীকৃতি, বাঙ্গালির ন্যায্য দাবির স্বীকৃতি নৈব নৈব চ। পরে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর উদ্যোগে বরাক ভ্যালিতে স্কুল-কলেজের সিলেবাসে ও প্রাদেশিক সরকারের কাজেকর্মে বাংলাভাষা মর্যাদা প্রাপ্ত হয়।
অবিস্মরণীয় সঙ্গীতশিল্পী প্রয়াত কালিকাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন—“ঊনিশে মে আমার কাছে আত্মপরিচয়ের আর এক নাম। শুনেছি ওই ঘটনার পরদিন বহু জায়গায় অরন্ধন পালিত হয়—আমি চাই প্রচারমাধ্যম ও দলমত নির্বিশেষে সকলে এই দিনটির ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে এগিয়ে আসুন।”
বাঙ্গালি আত্মবিস্মৃত জাতি। কিন্তু এই ঐতিহাসিক মর্মান্তিক ঘটনার কথা যদি আমরা ভুলে যাই, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।
এ প্রসঙ্গে কবিতার উল্লেখ সেদিনের পরিস্থিতিকে বুঝতে সাহায্য করবে :
“কম্লি মা রে, চললি কোথায় শুনলি কথা?
ফিরতে যদি হয়রে দেরি ভাত খেয়ে যা।
‘মা রে আমার যাচ্ছি আমি ভাষার ডাকে,
বাংলা ভাষা মরছে মা গো আইনি চাপে। ‘ভাতটা গরম রাখিস আমার বসবো খেতে,
আন্দোলনে অংশ নেবো সবার সাথে।
ফিরলো মেয়ে মালায় ঢাকা শরীর নিয়ে,
মে মাসেরই ঊনিশ তারিখ বুলেট খেয়ে।
পুলিশ ছিল মারবে বলে ফোর্সটা নিয়ে,
কমলি গেল বাঙ্গলা মাকে সেলাম দিয়ে।
হায় বাঙ্গালি একুশ নিয়ে গর্ব করো,
শিলচরেতে কি হয়েছিল বলতে পারো?”
ড. রমা বন্দ্যোপাধ্যায়
2019-05-24