এই প্রতিবেদন যখন প্রকাশিত হবে তখন ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হয়ে যাবে। আপাতত একজিট পোলের যা গতিবিধি তাতে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসতে নরেন্দ্র মোদীর বিন্দুমাত্র অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পশ্চিমবঙ্গেও ভালোই ফল করবে বিজেপি। একজিট পোল তাই জানাচ্ছে। পাঠক যখন পড়বেন তখন স্পষ্ট হয়ে যাবে। ঠিক কতগুলি আসন এরাজ্যে বিজেপি পেল। প্রধানমন্ত্রী তার প্রচারসূচিতে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলেন দুটি রাজ্যকে। একটি পশ্চিমবঙ্গ, দ্বিতীয়টি উত্তরপ্রদেশ। উত্তরপ্রদেশ ভারতের সরকার গড়ার অন্যতম চাবিকাঠি। সর্ববৃহৎ এই রাজ্যের ৮০টি আসনের ফলাফলের ওপর দিল্লির কুর্সি অনেকটাই নির্ভরশীল। গত লোকসভায় ৭৩টি আসন এই রাজ্য থেকে পেয়েছিল বিজেপি। সুতরাং উত্তরপ্রদেশকে বাড়তি গুরুত্ব প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দিতেই পারেন। এও ভাবতে হবে যে, এই রাজ্যে মায়াবতী-অখিলেশের যে ভোট হয়েছে তা স্রেফ বহুজন সমাজবাদী পার্টি-সমাজবাদী পার্টির অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে, গতবার যাদের ঝুলিতে যথাক্রমে শূন্য ও পাঁচটি আসন গিয়েছিল। তার ওপরে গান্ধী পরিবারের একদা পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত উত্তরপ্রদেশে এখন জাতীয়তার হাওয়া বইছে, তাকেও সম্মান। জানাতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু হঠাৎ পশ্চিমবঙ্গে তাঁর বারবার আসা-যাওয়া কেন?তৃণমূলের ভাষায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করা। এবিষয়ে রাজনৈতিক মহলে দুটি ব্যাখ্যা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক নম্বর, প্রধানমন্ত্রী পদের অন্যতম দাবিদার, সেই ভাগ্য শিকে না ছিড়লেও বিরোধী জোট (মতান্তরে ঘোঁট)-এর অন্যতম মুখ তো বটেই এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, সুতরাং তার সঙ্গে টক্কর দিতেই ভোটপ্রচারে এরাজ্যে ঘনঘন যাতায়াত মোদীর। দ্বিতীয় ব্যাখ্যা, উত্তরপ্রদেশইত্যাদিরাজ্যে বিজেপির আসন সংখ্যা কমবে বুঝেই সেই ঘাটতি পূরণে নরেন্দ্র মোদী পশ্চিমবঙ্গে জোর দিয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ যে যার মতো করতেই পারেন, কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু মমতাদেবীর প্রস্তাবিত আসন সংখ্যা ৪২ উলটে গিয়ে ২৪ হয়ে গেলেও তার গলাবাজি খবু একটা কমবে না এবং তার একান্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত মিডিয়াকুল যত রাজ্যের অপযুক্তি সাজিয়ে তাকে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হোক অন্তত মোদীর প্রতিপক্ষ রূপে খাড়া করতে চেষ্টার ত্রুটি রাখবে না।
সমস্যা তা নিয়ে নয়। সমস্যা হলো পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সাংগঠনিক জোর তেমন নয়, বরং প্রতিপক্ষ শাসক দলের গাজোয়ারি অগণতান্ত্রিক মনোভাব আর সেই সঙ্গে প্রশাসনিক পক্ষ পাতদুষ্টতা, অনৈতিকতা এবং যেনতেনপ্রকারেণ ৪২-এ ৪২ করবার জন্য যতদূর যেতে হয় তা যাওয়া, কেন্দ্রীয় বাহিনী ও নির্বাচন কমিশনকেও একপ্রকার ঠুটো জগন্নাথে পরিণত করার আশঙ্কা সত্ত্বেও মোদী আর সব রাজ্যকে পিছনে ফেলে হাজার প্রতিকূলতা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ প্রধানমন্ত্রী সঠিক ভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদ আর পশ্চিমবঙ্গের বিচ্ছিন্নতাবাদ একবিন্দুতে এসে এখন মিলে গিয়েছে।
এরাজ্যে প্রধানমন্ত্রীর ভোটপ্রচার নিছক দলীয় রাজনৈতিক প্রচার ছিল না। প্রতিটি সভা থেকে তিনি দেশপ্রেমের কথা বলেছেন। অন্যদিকে বিরোধীরা, যাদের নেতৃত্বে রয়েছেন মমতা ব্যানার্জি ,নিছক রাজনৈতিক স্বার্থে তারা দেশের স্বার্থ কীভাবে উপেক্ষা করতে পারেন, প্রধানমন্ত্রী সেই দৃষ্টান্তও দিয়েছেন। রাজনৈতিক প্রচার বলতে আমাদের ধারণায় মেঠো প্রচারই বোঝায়। কিন্তু প্রবল দাবদাহে প্রধানমন্ত্রীর প্রচারে এরাজ্যের বুদ্ধিজীবীরা যেভাবে গলদঘর্ম হয়েছেন তাতে কিছু প্রশ্ন উঠবেই। গণতান্ত্রিক দেশে যে কেউ প্রচারে যেখানে খুশি যেতে পারেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার অজুহাতে গণতন্ত্র বাঁচাও যাত্রাবাতিল করা থেকে বিজেপির সমস্ত রাজনৈতিক কর্মসূচি যখন বানচাল করছে রাজ্য প্রশাসন, এই রাজ্যের ‘বুদ্ধিজীবী নামধারীরা তখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছেন এক কল্পিত ‘সাম্প্রদায়িকতা’-কে রখবার তাড়নায়। রাজ্যবাসী এতটা বোকা নন, দেশভাগের সবচেয়ে নিদারুণ ক্ষত এই পশ্চিমবঙ্গে, পঞ্জাব তবু জনবিনিময়ের সুযোগ পেয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যে সেটুকুও জোটেনি। আমও গেছে, ছালাও গেছে। সুতরাং ইসলামিক সাম্প্রদায়িকতার বিপদ পশ্চিমবঙ্গ ও হিন্দু বাঙ্গালি জানে। তাই যখন হিন্দু থেকে মুসলমানে পরিণত এক গায়ক তীব্র হিন্দুবিরোধী প্রচার করেন, কিংবা স্ত্রীর মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করা কট্টর বাম থেকে কট্টর তৃণমূলি কবি বাংলাদেশ সরকারের কাছে আর্জি রাখেন তসলিমাকে নিয়ে গিয়ে বরং একশো ভিখিরি পাঠান’ বা মমতাজীবী এক কবি যখন ত্রিশূলে কন্ডোম পরান , তখন হিন্দু বাঙ্গালি এদের চিনে নেন খুব ভালো করে। তাই প্রাদেশিক উগ্রতাকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আজ মনেপ্রাণে বর্জন করেছে। সারা ভারতের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের এই মেলবন্ধনের সেতুটি বেঁধে দিয়ে গেলেন নরেন্দ্র মোদী।
বিশ্বামিত্রের কলম