সময় একই সাথে পরম বন্ধু!আবার খুবই নিষ্ঠুর!প্রিয় বিচ্ছেদের তীব্র যন্ত্রণার উপর ধুলোর প্রলেপ ফেলে ফেলে সময় তাকে সু-সহনীয় করে তোলে।এক সময় মানুষ সেই তীব্র মানসিক শোক ভুলেও যায়।ব্যক্তি ধীরে ধীরে সময়ের সহযোগীতায় জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসে।যে দুঃখের রাত তার কাছে অসীম-অনন্ত মনে হত,তার সমস্ত আঁচড়ের চিহ্ন সময় নিজের বুকে টেনে নেয়।বিশ্বের কোটি কোটি দুঃখ-ব্যথা-বিচ্ছেদ-শোক-সন্তাপে জর্জরিত মানুষ প্রতিদিন সময়ের সাথে বন্ধুত্বের কারণে স্বাভাবিক জীবন পেয়ে চলেছে…
সময়ের নিরন্তর প্রবাহ কেড়ে নেয় জীবনের শ্রেষ্ঠ সঞ্চয়গুলি।কালের পদপিষ্ঠ হয়ে হারিয়ে যায় উদ্ধত সৌন্দর্য,কৈশোরের লালিত্য,চঞ্চলতা,যৌবনের মাদকতা...
আবার সময় তার অসীম-অনন্ত বিস্তীর্ণ বুক থেকে হারানো চাপাপড়া ঘটনা সামনে এনে মানুষের বুকে জ্বালিয়ে দেয় আগুনের লেলিহান শিখা।মানুষ সেই পুরানো স্বর্ণাভ স্মৃতি-ঘটনাকে স্পর্শ করার জন্য হয় লালায়িত।কিন্তু তখন “সময় তো নাই ফিরবার”!…
সময় এবং প্রয়োজনের প্রবল চাপে অতি প্রিয় বস্তুকেও এক সময় বিদায় জানাতে হয়।এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই ভেঙে দিতে হল অনেক ঐতিহাসিক ঘটনামালার সাক্ষী একটি ঘর।সময় তার সকল যৌবন-সৌন্দর্য হরণ করে নিয়েছিল।প্রবল ঘূর্ণি ঝড় বৃহৎ বৃক্ষ তার উপরে ফেলে তার অস্থিমজ্জা চুরমার করে দিয়েছিল।প্রকৃতি তার সমস্ত লতা-গুল্ম-ঝোপঝাঁড় -শিকড়-পাতা বিছিয়ে দিয়ে সেই ঘরকে করে তুলেছিল অনন্য মাধুর্য মন্ডিত।বিষাক্ত কীট ও সরিসৃপদের অবাধ বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল সেই একদা লীলাচঞ্চল কোলাহল মুখর ঘর।মাকড়সার জাল,ইঁদুর ও উঁইপোকার মাটির ঢিবি,ছুঁচো-ইঁদুর-আরশোলার বিষ্ঠা,তাদের গায়ের উগ্র ঝাঁঝালো দুর্গন্ধ--সব মিলিয়ে সে-এক অতি-প্রাকৃতিক গা ছমছমে পরিবেশ !! তারও-পর ঘরের মধ্যে উদ্ভিদরা তাদের বংশ বিস্তারের জন্য শিশু বৃক্ষের জন্ম দিয়েছিল।
প্রতিটি মানুষ একান্ত ভাবেই কামনা করে তার নিজস্ব একটি ঘর।তার নিজস্ব একটি ছোট্ট পৃথিবী।যে-পৃথিবীর সর্বাধিনায়ক ব্যক্তি নিজেই।না-থাক নিজের আপনজন।না-থাক স্ত্রী-সন্তান,পিতা মাতা।না-থাক তাতে দামী বিছানাপত্র।বিদ্যুৎ-আলোর ঝলকানি !
মনোমত নিজস্ব একটি ঘরের জন্য রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু ছিলেন পিপাসিত।তাঁর অনেকগুলিই নিজস্ব ঘর ছিল।ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নানা জায়গায়,অনেক ধরণের ঘর তিনি তৈরী করিয়ে ছিলেন।তাদের বহিঃসজ্জা ও অন্তঃসজ্জাও বিভিন্ন শিল্প আঙ্গিকের! "শ্যামলী", "উদীচি,"পূনশ্চ" ইত্যাদি রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন ঘরের নাম। রবীন্দ্রনাথের "গৃহ সঞ্চয়"-এর উপর রীতিমত গবেষণা করে খেতাব অর্জন করারও সুযোগ রয়েছে।জীবনানন্দ দাশ,শিবরাম চক্রবর্তী,রবীন্দ্র সঙ্গীতের "রাজপুত্র" দেবব্রত বিশ্বাসের নিজস্ব কোনো ঘরই ছিল না।কর্মসূত্রে জীবনানন্দ ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক।দিল্লী-সহ দেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়িয়েছেন।তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা,আত্মনিমগ্ন ব্যক্তিত্ব।ইংরেজ কর্তৃপক্ষের সাথে তাঁর বনিবনা হত না মোটেও।তাই তাঁর শাস্তিমূলক বদলীও হত হামেশায়।সে-যুগে অল্প বেতনের জন্য অধ্যাপকদের সাথে কেউ মেয়ের বিয়ে দিতে চাইতেন না বেতন কমের জন্য! সে-কারণেই জীবনানন্দের নিজস্ব ঘর কোথাও হয় নি!শিবরাম আর দেবব্রত ছিলেন ভবঘুরের মতো শহর কলকাতার গলিরও তস্য গলিতে তাঁরা ভাড়া থাকতেন! বাংলা সাহিত্যের তিন "বন্দ্যো" মানিক-বিভূতিভূষণ ও তারাশঙ্কর কলকাতায় ভাড়াতেই থাকতেন। প্রত্যেকেই নিজ নিজ ঘরের জন্য আজীবন পিপাসিত থেকে গিয়েছেন।নিজ ঘর--নিজেরই একান্ত মহাবিশ্ব !! একাধিক মহাপৃথিবীর সমাহার যেন !
বয়সের জরাজীর্ণতা ও প্রয়োজনের তাগিদে যে-ঘর ভাঙা পড়ল,সেটা নামকরা কোনো ব্যক্তির,নামকরা কোনো ঐতিহাসিক স্থাপত্য বা নামকরা স্থানের অট্টালিকা নয়।নেহাতই ছা-পোষা এক ভেতো ও ভীতু বাঙালীর ততোধিক একটা কাঁচা ঘর।যার বংশ কৌলিন্য বা সৌন্দর্যশিখা–কিছুই ছিল না।তাই তার পরিচিতিও নেই ! তবে,এই ঘরটি তার নিজস্ব মাধুর্যে ভরা ছিল।
এই ঘর অনেক স্মৃতি জড়ানো,কান্নাভেজা,মান-অভিমান,মানভঞ্জনের ঘটনায় সাজানো ছিল।একটি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে,১৪০০ বঙ্গাব্দে একটি সাহিত্য প্রতিষ্ঠান গড়া ও তার মুখপত্র হিসেবে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ সত্যই কঠিন ছিল।কিন্তু অসম্ভব ছিল না।"সাহিত্য কানন" নামে সাহিত্য প্রতিষ্ঠান গড়া এবং পত্রিকা প্রকাশ যদিও এই ঘর থেকে প্রথমে আত্মপ্রকাশ করেনি।তবে এই ঘরে বসে কবি-সাহিত্যিকদের অনেক বৈঠক,অনেক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।রাত জেগে পাণ্ডুলিপি তৈরী করা হয়েছে।কবিতা-গল্প লেখা হয়েছে।লেখা কাটাকুটি হয়েছে।লেখা বাদ পড়েছে।অনেকে গালি দিয়েছেন।অনেকে প্রশংসা করেছেন।"নব লহরী" নামক সাহিত্য দেওয়াল পত্রিকা রাত জেগে প্রস্তুত করা হয়েছে।"অতলান্ত" নামক ছাপা পত্রিকার অনেক সংখ্যা এই ঘরে বসেই সাজানো হয়েছে।এই ঘরেই "পারিজাত" সমাজসেবী প্রতিষ্ঠানের প্রথম বৈঠক বসে।সেদিনই প্রতিষ্ঠানের নাম "পারিজাত" গৃহীত হয়।কয়েকজন সেবা-মানসিকতার গ্রাম্য দামাল কিশোরের হাত ধরে আত্মপ্রকাশ করে "পারিজাত" সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান।বিদ্যালয় পড়ুয়াদের অল্প বেতনে পড়ানো,বয়স্কদের স্বেচ্ছাশ্রমে ও বিনা পারিশ্রমিকে পড়ানো,তাঁদের উপযুক্ত শিক্ষা সামগ্রী বিনামূল্যে দেওয়া,বনসৃজন,সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ জাগানো ছিল "পারিজাত"-এর মূল কাজ।
এই ঘর অনেক স্বনামধন্য কবি-সাহিত্যিকের চরণধূলায় ধন্য ছিল।অনেক গায়ক,আবৃত্তি শিল্পীদের সুরে গমগম করেছে।পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের কলতানিতে মুখরিত হয়েছে।এই ঘরেই অনেক কিশোর-কিশোরী বাল্যপ্রণয়ে আবদ্ধ হয়েছে।প্রেমের প্রথম প্রকাশ বানীরূপ পেয়েছে এই ঘরেই।মান-অভিমান-মানভঞ্জন-চোখের জল ঝরেছে এই ঘরে।প্রতি সরস্বতী পুজোতে বাসন্তী শাড়িতে সেজে যেন জীবন্ত সরস্বতী রূপে আসত কিশোরীরা।বছরের পর বছর ধরে এসেছে তারা।প্রেমাস্পদের সাথে দেখা করতে।অনেকে দেখা পেয়েছে।অনেকে পায় নি।অভিমান বুকে নিয়ে তারা ফিরে গিয়েছে।পরের বছরের জন্য আবার অপেক্ষা করেছে।সারাদিন তারা ঘুরেছে সাইকেলে।ক্লান্ত হয়েছে।কেউ আবার প্রিয়জনের দেখা পেয়ে সব ক্লান্তি ভুলেছে।কেউ কেউ আবার অপ্রকাশিত প্রেমকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারে নি সংকোচে-শরমে।মরমে মরেছে তারা গুমরে গুমরে।সেই সব প্রেমিক যুগলের অনেকেই প্রেমকে পরিণয় পর্যন্ত নিতে পারে নি।অনেকে বর্তমানে স্বামী-স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখি গৃহী।যৌবনের পড়ন্ত বিকেলে “আবার হয়ত কুড়ি কুড়ি বছরের পরে এসে দেখা” পেয়েছে ! স্মৃতি ভারাক্রান্ত হয়ে বাল্যের প্রেমকে পাথর চাপা দিয়ে সংসার করছে ! আবার আজ পর্যন্ত অনেকেই সেই কৈশোরের প্রেমকে সন্তান পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।
এই ঘর দেখেছে মৃত্যুর করাল রূপ।শুনেছে প্রিয়জনের ব্যথাদীর্ণ হাহাকার ধ্বনি।অনুভব করেছে কুটিল জনের বক্র দৃষ্টি।অগণিত মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে অবলীলায় দাঁড়িয়ে থেকেছে সে ঘর।এই ঘরে উঠেছে তুমুল তর্কের মহা প্লাবন।তৈরী হয়েছে তৃতীয় কিম্বা চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধের নীল নক্সা।দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সব কুচক্রীদের চক্রান্তকে মিথ্যা প্রমাণ করে তৃতীয় কিম্বা চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ লাগি লাগি করেও লাগে নি আর !
সেই ঘর ভেঙে দেওয়া হল ব্যথা-বিধুর বুকে ! নতুনের জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হল ! এটাই যে কালের নিয়ম!ভাঙতে গিয়ে অনেক কিছু খুঁজে পাওয়া গেল।যা পড়েছিল অবহেলায়।উঁইপোকায় খেয়েছে বা ইঁদুরে কেটেছে কিম্বা জলে নষ্ট হয়েছে আংশিক।অথচ সেই সময় এই তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিসের মূল্য ছিল অসীম।যা নষ্ট হলে হয়ত পৃথিবীটাই সেই কালে ফিরে যেত সূর্যের বুকে!সেগুলি আজ “অগ্নিশুদ্ধি” করা গেল অবিচলিত চিত্তে !
পুনরায় আরেকটি ঘর উঠবে পুরানোটার শূন্য স্থানে।ভাবী প্রজন্মের কাছে যেটা হবে তাদের নিজস্ব ঘর।নিজস্ব ভুবন।নিজস্ব একটি মহাপৃথিবী।
।। সুজিত চক্রবর্তী।।