বায়ু হোক প্রাণদায়ী, আয়ু হোক দীর্ঘ

প্রায় তিনপক্ষকাল ধরে সারা ভারত দেবীপক্ষ পালন করল। এই সময়কালে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আদ্যাশক্তি পূজিতা হলেন দুর্গা, বিন্ধ্যবাসিনী, লক্ষ্মী, কালী, মহালক্ষ্মী, ষষ্ঠী (ছট্), জগদ্ধাত্রী ইত্যাদি রূপে। বিহার ও উত্তর প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দুর্গাপূজার সময়ে চিরাচরিতভাবে প্রতিবছরের মতাে পূজিতা হলেন ভারতমাতা। এই সময়কালের মধ্যেই কার্তিকী অমাবস্যায় পালিত হল দীপাবলী।

কার্তিকী অমাবস্যা তিথিতে বাংলায় কালীপুজো বা পশ্চিম ভারতে মহালক্ষ্মীপুজো যাই হােক না কেন সেই অমানিশি সর্বত্রই আলােকিত হয় দীপালােকে। বলা হয় শ্রীরামচন্দ্র চৌদ্দবছর বনবাসের অন্তে রাবণবধ করে সীতাদেবীকে নিয়ে কার্তিক অমাবস্যা তিথিতে সপারিষদ অযােধ্যায় ফিরেছিলেন। আনন্দবিহ্বল অযােধ্যাবাসীরা সেদিন নিজেদের বাসগৃহ দীপমালায় আলােকিত করে তাদের স্বাগত জানিয়েছিলেন। এ বছরে অযােধ্যাবাসীরা দীপাবলীর রাত্রে তিন লক্ষ মাটীর প্রদীপ জ্বালিয়ে সরযূনদীর তীরকে সাজিয়ে গিনেস্ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে।

বর্তমানে সেই দীপােৎসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আতশবাজি। কবে থেকে যে আতশবাজি দীপাবলির অঙ্গ হয়ে উঠেছে জানা নেই। চীনদেশে বারুদ আবিষ্কৃত হলেও বাবরের সময়েই ভারতে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম বারুদ ব্যবহৃত হয়। হয়তাে তারাই সােরা, গন্ধকের সঙ্গে নানা খনিজচূর্ণ ও রাসায়নিক মিলিয়ে অঙ্গার যােগ করে আতশবাজি বানায় যা আজ ভারতীয় জীবনে সকল উৎসবের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ আতশবাজি শব্দটি ফার্সি, আতশ (আগুন) ও বাজি (খেলা) দুটি শব্দের যােগে তৈরি। কালীপূজো ও তারপরবর্তী সব পুজোতেই যেভাবে কলকাতাবাসী আতশবাজির আনন্দের সঙ্গে কষ্টও ভােগ করেছে তা সকলেই জানে। আতশবাজি থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া ও প্রচণ্ড শব্দ করে নাগাড়ে ফেটে চলা বােমা ও পটকা আমাদের প্রাণ অতিষ্ঠ করে তুলেছিল প্রায়। পুরাে নভেম্বর মাসটি কলকাতা ছিল বায়ুদূষণে দেশে এক নম্বর স্থানে, দিল্লির অবস্থাও ছিল কলকাতা থেকে অনেক ভালাে।

টানা প্রায় একমাস ধরে কলকাতাবাসী ভয়ঙ্করভাবে বিষাক্ত বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে বাধ্য হয়েছে। মানুষ সেই বিষাক্ত ধোঁয়া থেকে বাঁচবার জন্য জানলা-দরজা বন্ধ রেখে রক্ষা পাবার চেষ্টা করেছে। অনেকেই অর্থব্যয় করে বায়ুশােধক যন্ত্র কিনেছে। তবু সেই বিষাক্ত বায়ু ঘরে ঘরে কাশি, শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি করেছে। যারা বাজি পুড়িয়েছে তারাও সমভাবেই এর কুফল ভােগ করেছে।

নভেম্বর মাসের প্রায় পুরােটাই বাতাসে অতিসূক্ষ্ম ২.৫ মাইক্রন আকারের কণার পরিমাণ কলকাতায় প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে ছিল ৩০০-৪০০ পিপিএম। এই অতিসূক্ষ্ম রাসায়নিক, ধাতুকণা ও ধূলিকণা শ্বাসবাহিত হয়ে আবাল-বৃদ্ধবনিতার শ্বাসযন্ত্র ও রক্তস্রোতে যে বিষ সঞ্চারিত করল তার কুফল অপরিমেয় ও অপূরণীয়। গবেষকরা বলছেন দীর্ঘকাল ধরে রক্তস্রোত বিষাক্ত হওয়ায় প্রধানত শিশু ও বৃদ্ধেরা শ্বাসকষ্টে ভুগবে, গর্ভবতী মহিলাদের অটিস্টিক ও নানাভাবে অসুস্থ শিশু জন্মাবার সম্ভাবনা দেখা দেবে। হার্ট ও মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালীতে ক্যালশিয়াম জমে হৃদস্পন্দনের ছন্দপতন ঘটাবে ও আকস্মিক হৃদ্‌রােগে প্রাণ হারাবে কর্মব্যস্ত নারী ও পুরুষ। সমগ্র জনসমুদায়কে এমন অসহনীয় পরিবেশে রেখে দেওয়ার দায় কার এবং এর থেকে মুক্তির উপায়ই বা কী? কলকাতা বহু বছর ধরে ভারতের লাং ক্যান্সারের রাজধানী হয়ে আছে। এই উপাধি থেকে কলকাতাকে মুক্ত করার দায়িত্বই বা কে নেবে? কলকাতার প্রাক্তন মার্কিন কন্সাল জেনারেল ক্রেস হ্যাল কলকাতার দূষণ নিয়ে বলেছিলেন তাঁদের দেশ প্ৰদূষণ রােধে সফলতা পেয়েছে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করে ও তার সতর্ক পর্যবেক্ষণ সহ শক্তহাতে তার প্রয়ােগ করে।

আজ থেকে প্রায় ২৭ মাস আগে জাতীয় হরিৎ বিচারালয় (NGT) রাজ্য সরকারকে বিভিন্ন নির্দেশ দিয়ে বায়ুর প্রদূষণ নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে বলে। এ যাবৎ রাজ্য সরকার সেগুলিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করায় রাজ্যের বড় শহরগুলি প্রদূষণের কবলে পড়ে ও এজন্য NGT রাজ্যকে পাঁচ কোটি টাকা জরিমানাসহ দিকনির্দেশ করেছে যাতে রাজ্যবাসী এই অসহনীয় পরিবেশ থেকে অবিলম্বে মুক্তি পায়। আজ থেকে ১০৩ বছর আগে ব্রিটিশ যুগে বাড়ির উনানের ধোঁয়া ও কারখানার চিমনির ধোঁয়া থেকে পরিবেশকে মুক্ত রাখতে ১৯০৫ সালে বেঙ্গল স্মােক নিউসাল্স অ্যাক্ট তৈরি হয়েছিল যা অমান্য করলে ২০০০ টাকা জরিমানা ও এক মাসের জেল হতাে। দ্বিতীয়বার তা করলে ৫০০০ টাকা জরিমানা ও দু’মাসের জেল ছিল শাস্তি। তখন মােটরযানের ধোঁয়ার উপদ্রব তেমন ছিল না বলে সে বিষয়ে আইন হয়নি। আজ ধোঁয়ায় আকাশ-বাতাস আচ্ছন্ন হলেও, মানুষ জীবন্মৃত হয়ে বাস করলেও তা থেকে উদ্ধারের উপায় নেই। কোনও আইন নেই, কারও কোনও শান্তি নেই। দু’বছর আগে দিল্লির পরিবেশ ছিল এমনই অসহনীয়। তখন দিল্লি সরকার গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে জোর-বিজোড় নম্বরের গাড়ির জন্য আলাদা দিন স্থির করে, নির্মাণ সংস্থাগুলিকে নিয়মে বেঁধে, বাজারে বাজি বিক্রি নিয়ন্ত্রিত করেও নানা উপায়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করে। ছােট ছেলে মেয়েদের দূষণ থেকে রক্ষা করতে স্কুল বন্ধ রাখে অনেকদিন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ভারত স্টেজ VI এমিশন স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করে দিল্লি সরকার সেখানে ৪০ লক্ষেরও বেশি পুরাতন গাড়িকে বাতিল করেছে।

দিল্লির বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ পঞ্জাব ও হরিয়ানায় জমির নাড়া পােড়ানাে ধোঁয়ার সমস্যা। গ্রিন রেভলিউশনের ফলে সেখানে কাস্তে দিয়ে গােড়া ধরে শস্য না কেটে হার্ভেস্টার যন্ত্র দিয়ে শস্যের শিষের অংশটুকু কাটা হয় মাত্র। হাজার হাজার হেক্টর জুড়ে পড়ে থাকা শস্যের নাড়া যাকে সেখানে পরলী বলা হয় সেগুলি পুড়িয়ে দিয়ে কৃষকেরা ক্ষেতকে মুক্ত করে। অগ্রহায়ণ মাসের শস্য কাটার পর রবিশস্যের চাষের আগে ক্ষেত তৈরি করতে এভাবে সৃষ্টি হয় বিপুল পরিমাণের ধোঁয়ার যা স্থানীয় বায়ুর প্রবাহ ধরে জমা হয় দিল্লি অঞ্চলে। সেই ধোঁয়া প্রতিবছর শীতের মুখে দিল্লিবাসীকে অসহনীয় কষ্টে ফেলে। এরও একটা সর্বজনগ্রাহ্য ব্যবস্থা হওয়া দরকার।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে সারা বিশ্বে ২০১৬ সালে ১১ লক্ষ লােক দূষণ সংক্রান্ত রােগে মারা গিয়েছিল। শরীর অসুস্থ হলে লােকে আহার-বিহার, পােশাক সহ সমগ্র দিনচর্যাকে নিয়ন্ত্রিত করে নিজেকে সুস্থ করে। প্রকৃতি অর্থাৎ মানুষের জীবনের আধার, তার স্বাভাবিকতা হারিয়েছে। তার নিজস্ব শােধন ব্যবস্থা অকার্যকরী হয়ে পড়েছে। মানুষকে এখন নিজের স্বার্থে প্রকৃতিকে প্রকৃতিস্থ হতে সহায়তা করতে হবে। এজন্য ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা যেমন স্বাগত, তেমনই স্বাগত সমষ্টিগত প্রচেষ্টাও সামগ্রিকভাবে সকল দেশকে মিলিত করে বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টার। অপচয় রােধ, এর এক বড় অঙ্গ। ব্যক্তিগত ভাবে কোনও কিছুই অপচয় না করা, তা সে খাদ্য, বস্ত্র জল বা শক্তি যাই হােক না কেন—এক ফলপ্রসূ পদক্ষেপ। সমষ্টিগত ভাবে বায়ুকে প্রদূষণমুক্ত রাখতে অন্যান্য বহু পদক্ষেপের সঙ্গে বিগত কয়েক বছর ধরে ইউরােপের বহু শহর বড়দিন ও নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছে আতশবাজি না করে। আমাদের প্রতিবেশী সিঙ্গাপুর ১৯৭২ সাল থেকেই সেখানে আতশবাজি নিষিদ্ধ করে রেখেছে। ২০১৮ সালের দেওয়ালিতে সেই নিষেধ অমান্য করায় ছয়জন ভারতীয় যে সেখানে দণ্ডিত হয়েছেন সে খবরও আমরা পেয়েছি। বিশ্বস্তরেও এই প্রচেষ্টা চলেছে সেই ১৯৭২ সাল থেকে যাতে বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে থাকে। এরই নানা পদক্ষেপের মধ্যে একটি হল বৃক্ষরােপণ। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বৃক্ষরােপণ দেখেছি অযােধ্যা পাহাড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। প্রতিষ্ঠানগত বৃক্ষরােপণের নানা খবর থাকে নানা সময়ে সংবাদপত্রে। সদ্য প্রকাশিত এক খবরে দেখলাম দুটি প্রতিষ্ঠান (যুগ্মভাবে) ইন্দোরে দেড়লক্ষ, চেন্নাইয়ে দেড়লক্ষ, দিল্লির রাজধানী অঞ্চলে সত্তর হাজার ও আহমেদাবাদে একলক্ষ তিরিশ হাজার বৃক্ষ রােপণ করেছে এই বর্ষার পর। শুধু দুঃখ পেয়েছি পশ্চিমবঙ্গের কোনও অঞ্চলে এমন শুভকাজ হওয়ার খবর না থাকায়। তবু আশা হয় হয়তাে সামনের বছর দেবীপক্ষ এমন ধূম্রময় হবে না, বায়ু সর্বত্র নির্মল হবে, বসুন্ধরার তাপ কমবে ও বর্ষাকালে বৃষ্টি দেবে। দূষিত বায়ু সেবন করে মানুষ মৃত্যুপথে এগিয়ে যাবে না।

গৌরী বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.