চীনের কর্তৃত্বে বালুচিস্তানের কেন্দ্রস্থলে চালু থাকা উন্নয়ন প্রকল্পগুলি বালুচদের আদৌ সাহায্য করছে না। নিকট অতীতে পাকিস্তান সরকারকে এই সূত্রে নিশানা করার পর তারা চীনা সম্প্রসারণ নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে।
পাকিস্তানে স্থিত চীনা দূতাবাসে সম্প্রতি সন্ত্রাসী হামলা হয়। বালুচ লিবারেশন আর্মি সরাসরি এই হামলার দায় নিয়েছে। তারা ইসলামাবাদের আওতা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন বালুচিস্তান চায়। একই সঙ্গে প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে ইরান ও আফগানিস্থানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে চালু থাকা চীনা প্রকল্পগুলিরও তারা ঘােরতর বিরােধী।
উল্লেখিত আক্রমণের প্রেক্ষিতে চীনা কর্তৃপক্ষ পাকিস্তান সরকারের কাছে সে দেশে বসবাসকারী চীনা নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। ১৫ হাজারের বেশি উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাকিস্তানি সৈন্য বালুচিস্তানে চালু থাকা চৈনিক প্রকল্পগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সদা প্রহরারত। ইতিমধ্যে চলতি বছরের শুরুর দিকে আই এস চীনের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। এর কারণ চীনের তরফে উইঘুর মুসলমানদের ওপর ঝিনঝিয়াং প্রদেশে নির্যাতন চালানাের প্রতিক্রিয়া। এই আক্রমণের অন্য একটি ব্যাখ্যাও রয়েছে।
চীনের ওপর আক্রমণ :
পাকিস্তানে চালু থাকা চীনা প্রকল্পগুলির ওপর বালুচদের তীব্র অসন্তোষ রয়েছে। এর সহজ কারণ প্রকল্পগুলির মাধ্যমে উঠে আসা সুবিধের কোনও অংশই বালুচদের কোনও কাজে আসছে না। বিপুল সংখ্যক পাক সেনার নজরদারিতে চলা প্রকল্প অঞ্চলগুলিকে আদতে ‘ব্যারাক’ বলে মনে হচ্ছে। পাকিস্তানকে বরাবর সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালাতে গােপন সহায়তা করা চীনের ওপর নিজেদের কৃতকর্মই এমন বুমেরাং হয়ে আসছে। সম্প্রতি সমাপ্ত পাকিস্তানের নির্বাচনে জনতার একটা অংশ চীনের কার্যকলাপে ও প্রকল্পগুলির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। জনতার ক্ষোভ এই প্রকল্পগুলি থেকে উদ্ভূত চাকরি-বাকরি তারা কিছুই পাচ্ছে না, উপরন্তু এক ধরনের নব্য ঔপনিবেশিক জালে জড়িয়ে পড়ছে। ১ লক্ষ ৪৭ হাজার বর্গকিলােমিটার ব্যাপী বালুচিস্তানে পাকিস্তানি অধিবাসীর সংখ্যা মােট জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ। কিন্তু এই অঞ্চল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ও পাকিস্তানের অন্যান্য শক্তি (বিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ) সংরক্ষণের উৎস। এখানেই পারস্য উপসাগর থেকে আসা খনিজ তেলের পথ। ঠিক যেখানে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানের সংযােগস্থলে ত্রিভুজের সৃষ্টি হয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে এই অঞ্চলের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব রয়েছে। তাই এই অঞ্চলটি পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। ৩৭০ মাইলের দীর্ঘতম আরবসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল পারতপক্ষে গােটা পাকিস্তানেরই উপকূলবর্তী এলাকা।
অতীতে এই অঞ্চলে শাসন করে গেছেন সামন্ততান্ত্রিক প্রভুরা। ইতিহাসসিদ্ধ ভাবে একটি বিভিন্ন উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল ভিত্তিক এক ধরনের শিথিল শাসনব্যবস্থার প্রদেশ ছিল এটি। কখনও পারস্য সম্রাটদের অধীনে, কখনও বা আফগান রাজাদের বশ্যতা স্বীকার করত তারা। বালুচদের আদি জাতিসত্তার সঙ্গে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বসবাসকারীদের কোনও মিল নেই। অতীতে অনেকবারই তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে। আধা বিদ্রোহে শামিল হয়েছে। তারা দাবি করে আসছে আরও বেশি স্বায়ত্তশাসনের অধিকার, এমনকী পাকিস্তানের বাইরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। যেখানে বালুচদের কথায় এই রাষ্ট্রে এক পতাকার নীচে মিলিত হবে ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তানে বসবাস করা ৫০ লক্ষ বালুচ। পাকিস্তান এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল যে বালুচিস্তানের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগােলিক অবস্থান তার যে কোনও পড়শী দেশের পক্ষেই অধিকার করার পক্ষে একটি লােভনীয় অঞ্চল। পাকিস্তানের কাছে বাস্তবে বালুচিস্তান এখন শাঁখের করাত।
অন্যদিকে, ভারতের কাছে এই অঞ্চলের গুরুত্ব অসীম। কেননা ইরান বা মধ্য এশিয়া থেকে গ্যাসের পাইপ লাইন এলে তাকে এই অঞ্চলের মধ্য দিয়েই আসতে হবে। এদিকে পাকিস্তানের শাসক সম্প্রদায়ের কর্তাব্যক্তিরা দেশে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় সংহতি বজায় রাখার ভাবনায় যে কোনও ধরনের প্রাদেশিক স্বাতন্ত্রের দাবিকে সরাসরি বিচ্ছিন্নতাবাদের সূচনা বলে দাগিয়ে দিচ্ছে। প্রায় ৭০ বছরের পাকিস্তানি অস্তিস্তের মধ্যে বালুচরা বরাবরই মূলধারার বাইরে থেকেছে। দেখা যাচ্ছে কালক্রমে পাখতুনরা যখন মূল পাকিস্তানি সমাজের সঙ্গে ধীরে ধীরে মিশে গেছে, তখন বালুচরা দূরে সরে গেছে।
বাস্তবে বিভিন্ন প্রদেশের অধিবাসীরা তাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্যগুলিকে যখনই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে, জাতিসত্তার স্বীকৃতি চেয়েছে, তখনই পাকিস্তান এই সব ভাবনাকে দেশের বিপদ বলে চিহ্নিত করেছে। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে কেবলমাত্র পঞ্জাবিরা ছাড়া পাখতুনি, সিন্ধি, বালুচ, মহাজিররা সকলেই নিজেদেরকে উল্লেখিত পরিচয়ে চিহ্নিত করে। পরে তারা পাকিস্তানি বলে নিজেদের পরিচয় দেয়। শুধু তাই নয়, এই সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষরাই নিরন্তর একধরনের নির্যাতনের আতঙ্কে ভােগে। তারা মনে করে তাদের ওপর পঞ্জাবিদের তুলনায় বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে।
পাক সন্ত্রাসে চীনের মদত নিরাপত্তা পরিষদে চীন ঠিক সময়ে ভােট দিয়ে পাকিস্তানের সমর্থনে দাঁড়িয়েছে। প্রসঙ্গত লস্কর-ই-তৈবা ও এর সহযােগী সংস্থা জামাত-উদ-দাওয়া এই দুটিই রাষ্ট্রসঙ্ঘের ঘােষিত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। চীন তার ভেটো প্রয়ােগের অধিকার ব্যবহার করে পাকিস্তানে লস্করকে নিরাপদে রেখেছে। ভারতে ২৬/১১-এর নৃশংস সন্ত্রাসবাদী হামলার আগে আন্তর্জাতিক পরিসরে চীন তিন তিন বার জামাত উদ দাওয়াকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ঘােষণা করায় বাধা দিয়েছে।
চীন একথা খুব ভালাে করেই জানে যে, লস্কর-ই-তৈবা ও জামাত-উদ-দাওয়ার পারস্পরিক সম্পর্ক এবং পক্ষান্তরে তাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তদন্তকারী সংস্থাগুলির কী গভীর যােগসাজস রয়েছে। পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিস ইনটেলিজেন্স (আই এস আই) এদেরই সহযােগী হিসেবে একত্রে প্ল্যান করে মুম্বই হামলা চালিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জইস-এ-মহম্মদের প্রধান মাসুদ আজাহারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী ঘােষণা করার প্রস্তাবকেও চীন আটকে দেয়। নিরাপত্তা পরিষদে এই মার্কিনি প্রস্তাবের সমর্থনে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভারতের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল যাতে মার্কিন প্রচেষ্টা বাড়তি মান্যতা পায়। এই সূত্রে প্রধানমন্ত্রী মােদী বলেছেন, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের কারখানা। মার্কিন নৌসেনার এক অভিযানে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানেই বহাল তবিয়তে অবস্থান করছিল।
চীনের রাস্তা তৈরির মতলব বানচাল হতে পারে
চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক সংযােগ-পথ তৈরির মাধ্যমে বেজিং শুধু পাকিস্তান নয়, মার্কিন ও ভারতের মােকাবিলা করতে সমগ্র মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াতেই তাদের প্রভাব বাড়াতে চায়। চীন পাক ইকনমিক করিডাের (সিপিইসি) দক্ষিণ পাকিস্তানের বালুচ অঞ্চলে আরব সাগরে অবস্থিত গােয়াদর বন্দরের সঙ্গে পশ্চিম চীনের ঝিনঝিয়াং প্রদেশকে সংযুক্ত করবে। অতীতের সিল্ক রুট করিডােরের পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে বালুচিস্তানের মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। এই অঞ্চলটির মধ্যে দিয়েই যাবে উল্লেখিত সিপিইসি। সমগ্র ইউরােপ ও এশিয়ায় যাকে সংক্ষেপে ইউরেসিয়া বলা হয় উভয়কে যুক্ত করা এই অতিকায় প্রকল্পে ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ ধরা হয়েছে। এই বিস্তীর্ণ বাণিজ্যিক অঞ্চলে প্রাধান্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে কিন্তু জট আছে। চীনের কার্যকলাপ ইতিমধ্যেই সন্ত্রাসী আই এস সংস্থার নজরে এসেছে। বিপদ সংকেত দেখা যাচ্ছে। গত বছরে সংগৃহীত একটি ভিডিওতে দেখা গেছে আই এস চীনে বড়াে ধরনের রক্তপাতের বন্যা বইয়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছে।
৮০-র দশকে আমেরিকা যেমন ধনসম্পদের মদতে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, চীনের আজ সেই অবস্থা। চীন টাকা ছড়িয়ে সন্ত্রাসীদের কিনে নেওয়ার কথা ভাবছে। এমনটাই ভেবেছিল মার্কিনিরা, কিন্তু টুইন টাওয়ার ধূলিসাৎ হওয়ার পর তাদের ভুল ভেঙেছে। টাকা দিয়ে সন্ত্রাসীদের বশে রাখার মতলবে ছিদ্র দেখা যাচ্ছে। তারই ইঙ্গিত রয়েছে বালুচ বিক্ষোভে। তারা পাকিস্তানের অন্য প্রদেশগুলির বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষদের নিয়ে রুখে দাঁড়ালে চীনের গােয়াদর বন্দর এলাকার মতলব মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।
ড. সতীশ কুমার
(লেখক একজন পরিবেশবিদ এবং শুমাখার কলেজের প্রতিষ্ঠাতা)