১৮৮৯ সাল থেকে প্যারিসের উপকণ্ঠে সেন্ট ক্লাউডে রাখা আছে প্ল্যাটিনাম-ইরিডিয়ামের তৈরি একটি সিলিন্ডার। যার নাম ল্য গ্রঁদ কে। এই সিলিন্ডারটিকেই ধরা হত এক কিলোগ্রামের আদর্শ নমুনা। কারণ, এতদিন এই ধাতবখন্ডটির ওজনকে ‘এক কেজি’ নির্ধারণ করে তার অনুপাতে সারা বিশ্বে ওজনের কাজ চালানো হত।
১৮৮৯ থেকেই পৃথিবীর সর্বত্র একই ওজন ব্যবস্থা প্রচলনের জন্য ওই ধাতবখণ্ডের রেপ্লিকা বানিয়ে তা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে প্রতি দশকে অন্তত একবার ওই ‘ল্য গ্রঁদ কে’ এবং তার রেপ্লিকাগুলোর ভর মাপা হত। কিন্তু বেশ কিছু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পাচ্ছিলেন, ওজন হারাচ্ছে ‘ল্য গ্রঁদ কে’। দেখা গিয়েছে, প্ল্যাটিনাম-ইরিডিয়াম সংকর ধাতুতে তৈরি এক কিলোগ্রাম ধাতবখন্ডটির ভর ১৩০ বছরে ৫০ মাইক্রোগ্রামের মতো কমে গিয়েছে।
যদিও তা খুবই নগণ্য। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, এক কেজিতে এইটুকু ওজন কমও বিজ্ঞান ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। গত ১৭ মে, শুক্রবার ফ্রান্সের ভার্সাইয়ে ওজন এবং পরিমাপ বিষয়ক ২৬তম সম্মেলনে ৬০ দেশের বিজ্ঞানীরা কিলোগ্রামের নতুন সংজ্ঞার সমর্থনে রায় দেন। নতুন কিলোগ্রাম হিসেবে প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবককে অনুসরণ করার ভোটাভুটিতে অংশ নিয়েছিল পৃথিবীর অনেকগুলো দেশের প্রতিনিধিরা। সম্মেলনে ঠিক হয়, আর ‘ল্য গ্রঁদ কে’-র ওজন থেকে নয়, কিলোগ্রামকে সংজ্ঞায়িত করা হবে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ দ্বারা।
নতুন কিলোগ্রামের নতুন ও নিখুঁত সংজ্ঞার জন্য কাজে লাগানো হচ্ছে প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক এবং বিজ্ঞানী ব্রায়ান কিবলের স্কেল। আলোর গতি আর কম্পাঙ্কের সম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক আবিষ্কার করেন প্রয়াত নোবেল জয়ী জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবকের মান ৬.৬২৬০৭০১৫X১০-৩৪ (মিটার)২ কিলোগ্রাম/সেকেন্ড।
নোবেলজয়ী পদার্থবিদ উলফগ্যাং কেটের্লে, প্ল্যাঙ্কের একক ব্যবহার করে প্রমাণ করেছেন, নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক ফোটনের ভর এক কিলোগ্রামের সমান বলা যায়। ফোটন কণার মাধ্যমে কিলোগ্রামের সংজ্ঞা তৈরি হলে তার পরিমাপে গলদ থাকবে না। যেমন কেটের্লে নির্ভূল ভাবে প্রমাণ করেছেন, সিজিয়াম পরমাণুর একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘের ১.৪৭৫৫২১৪X১০৪০ টি ফোটনের ভর এক কিলোগ্রাম। তাই ফোটন কণার মাধ্যমেই তৈরি হচ্ছে এক কিলোগ্রামের নতুন সংজ্ঞা।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্টান্ডার্ড অ্যান্ড টেকনোলজির প্রধান, স্টিফেন স্ল্যামিনজার জানিয়েছেন, আগের কিলোগ্রামের সঙ্গে নতুন কিলোগ্রামের ওজনের পার্থক্য অতি নগণ্য। এক কিলোগ্রামের দশ কোটি ভাগের এক ভাগের ওজনের সমান হবে এই পার্থক্য। যা কিনা একটি চোখের পাপড়ির চার ভাগের এক ভাগ ওজনের সমান। সাধারণ মানুষের কাছে এটা নেহাতই নগণ্য হলেও বিজ্ঞানীদের কাছে এই ওজনের ফারাকটাও অনেক। কারণ তাঁরা সব জিনিসেরই ১০০% নির্ভূল পরিমাপ চান। মূলত সেই কারণেই মানুষের তৈরি কিলোগ্রামকে বদলে, কিলোগ্রামকে মাপতে নেওয়া হচ্ছে প্রকৃতির সাহায্য। যা কিনা নিখুঁত ভাবে এক কিলোগ্রামই হবে। ওজনের তারতম্য হবে না।
ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল ফিজিক্স ল্যাবরেটরির (এনপিএল) বিজ্ঞানী পেরডি উইলিয়ামস জানিয়েছেন,“এটি একটি অসাধারণ ঘটনা। মাপজোকের রীতিতে পরিবর্তন আসায় কিছুটা দুঃখ পেলেও নতুন পদ্ধতি একেবারে নিখুঁতভাবে কাজ করবে বলেই আমার ধারণা”। বিজ্ঞানীদের দাবি, কিলোগ্রাম বদলে গেলেও তাতে দোকান বাজারের কেনাকাটার ক্ষেত্রে ওজনের হেরফের ঘটবে না। বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে, ওষুধ শিল্পে কিলোগ্রামের এই পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
তাই আজ ,২০ মে, ২০১৯, বিশ্ব ওজন দিবসে বদলে যাবে কিলোগ্রামের সংজ্ঞা। আজ ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির হান্টিংটন হলে কিলোগ্রাম, অ্যাম্পিয়ার, কেলভিন ইত্যাদি ইউনিটের নতুন সংজ্ঞা শোনাবেন নোবেলজয়ী পদার্থবিদ উলফগ্যাং কেটের্লে। তারই অপেক্ষায় সময় প্রহর গুনছেন বিশ্বের বিজ্ঞানপ্রেমী মানুষেরা।
আজই আসবে সেই দুঃখজনক মুহূর্তটি। ১৩০ বছর পরে হঠাৎই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় রাখা ‘ল্য গ্রঁদ কে‘। বিজ্ঞানীদের কাছে তার আর দাম নেই। তাই ‘ল্য গ্রঁদ কে‘ তার জীবন খুঁজে নেবে কোনও মিউজিয়ামে, হয়ত বা ইতিহাসের পাতায়।